অমিয় চক্রবর্তী

কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গীতিকার এবং সুরকার অমিয় চক্রবর্তীর(amiya chakravarty) জন্মঃ-১০ এপ্রিল, ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে।তাঁর পুরো নাম অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী।ওনার বাবা মা ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত।ছোট থেকে শিক্ষিত পরিমণ্ডলে বড় হওয়ার ফলে ওনার মধ্যে সহজেই না-জানাকে জানার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কলম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন।এখান থেকেই ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন  ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সেখানেই ইতি হল। পরবর্তী কালে  পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে।তারও পরে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ এলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. ফিল করেন।

অমিয় চক্রবর্তী(amiya chakravarty) ছিলেন প্রকৃতই এক বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পরিব্রাজক হিসেবে।  তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র-ভক্ত হিসেবে খ্যাত অ্যানড্রুজের বন্ধু আলেকজাণ্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে ব্রিটেনের বার্মিংহামের কলেজে আমন্ত্রণ জানালে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে  কবি ইংল্যান্ড যান। সেটাই ছিল কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বছর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেন।  অক্সফোর্ডের ব্রেজনোস্‌ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি। এ-সময় ব্যাপক ভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্থান সফর করেছেন আধুনিক কালে ধর্মআন্দোলন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও অনেক দেশে গিয়েছেন অমিয় চক্রবর্তী। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব-পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশী ভ্রমণ করেছেন তিনি। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরো দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারস্য ও মধ্য-প্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। প্রশান্ত এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং জাপান ও কোরিয়া সহ পৃথিবীর নানা দেশ-মহাদেশ বহুবার পরিভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কান্‌সাস বিশ্ববিদ্যালয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, স্মিথ্‌ কলেজ, ন্যুইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং রবার্ট ওপেন্‌হাইমারের আমন্ত্রণে ১৯৫১-তে প্রিন্স্‌টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্‌ষ্টিট্যুট অব অ্যাডভান্স্‌ড স্টাডিস্‌-এর ফেলো হিসেবে ভ্রমণ করেছেন। ঐ ১৯৫১-রই গ্রীষ্মে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন প্রোটেস্টাণ্ট চার্চ সম্মেলনে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময় পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানির  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ধর্ম এবং প্রাচ্য সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। বেশ কয়েকবার অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছেন শিবনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে। জাপানে জেন মণীষী সুজুকি-র সঙ্গে গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব। আফ্রিকায় অ্যালবার্ট শোয়াই্‌ট্‌জার এর সঙ্গে । ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কবি বরিস পাস্টেরনাকের সঙ্গে হয় ঘনিষ্ঠ পরিচয়। এছাড়াও কবি ইয়েটস্‌, জর্জ বাণার্ড শ, কবি রবাট ফ্রষ্ট, পাবলো কাসলস্‌ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ভারত ছেড়ে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। পরপর ১৯৪৯-৫১-৫৪-৫৬-৬০-৬৩-৬৬-৭০-৭২-৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে এসেছেন বারবার। ১৯৫০ সালে তিনি রাষ্ট্রসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের উপদেষ্টা হয়েছিলেন।

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ক্ষেত্রে  পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে পরিচিত কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন অমিয় চক্রবর্তী। তাঁর প্রথমদিককার কবিতায়  রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল স্পষ্ট।  পরে অবশ্য নিজস্বতা অর্জন করেন সহজেই।  প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ কবিতাবলী এবং উপহার প্রকাশের পর ১৯৩৮-এ প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ খসড়া।কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেন যে, “খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিৎ নয়।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে দেখেছিলেন “অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য”, বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ।

অমিয় চক্রবর্র্তী যে সব পত্র-পত্রিকায় কম-বেশী নিয়মিত লিখেছেন তার মধ্যে রয়েছে কবিতা, বিচিত্রা, উত্তরসূরী, কবি ও কবিতা, পরিচয়, প্রবাসী প্রভৃতি। এর মধ্যে এক “কবিতা” পত্রিকাতেই অমিয় চক্রবর্তীর বেশ ক’টি গদ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছিল: ‘এজরা পাউণ্ড: কবিতা’র দরবারে পত্রাঘাত’ (পৌষ ১৩৫৫), ‘এলিয়টের নতুন কবিতা’ (পৌষ ১৩৫০), ‘জয়েস প্রাসঙ্গিকী’ (কার্তিক, ১৩৪৮), ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ (পৌষ, ১৩৬০), ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি’ (আশ্বিন, ১৩৪৮), ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য’ (আশ্বিন, ১৩৫৩) এবং ‘সমালোচকের জল্পনা’ (আশ্বিন, ১৩৫০)।, এছাড়া বুদ্ধদেব বসুর “নতুন পাতা” এবং সমর সেনের “গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা” গ্রন্থদ্বয়ের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল (যথাক্রমে পৌষ ১৩৪৭ এবং কার্তিক ১৩৪৭ সংখ্যায়)। তিনি তাঁর “চলো যাই” গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার এবং “ঘরে ফেরার দিন” কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। আরও বহু সম্মাননায় ভূষিত কবি, ভারত সরকার দ্বারা ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন এবং বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম সম্মানে ভুষিত হন ১৯৬৩ সালে।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলী
কাব্য
খসড়া
এক মুঠো
মাটির দেয়াল
অভিজ্ঞান বসন্ত
দূরবাণী পারাপার
পালাবদল
ঘরে ফেরার দিন
হারানো অর্কিড
পুষ্পিত ইমেজ
গদ্য রচনা
চলো যাই
সাম্প্রতিক
পুরবাসী
পথ অন্তহীন
অমিয় চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংগ্রহ

১২ জুন ১৯৮৬ সালে এই বিদগ্ধ মনীষীর জীবনাবসান হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান