জম্মু-কাশ্মীর থেকে শুরু করে হায়দ্রাবাদ, ভোপাল, জুনাগড় প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের পাশাপাশি পর্তুগিজ ও ফরাসিদের উপনিবেশ হিসেবে যে রাজ্যগুলি ছিল ভারতে স্বাধীনতার সময়ে সেগুলিকেও ভারতে সংযুক্তিকরণের চেষ্টা করেছিল ভারত সরকার। দেশীয় রাজ্যের সংযুক্তিকরণের পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তাওয়াং, সিকিম প্রভৃতি অঞ্চলও ধীরে ধীরে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অন্তর্ভুক্তিকরণের পদ্ধতি সহজ ছিল না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিকিম আগে ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, দেশীয় রাজাদের দ্বারা এই অঞ্চল স্বতন্ত্রভাবে শাসিত হতো। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৬ মে ভারতীয় সংবিধানের সংস্কারসাধনের মধ্যে দিয়ে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
ভারতের সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী জানা যায় উত্তর-পশ্চিম সিকিমেই শিব কিরাতেশ্বর মন্দিরে শিকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৬৪২ সালে এই রাজ্যটি ছোগিয়াল রাজাদের দ্বারা শাসিত হতো। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর সিকিমের তিনজন মহান লামার দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন সিকিমের রাজা। ছোগিয়াল রাজা এবং এই তিন মহান লামার পরামর্শে সিকিমের সঙ্গে ছাম্বি উপত্যকা অর্থাৎ অধুনা দার্জিলিং এবং নেপালের পূর্বাংশ সংযুক্তিকরণের চেষ্টা করা হয়। ছোগিয়াল রাজা সেই সময় সমগ্র সিকিম রাজত্বকে বারোটি পৃথক পৃথক প্রশাসনিক বিভাগে বিভাজিত করেন। তখনও সিকিমের অধিবাসী তিব্বতি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ থামেনি। ভুটিয়া, লেপচা, মাগার কিংবা লুম্বারা একে অপরের বিবদমান গোষ্ঠী হয়ে উঠেছিল এবং শেষে মাগার জাতির মানুষেরা একটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিকিম ত্যাগ করে চলে যায়। এর কিছুকাল পরে নেপাল ও ভুটান ক্রমান্বয়ে সিকিম দখলের জন্য অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সিকিম উভয়ের শত্রু নেপালের বিরোধিতা করতে থাকে। ইতিমধ্যে সিকিমে নেপালের আক্রমণ ঘটলে ১৮১৪ সালে শুরু হয় ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরে উভয়ের মধ্যেই একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এর ফলেই তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ও সুগম পথের সন্ধান করছিল। নেপাল ও সিকিমের মধ্য দিয়ে যে ‘রেশম সড়ক’ চলে গেছে, তার শাখা হিসেবেই এই নতুন পথের সন্ধান করছিল ব্রিটিশরা। এদিকে তিব্বতের উপর রাশিয়ার প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল, এই প্রভাবকে খর্ব করতেও এই নতুন সংযোগকারী পথের সন্ধান করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুদিন পরে মোরাং অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার আমদানি-রপ্তানির উপর নতুন করের নিয়ম চালু করলে সিকিম ও ভারতের চুক্তির শর্ত ক্ষুণ্ন হয়। ১৮৩৫ সালে সিকিমের সঙ্গে দার্জিলিং-এর সমস্ত সংযোগ রুদ্ধ করে দেওয়ায় ভারত ও সিকিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ফলে ব্রিটিশ অধিকৃত সিকিমের পাশাপাশি পৃথকভাবে স্বতন্ত্র সিকিম রাজ্য বিদ্যমান ছিল। ১৯১৮ সালে স্বাধীনভাবে সিকিম রাজ্যটি গড়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকারের সর্বপ্রকার অনুমতিসাপেক্ষে। ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল তখন এই সিকিম রাজ্যটি ছিল স্বাধীন এবং তার সার্বভৌম মর্যাদা তখনও অক্ষুণ্ন ছিল। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের আগে সিকিম ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল এই মর্মে যে সিকিম আসপে ভারতের একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে এবং দিল্লি সিকিমের সমস্ত প্রকারের বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়ে দেখাশোনা করবে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে সিকিমের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়নি। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সিকিমের তৎকালীন ছোগিয়াল রাজা তাশি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কিন্তু ভারত-চিন যুদ্ধের পরে এই অবস্থাটা পালটে যায়। নাথুলা গিরিপথ সিকিমের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তিব্বতে অনবরত যুদ্ধবিগ্রহ চলতেই থাকে। ফলে ভারত সরকারের পক্ষে সিকিম রাজ্যটি তখন একটি নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি তৈরি করে।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
১৯৭২ সালে সিকিমকে একটি স্থায়ী সমিতি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এর মধ্যে দিয়েই ভারতের সঙ্গে সিকিমের অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু এর ফলে সিকিমের মানুষের মধ্যে বিরোধিতা ও বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে। এই সমস্ত বিরোধিতা পেরিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল সিকিমে একটি গণভোট আয়োজিত হয় এবং এই গণভোটের মাধ্যমেই সিকিমের বাসিন্দারা ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। ফলে ১৯৭৫ সালের ১৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করা হয়। এরপর থেকে সিকিমের রাজবংশের সমস্ত ক্ষমতা ও অধিকার অবলুপ্ত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সিকিমের অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য ভারতীয় সংবিধানে ৩৫তম সংস্কারের মাধ্যমে সিকিমকে সহযোগী রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং পরে ৩৬তম সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে সিকিম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজ্য হিসেবে বিকশিত হয়। চিন কিন্তু প্রথমদিকে সিকিমের এই অন্তর্ভুক্তিকরণ মেনে নিতে পারেনি। ২০০৩ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন চিন সিকিমের অন্তর্ভুক্তিকরণে সম্মত হয়।
তথ্যসূত্র
- https://www.thequint.com/
- https://www.globaltimes.cn/
- https://eurasiantimes.com/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.indiatoday.in/
- https://www.sikkim.ch/
