বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহ (Buddhadeb Guha) বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল সাহিত্যিক যিনি মূলত তাঁর উপন্যাস বিশেষত অরণ্য অভিযান সংক্রান্ত উপন্যাসের কারণে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। তাঁর হাতে একই সাথে রোমান্স ও প্রকৃতি অনাবিল ভঙ্গিমায় সমন্বিত হয়েছে। তিনি যেমন করে আধুনিক জগতের মানুষের অন্তরের খবর দিয়েছেন, ঠিক তেমন ভাবেই জঙ্গলের বিভিন্ন রূপের অনুপম চিত্র এঁকে বাংলা সাহিত‍্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেও অত‍্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্য জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। সাহিত‍্যসাধনার পাশাপাশি বুদ্ধদেব গুহ সাঙ্গীতিক জগতেও অত্যন্ত দক্ষ। তিনি একাধারে সফল লেখক, সার্থক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অরণ‍্যপ্রেমিক, শিকারী এবং দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ।

১৯৩৬ সালের ২৯ জুন অধুনা বাংলাদেশের রঙপুর জেলায় বুদ্ধদেব গুহের জন্ম হয় । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রঙপুর জেলা স্কুলে সম্পন্ন হওয়ার পর যথাক্রমে তিনি রঙপুরের কারমাইকেল কলেজ ও কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাঁর পরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করেন। পড়াশোনার সাথে সাথে বুদ্ধদেব গুহ দক্ষিণ কলকাতার খ‍্যাতনামা গানের স্কুল ‘দক্ষিণী’তে ভর্তি হন। তার আগে থেকেই তিনি গানের চর্চা করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি পুরাতনী গান ও টপ্পাতেও তাঁর দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। দক্ষিণীতে গান শিখতে গিয়ে তাঁর আলাপ হয় বিখ্যাত গায়িকা ঋতু গুহের সঙ্গে। এই আলাপ লেখকের জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ১৯৬২ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের ব‍্যক্তিগত জীবন নিয়ে লেখকের উপন‍্যাস ‘খেলা যখন’ পাঠকমহলে অত্যন্ত সমাদৃত। তাঁদের দুই কন‍্যা আছে। বুদ্ধদেব গুহ এখনো তাঁর গানের চর্চা অব‍্যাহত রেখেছেন। তিনি এযাবৎ বহু অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন।

শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি নিয়ে পড়াশোনা করে তাঁর বাবার ব্রিটিশ আমলের ফার্ম এস এন গুহ অ্যান্ড কোম্পানিতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং পেশাগত দিক থেকে অত্যন্ত সফল হয়ে নিজেদের ফার্মকে অনেক উন্নত করে তুলতে সক্ষম হন তিনি। বুদ্ধদেব গুহের অরণ্য প্রবেশ মূলত তাঁর বাবার হাত ধরে। দশ বছর বয়স থেকে তিনি শিকার শুরু করেন। তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছেন কাজের সূত্রে এবং অরণ্য প্রেমে পড়ে। ইংল‍্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সবক’টি দেশ, আমেরিকা, কানাডা, হাওয়াই,জাপান, থাইল‍্যান্ড, পূর্ব আফ্রিকা সহ অজস্র দেশে তিনি ঘুরেছেন। তাঁর এই বিস্তীর্ণ ভ্রমণের নানাবিধ বর্ণনা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন‍্যাসে।

বুদ্ধদেব গুহের প্রথম গল্প সংকলন ‘জঙ্গল মহল’ প্রকাশ পায় ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। বাংলা সাহিত্যে অরণ‍্যের পটভূমিকায় তাঁর যত গল্প-উপন‍্যাস সৃষ্টি হয়েছে তা আর কোন লেখকের লেখায় দেখা যায়না। ভারতবর্ষ তথা বিদেশের অরণ‍্য প্রকৃতি লেখকের লেখার পটভূমি হিসাবে যেমন বারবার এসেছে, তেমনই কখনও কখনও অরণ‍্য নিজেই তাঁর উপন‍্যাসের চরিত্র হয়ে উঠেছে। সাধারণ ভাবে লেখকের ব‍্যক্তিজীবন বারবার ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর রচনায়। তাঁর বিখ্যাত ‘ঋজুদা’ সিরিজের প্রথম বই ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে ‘ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে অরণ‍্যপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ নাগরিক চেতনার আলোকে আলোকিত চরিত্ররা এসেছে। কিছু চরিত্র আবার অরণ্য প্রান্তরে পৌঁছে প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। এভাবেই চরিত্রের ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তিনি নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে বসাতে পেরেছেন অনায়াসেই।

পাঠককুলের বিচারে বোধহয় ‘মাধুকরী’ তাঁর সর্বোত্তম এবং জনপ্রিয়তম উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে – ‘হলুদ বসন্ত’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘কোজাগর’, চাপরাশ, বাতিঘর, নগ্ন নির্জন, বিন্যাস, খেলা যখন,ঝাঁকি দর্শন, জঙ্গলের জার্নাল, ‘বনবাসর’, ‘পারিধি’, ‘খেলাঘর’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘মাণ্ডুর রূপবতী’, ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’, ‘পঞ্চম প্রবাস’, ‘শাল ডুংরী’, ‘সারেং মিঞা’ বিখ্যাত। বুদ্ধদেব গুহের লেখার মধ্যে প্রকৃতি ও রোমান্স বারবার অনায়াস ভঙ্গিমায় মিলে গেছে। এক স্বপ্নিল বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে তাঁর চরিত্ররা ঘোরাফেরা করে– যার মধ্যে রোমান্টিক এক আবেদন সহজেই অনুভব করা যায়। তাঁর রচনা চিনিয়ে দেয় এক নিত্য পর্যটকের স্বভাবকে, ভ্রমণকারীর সৌন্দর্যের চোখকে এবং পথ দর্শনকে।

বুদ্ধদেব গুহের অন্যতম সৃষ্টি ‘ঋজুদা’। এই ঋজু চরিত্রটি কিন্তু অনেকাংশেই লেখক নিজে। ঋজুদা তাঁর সাথী রুদ্রকে নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় এবং রোমাঞ্চকর নানা অভিযানের সামিল হয়। ঋজুদা বাংলা সাহিত্যে এক অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র। ঋজুদার সঙ্গে বারেবারে পাঠককে তিনি নিয়ে গেছেন পূর্ব ভারতের নানা জঙ্গলে যেখানে রোমাঞ্চকর সব ঘটনার সাথে সাথে বিভিন্ন চরিত্রও ভিড় করেছে। ‘ঋভু’ নামের আরেকটি চরিত্র লেখক সৃষ্টি করেছেন যার মধ্যে দিয়ে লেখক তাঁর ছোটবেলায় ফিরতে চেয়েছেন। রঙপুর, জয়পুরহাট ও বরিশালের বন্ধুদের এই সূত্রে মনে করেছেন তিনি। ঋভুকে নিয়ে লেখা বইগুলি হল– ‘দূরের ভোর’, ‘দূরের দুপুর’, ‘পর্ণমোচী’, ‘পরিযায়ী’, ‘রিভুর শ্রাবণ’ ইত্যাদি।

ঋজুদাকে নিয়ে যেসব উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন সেগুলি হল,– ‘সপ্তম রিপু’, ‘তিন নম্বর’, ‘আরো তিন ঋজুদা কাহিনী’, ‘বনবিবির বনে’, ‘বাঘের মাংস এবং অন্য শিকার’, ‘মৌলির রাত’, ‘ঋজুদা কাহিনী’, ‘কুরুবকের দেশে’, ‘যমদুয়ার’, ‘ঋজুদা সমগ্র ১—৫ খন্ড’ ইত্যাদি। ‘মাধুকরী’ বুদ্ধদেব এর এক আলোড়ন তোলা উপন্যাস। এটি গতিশীল, বর্ণময় ও বিশাল। এই উপন্যাসটি শুধুমাত্র পৃথু ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প নয়, জঙ্গলমহলের শিকড় খোঁজা কিছু মানুষের কাহিনীও বটে। উপন‍্যাসের সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে বর্তমান মানব জীবনের সকল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন প্রজন্মের মানুষের বেঁচে থাকার ঠিকানা যেন দেয় ‘মাধুকরী’ উপন্যাসটি। বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী এই বইটির ভাষা, কাহিনী, জীবন দর্শন, জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মধ্যে লুকানো বিতৃষ্ণা– সবই যেন বাংলা সাহিত্যে নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে। লেখক প্রতিটি চরিত্রকে বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে দেখিয়েছেন কুশলতার সঙ্গে। ‘মাধুকরী’ যেন জীবনের নতুন ভাষ‍্যেরই নাম।

১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘হলুদ বসন্ত’– বুদ্ধদেব গুহের বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলির একটি। সমগ্র গল্প জুড়ে নয়না আর ঋজুর মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। নিবিড় ভালোবাসার সংরাগের সঙ্গে সঙ্গে হিংসা, ক্রোধ, যুক্তির সাথে মানসিক টানাপোড়েন ইত্যাদি বহুতর মানসিক প্রবৃত্তি একই সঙ্গে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।’ হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের পরে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বুদ্ধদেবের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘একটু উষ্ণতার জন‍্যে’। এক এডভোকেটের তথা এক লেখকের এর জীবনকে কেন্দ্র করে উপন্যাস এগিয়েছে। মূল চরিত্র সুকুমারের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। তাই সুকুমারের জীবনে আসে ছুটি,যে লেখকের প্রেমে ডুবে যায়। সুকুমারের জীবন চলতে থাকে এক অন্তহীন প্রতীক্ষায়। যে সমস্ত জিনিসের মূল্য তিনি আগে বুঝতেন, সেগুলো ধীরে ধীরে মূল্যহীন হয়ে পড়ে তার কাছে। কেমন করে তিনি নানাবিধ ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে পড়ে, নিজের জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেলেন, তারই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে তিনি পাঠককে এক গভীর অবসাদে জড়িয়ে ফেলেন। পাঠক এক নতুন আবেগে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে উপন্যাসটি পাঠ করে।

বুদ্ধদেব গুহের অরণ্য পর্যটন তাঁর অনুভূতিশীল মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছে। তাই আরণ্যক উপন্যাসগুলিতে লেখক যে নাগরিক চরিত্রগুলিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে অরণ্যে নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের নাগরিক সত্তা ছেড়ে অরণ‍্যের সাথে মিশে গেছে অনাবিল সারল্যে। লেখক অনেক সময়েই স্বেচ্ছায় মনেপ্রাণে আদিম হতে চেয়েছেন। তাই ‘কোজাগর’ উপন্যাসের বাঁশবাবু গাছের প্রেমে যেমন অনায়াসে জড়িয়ে পড়েন, তেমনিভাবেই অরন্যের বাসস্থানে যার কাছে তাঁকে থাকতে হয়, সেই রমণী তিতলির সঙ্গেও মিলিত হতে পারেন নির্দ্বিধায়। নারীতে এবং বৃক্ষে কোন পার্থক্য থাকে না। ‘খেলা যখন’ উপন্যাসটিতে লেখকের আপন জীবনের কথা ছড়িয়ে আছে। কেমন করে লেখক তারুণ‍্যের প্রেমময় জীবন কাটিয়েছেন তাই ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত। এমনিভাবেই তাঁর গল্প উপন্যাসগুলি লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বহু মণি-মাণিক্যের সমাহার। অরণ্যপ্রেমী ও অরণ্যচারী এই লেখক বাংলা সাহিত‍্যে জঙ্গলের অপরিচিত রূপটির সঙ্গে নিবিড় ভালোবাসাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আবার এমন করেই প্রতীকী উপন্যাস বা গোয়েন্দা উপন্যাসেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের পটভূমি জীবন্ত কারণ এগুলি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। বুদ্ধদেব গুহ হৃদয় দিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন তাই পাঠক মহলে তার অসংখ্য অনুরাগী।

বুদ্ধদেব গুহ তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য প্রচুর পুরস্কার লাভ করেছেন– আনন্দ পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার, শরৎ পুরস্কার তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য। কংগ্রেস লাইব্রেরীতে বুদ্ধদেব গুহের ৫০টিরও বেশী শিরোনাম রয়েছে।

২০২১ সালের ২৯ আগস্ট বুদ্ধদেব গুহর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান