ভাস্করাচার্য

ভাস্করাচার্য ।। ভাস্কর ২ ।। দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য

গণিতশাস্ত্রের অগ্রগতিতে ভারতীয় গণিতবিদদের এক অসামান্য অবদান রয়েছে। আর্যভট্টদের সঙ্গে সেই তালিকায় অবশ্যই উচ্চারণ করতে হবে ভাস্করাচার্য -এর (Bhaskaracharya ) নাম। তবে গণিতবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন প্রথিতযশা জ্যোতির্বিদও ছিলেন। তাঁর ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামক গ্রন্থটিকে প্রাচীন গণিতশাস্ত্রগুলির মধ্যে একটি বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত বিষয়ে সেই গ্রন্থমধ্যে চর্চা করেছিলেন। এছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করতে গিয়ে তিনি গ্রহগুলির প্রকৃত দ্রাঘিমাংশ, গ্রহের অক্ষাংশ, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সিদ্ধান্ত শিরোমনি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন ভাস্করাচার্য। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, তাঁর বইতে মাধ্যাকর্ষণের ইঙ্গিতও পাওয়া যায় নিউটনের আবির্ভাবের বহু বছর আগে৷ এ নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি৷

ভাস্করাচার্যের জন্ম তারিখ এবং স্থান নির্ণয়ের জন্য তাঁর নিজের লেখার ওপরেই নির্ভর করে থাকেন পন্ডিতেরা। ভাস্করাচার্য নিজেই ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’তে একটি শ্লোক রচনা করেছিলেন, যা থেকে বোঝা যায় শক যুগের ১০৩৬ সালে অর্থাৎ ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। এক হিন্দু ঋগ্বেদী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ভাস্করাচার্যের জন্মস্থান অনুমান করা হয় বিজ্জডবিড। এই জায়গাটির বর্তমান অবস্থান নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন এটি বর্তমানে কর্নাটকের বিজাপুর নামে পরিচিত। অনেকে আবার চালিসগাঁওয়ের পাটন শহর বলে বিশ্বাস করতেন জায়গাটিকে এবং গবেষকরা বলেন এটি বর্তমানে মহারাষ্ট্রের খানদেশ অঞ্চল। কেউ কেউ তেলেঙ্গানার বাসর অঞ্চলের কথা বলে থাকেন।

আসলে তাঁর নাম ছিল ভাস্কর, পরে আচার্য যুক্ত করা হয়েছে, যার অর্থ শিক্ষক। এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন এই একই নামে সপ্তম শতাব্দীতে একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের আলোচ্য গণিতবিদ ভাস্করাচার্যকে আলাদা করবার জন্য তাঁর নামের পাশে অনেকসময় ‘২’ সংখ্যাটি ব্যবহার করা হয়, অনেকে আবার দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য বলে থাকেন। ভাস্করাচার্যের প্রপিতামহ ছিলেন দরবারী পন্ডিত। পিতা মহেশ্বর ছিলেন একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। এর পাশাপাশি অবশ্য মহেশ্বর নিজেও ছিলেন একজন গণিতবিদ ও জ্যেতির্বিদ্যায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভাস্করাচার্য পরিবারেই জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার একটা পরম্পরা ছিল বলেই তিনি নিজেও স্বাভাবিকভাবেই এই বিদ্যা চর্চার দিকে ঝুঁকেছিলেন। পরবর্তীকালে উজ্জয়িনীর মানমন্দির অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান হয়েছিলেন তিনি।  উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে বরাহমিহির এবং ব্রহ্মগুপ্তের মতো গণিতবিদেরা সেখানে কাজ করেছিলেন এবং গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার এক পরিসর তৈরি করে তুলেছিলেন৷ ভাস্করাচার্য এই দুই কিংবদন্তি গণিতজ্ঞের যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন।ব্রহ্মগুপ্তের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি গাণিতিক সমস্যা পেয়েছিলেন তিনি এমনকি ব্রহ্মগুপ্তের অনেক ফাঁকও পূরণ করেছিলেন।

এই সূত্রে আসা যাক ভাস্করাচার্যের গণিত চর্চার প্রসঙ্গে। তাঁর রচিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বিখ্যাত গণিতশাস্ত্র ছিল ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’। ১১৫০ সালে যখন এই গ্রন্থ তিনি রচনা করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৬ বছর। এই বইটির প্রথম অংশ ‘লীলাবতী’ রচনার পিছনের একটি ঘটনা বেশ প্রচলিত রয়েছে। ভাস্করাচার্য তাঁর কন্যা লীলাবতীর ভাগ্যগণনা করে দেখেছিলেন সেই মেয়ের বিবাহ হবে না এবং সে থাকবে সন্তানহীনা। কন্যার ভাগ্যপরিবর্তনের অভিপ্রায় নিয়ে বিশেষ মুহূর্তে বিবাহ দেওয়ার জন্য এক জলঘড়ি নির্মাণ করেছিলেন ভাস্করাচার্য। বিয়ের ঠিক পূর্বে কন্যার জলঘড়ি দেখবার ইচ্ছে হয় এবং তা দেখতে গিয়ে গলার গয়না থেকে একটি মুক্তো খুলে ঘড়িতে পড়ে গণনায় বিস্তর গরমিল হয়ে যায়। ভাস্করাচার্য বুঝতে পারেন নিয়তি খন্ডানো যাবে না। তখন মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই নাকি মেয়ের নামে গ্রন্থ লেখবার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। এভাবেই সিদ্ধান্ত শিরোমনি বইয়ের লীলাবতী ভাগটির জন্ম হয়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য লীলাবতীকে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ বলে থাকেন। এও এক বিতর্কের বিষয়। যদিও অনেক পন্ডিত আবার লীলাবতীকে ভাস্করাচার্যের কন্যা মনে করেন না, বরং স্ত্রী বলে থাকেন। এই নিয়েও অবশ্য বিস্তর মতভেদ রয়েছে।

এই ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’ গ্রন্থের চারটি অংশ হল – লীলাবতী, বীজগণিত, গ্রহগণিত এবং গোলাধ্যায়। বুঝতে পারা যাচ্ছে প্রথমদিকে গণিতের এবং পরেরদিকে জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা রয়েছে গ্রন্থটিতে।

‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’র প্রথম অংশ ‘লীলাবতী’তে শ্লোকের সংখ্যা মোট ২৭৭। এই অংশের তেরোটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে সংজ্ঞা, গাণিতিক পদ, সমতল জ্যামিতি, গাণিতিক এবং জ্যামিতিক অগ্রগতি ইত্যাদি নিয়ে। লীলাবতীর একটি মূল ভিত্তি হল পাটিগণিত। মূলত সংখ্যা নিয়ে নানারকম আলোচনা রয়েছে এখানে। এই ক্ষেত্রে পূর্বতন ব্রহ্মগুপ্তকে সামনে রাখেন তিনি, নেতিবাচক সংখ্যা জড়িত পাটিগণিতকে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। তিনি শূন্য সংযুক্ত করে যোগ, বিয়োগ, গুন করতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মগুপ্তের শূন্য দিয়ে ভাগ করবার যে আইডিয়া তাতে গলদ পেয়েছিলেন তিনি। আধুনিক গণিতবিদের মতে, আধুনিক শূন্যহীন অসীমের যে ধারণা তার মিল পাওয়া যাবে লীলাবতীতে উপস্থিত ভাস্করাচার্যের শূন্য সংক্রান্ত গণিতের সঙ্গে। লীলাবতীতে গুন করবার দুটি পদ্ধতি এবং বর্গক্ষেত্রের চারটি পদ্ধতির কথা বলেছিলেন তিনি। এছাড়াও উদাহরণসহ যৌগিক অনুপাতের নিয়মগুলি বুঝিয়েছিলেন। গণিতে দশমিক পদ্ধতির ব্যবহারও করেছিলেন তিনি।

পরবর্তী অংশ ‘বীজগণিত’-এর মোট বারেটি অধ্যায়। এখানে মোট শ্লোকের সংখ্যা ২১৩। এই অধ্যায়ে শূন্য ও অসীম, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যা, দ্বিঘাত সমীকরণ, সহজ সমীকরণ নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি পেলের সমীকরণের সমাধান করতে চেষ্টা করেন কুট্টক পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই বইতেই ভাস্করাচার্য দ্বারাই সম্ভবত প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল যে, একটি ধনাত্মক সংখ্যার দুটি বর্গমূল থাকে। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস কিংবা মাইনাস এবং প্লাসে মাইনাস, এই যে সূত্র, তার অনুমান করতে পেরেছিলেন ভাস্করাচার্য। এই বীজগণিতের মধ্যেই ব্রহ্মগুপ্তের শূন্য দিয়ে ভাগ করার পদ্ধতিকে উন্নত করতে চেষ্টা করেন তিনি। এখানে সসীম সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে এক অসীমের দেখা মেলে, সেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এই অর্থে, ভাস্করাচার্যের হাতেই তবে অসীমের ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল বলতে হবে। কিন্তু এ নিয়েও বিতর্ক আছে অবশ্যই। চক্রবালা পদ্ধতি ব্যবহার করে দ্বিঘাত সমীকরণকে ব্যাখা করেছিলেন ভাস্করাচার্য।

এছাড়াও ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’তে ত্রিকোণমিতি নিয়েও চর্চা লক্ষিত হয়। তিনি অন্যান্য আকর্ষণীয় ত্রিকোণমিতিক ফলাফলের সাথে গোলাকার ত্রিকোণমিতিও আবিষ্কার করেছিলেন। ত্রিকোণমিতির বিভিন্ন সাইনেরও জনক বলা যেতে পারে তাঁকে৷

‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’ কেবলমাত্র গণিতই নয়, গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্যও একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। মূলত শেষ দুটি অধ্যায় অর্থাৎ গণিতাধ্যায় বা গ্রহগণিত এবং গোলাধ্যায়ে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। উল্লেখ্য যে গ্রহগণিতে রয়েছে মোট ৪৫১টি এবং গোলাধ্যায়ে রয়েছে ৫০১টি শ্লোক। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে কত সময় লাগে পৃথিবীর, তার পরিমাপ করেছিলেন তিনি এই গ্রন্থে। এছাড়াও গ্রহগুলির গড় দ্রাঘিমাংশ এবং প্রকৃত দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়, গ্রহের অক্ষাংশ, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ, স্থির নক্ষত্রের সঙ্গে গ্রহের সংযোগ, পৃথিবীর পরিধি পরিমাপের পদ্ধতি ইত্যাদি নানারকম জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন তিনি৷ জ্যামিতি, পরিমিতি বিষয়েও উক্ত দুটি অধ্যায়ে আলোচনা রয়েছে। তিনি আরও দেখিয়েছিলেন যে, একটি গ্রহ সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে কিংবা সবচেয়ে নিকটে থাকলে, তখন একটি গ্রহের প্রকৃত অবস্থান এবং কেন্দ্রের সমীকরণ অনুযায়ী তার অবস্থানের মধ্যে যে পার্থক্য তা অদৃশ্য হয়ে যায়।

গোলাধ্যায় অংশের মধ্যে তিনি ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের ব্যবহার করে গ্রহদের গতির পরিমাপ করেছিলেন। এছাড়াও গোলাধ্যায়ের মধ্যে গোলকের প্রকৃতি, গ্রহের এককেন্দ্রিক এপিসাইক্লিক মডেল, গ্রহগুলির প্রথম দৃশ্যমানতা, আর্মিলারি গোলক, জ্যোতির্বিদ্যার যন্ত্র, ঋতু, জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনার সমস্যা ইত্যাদি বিষয়গুলির ওপর আলোকপাত করেছিলেন।

একটি আশ্চর্যের বিষয় হল, ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’ গ্রন্থের মধ্যে এমন একটি শ্লোকের দেখা মেলে যার অর্থ করলে তা থেকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অতএব নিউটনের প্রায় ৫০০ বছর আগেই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা বলে গিয়েছিলেন ভারতবর্ষের এই জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ। পন্ডিতরা এই বিষয়টি নিয়েও নানারকম চর্চা করেছেন এবং প্রথম মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিউটনের পাওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। এমনকি ক্যালকুলাস নিয়ে কাজ নিউটন এবং লাইবনিজের আগে করে গিয়েছিলেন ভাস্করাচার্য।

ভাস্করাচার্য আরও যে-কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে ছয়মাস দিন ও ছয়মাস রাত থাকে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে একটি শূন্যতা রয়েছে, চাঁদের একটি দিন পৃথিবীর ১৫টি দিনের সমান, পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ৯৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ইত্যাদি। এছাড়াও ভাস্করাচার্য সূর্যের আপাত কক্ষপথ এবং বুধ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের সময়কাল সঠিকভাবে গণনা করতে পেরেছিলেন।

অনেকে বলে থাকেন ভারতবর্ষে জন্মানো সর্বশেষ এত গুণী জ্যোতির্বিদ ছিলেন ভাস্করাচার্যই।

‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’ ছাড়াও ভাস্করাচার্য রচনা করেছিলেন ‘করণকুতুহল’ (জ্যোতির্বিদ্যার গণনা বিষয়ক বই), ‘বাসনাভাষ্য’ (‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি নিয়ে ভাস্করের নিজস্ব ভাষ্য), ‘সর্বতোভদ্র’, ‘বিবরণ’ (জ্যোতির্বিদ লাল্লার ‘শিশ্যাধিবিদ্ধিদাতন্ত্রে’র একটি ভাষ্য)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সব গ্রন্থ।

গবেষকেরা মনে করেন সম্ভবত উজ্জয়িনীতে ১১৮৫ সালে এই কিংবদন্তি গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ ভাস্করাচার্য বা দ্বিতীয় ভাস্করাচার্যের মৃত্যু হয়৷

আপনার মতামত জানান