মানুষের আবির্ভাবের ইতিহাস সম্পর্কিত আলোচনায় যাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটিয়েছিল, তিনি ইংরেজ প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইন (Charles Darwin)। বিবর্তনীয় জীব বিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর চিন্তা এবং তত্ত্বের কারণে বিজ্ঞানী মহলে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। তিনি যথোপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সহযোগে দেখিয়েছিলেন যে মানুষ, জীবজন্তু ইত্যাদি সমস্ত প্রজাতিই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ বা বংশ থেকে উদ্ভূত। সমস্ত প্রজাতির বিবর্তনের প্রক্রিয়া যে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িত ডারউইনের এই তত্ত্বটিও সমগ্র বিজ্ঞান মহলে সাদরে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন, যে সমস্ত জীবের বৈশিষ্ট্য তাদের পরিবেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, তাদেরই পুনরুৎপাদন এবং বেঁচে থাকবার সম্ভাবনা বেশি এই বিশ্বপ্রকৃতিতে। ডারউইন একাধারে ছিলেন একজন ভূতাত্ত্বিক এবং জীববিজ্ঞানী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে তিনি বহু ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবাশ্ম ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন। সেই সংগৃহীত উপাদানগুলির বিশ্লেষণাত্মক গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে চেয়েছিলেন সমস্ত প্রজাতির উদ্ভবসূত্র এবং বিবর্তনের ধারাটিকে। তাঁর লিখিত যে গ্রন্থটি আধুনিক পশ্চিমি সমাজ, বলা ভালো সমগ্র বিশ্বের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তার নাম ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’।
১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারের অন্তর্গত শ্রুসবারিতে ‘দ্য মাউন্ট’ নামক বাড়িতে চার্লস ডারউইনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা রবার্ট ডারউইন (Robert Darwin) ছিলেন ইংল্যান্ডের ধনী সম্প্রদায়ের একজন চিকিৎসক এবং একাধারে একজন পুঁজি লগ্নিকারী (Financier) এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সুসান্না ডারউইন (Susannah Darwin)। তাঁদের মোট ছয় সন্তানের মধ্যে ডারউইন ছিলেন পঞ্চম। তাঁর পিতামহ ইরাসমাস ডারউইন নিজে একজন চিকিৎসক ও কবি ছিলেন। ১৮০৯ সালের নভেম্বর মাসে শ্রুশবারির সেন্ট চাড’স গির্জায় ডারউইনের বাপ্তিস্ম (Baptism) সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৮৩৯ সালে তিনি তাঁর দূর সম্পর্কের এক খুড়তুতো বোন এমা ওয়েজউডকে (Emma Wedgwood) বিবাহ করেন এবং তাঁদের মোট দশটি সন্তান জন্ম নেয়। মাঝে মাঝেই নানাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তেন ডারউইন। এই অসুস্থতার কারণে স্টাফোর্ডশায়ারে থাকাকালীনই এমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল তাঁর।
১৮১৭ সালে যখন ডারউইন একটি ডে স্কুলে ভর্তি হন, তখন থেকেই প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে তাঁর। সেই আট বছর বয়সেই, ১৮১৭ সালের জুলাইতে মায়ের মৃত্যু হলে ডারউইনকে তাঁর বড় তিন দিদি মানুষ করে তোলেন। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮১৮ সালে অগ্রজ ইরাসমাসের সঙ্গে বোর্ডার হিসেবে নিকটবর্তী শ্রুশবারির অ্যাংলিকান স্কুলে ভর্তি হন চার্লস ডারউইন। এই স্কুলে প্রাচীন গ্রিক এবং লাতিনকে কেন্দ্র করে যে ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হত, তিনি তা অপছন্দ করতেন। একজন গৃহশিক্ষকের কাছে জ্যামিতির পাঠ গ্রহণ করতেন ডারউইন এবং তা উপভোগও করতেন। এর পাশাপাশি অল্পবয়স থেকেই তিনি তাঁর বাবার সূক্ষ্ম চিকিৎসাকর্ম গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতেন, ফলে ধীরে ধীরে মানব মনস্তত্ত্ব ও শারীর-সংস্থান সম্পর্কেও তাঁর কৌতূহল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮২৫ সাল পর্যন্ত বোর্ডিং স্কুলে পড়েন চার্লস ডারউইন, তারপর সে বছরই অক্টোবর মাসে তাঁর বাবা তাঁকে এবং ইরাসমাসকে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য পাঠিয়ে দেন ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ মেডিক্যাল স্কুলে। সেখানে যাওয়ার আগে ডারউইন তাঁর বাবাকে শ্রুপশায়ারের দরিদ্রদের চিকিৎসার কাজে সাহায্য করেছিলেন। ডাক্তারি অধ্যয়ন করতে গিয়ে অধ্যাপকদের বক্তৃতা তাঁর কাছে নিস্প্রাণ বলে মনে হয়, এমনকি অস্ত্রোপচার শিক্ষাও কষ্টদায়ক বোধ হয় তাঁর কাছে। ফলে ডাক্তারি পড়ায় অবহেলা করে সে সময় ডারউইন দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টি-অরণ্যে প্রকৃতিবিদ চার্লস ওয়াটারটনের সহযোগী একজন মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ দাস জন এডমোনস্টোনের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ট্যাক্সিডার্মি বা প্রাণীদেহ সংরক্ষণের কাজ শেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রদের প্রাকৃতিক ইতিহাস চর্চার দল ‘প্লিনিয়ান সোসাইটি’তে যোগ দেন তিনি। এসময় রবার্ট এডমন্ড গ্রান্টের সঙ্গে ফার্থ অফ ফোর্থ উপকুলে সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবনচক্র সংক্রান্ত অনুসন্ধানে সহায়তা করেছিলেন চার্লস ডারউইন এবং ১৮২৭ সালের ২৭ মার্চ প্লিনিয়ানে নিজের আবিষ্কার হিসেব তিনি বিশ্লেষণ করেন যে, ঝিনুকের খোলায় থাকা কালো বীজগুটি বা স্পোরগুলি আসলে রক্তচোষা জোঁকের ডিম। এসময় গাছপালার শ্রেণিবিভাগও শেখেন তিনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামের জন্য সংগ্রহের কাজে সাহায্য করেন।
চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করে ডারউইনের বাবা তাঁকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে পাঠিয়ে দেন ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য। সেখানে ব্যাচেলার অফ আর্টসের অন্তর্ভুক্ত হন ডারউইন, যে কোর্স সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে পারলে পাদ্রির পদ অর্জন করতে সক্ষম হতেন ডারউইন। কিন্তু ধর্মীয় পঠন-পাঠনের তুলনায় কেমব্রিজে শ্যুটিং ও অশ্বারোহণ করে এবং পারিবারিক ভ্রাতা উইলিয়াম ডারউন ফক্সের সঙ্গে বিটল পোকা সংগ্রহ করে বেড়াতেন তিনি। সেই সময় উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক জন স্টিভেন হেনস্লোর সঙ্গে পরিচয় হয় ডারউইনের এবং তাঁর প্রাকৃতিক ইতিহাসের কোর্সে যোগ দেন তিনি। ১৮৩১ সালের জানুয়ারিতে ফাইনাল পরীক্ষায় ধর্মতত্ত্বে ভালো ফল করেছিলেন তিনি। তাছাড়াও গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং ধ্রুপদী বিষয়ে দারুণ ফলাফল করে ১৭৮ জন কৃতকার্যের মধ্যে দশম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন চার্লস ডারউইন।
আলেকজান্ডার ভন হ্যামবোল্টের ‘পার্সোনাল ন্যারেটিভ’ গ্রন্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য মাদেইরা যাওয়ার পরিকল্পনা করেন ডারউইন। এই প্রকল্পের প্রস্তুতির জন্য রেভারেন্ড অ্যাডাম সেডগুইকের ভূতত্ত্বের কোর্সে যোগ দেন তিনি। গ্রীষ্মাবকাশে তাঁর সঙ্গে ডারউইন ওয়েলসের মানচিত্র নির্মাণের কাজও করেছিলেন। ১৮৩১ সালেই অধ্যাপক হেনস্লো একটি চিঠির মাধ্যমে এইচএমএস বিগল (HMS Beagle) জাহাজের বিশ্বব্যাপী সমুদ্রযাত্রায় ডারউইনকে একজন প্রকৃতিবিদ হিসেবে ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিটজরয়ের সঙ্গীরূপে গ্রহণ করবার প্রস্তাব করেন। এই সুযোগ ডারউইন হাতছাড়া করেননি। যদিও প্রকৃতিবিদ নয়, বরং রবার্ট ফিটজরয় একজন ভদ্রলোক সহচর চেয়েছিলেন এবং ডারউইন সেই স্থান পূরণের সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। এই সমুদ্রযাত্রায় যদিও তাঁর বাবার আপত্তি ছিল। ১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর এইচএমএস বিগল দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে বৈজ্ঞানিক অভিযান শুরু করে। প্রায় পাঁচ বছর এই অভিযান চলেছিল। এই দীর্ঘ পাঁচ বছর ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহেই মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। অনভ্যস্ত সমুদ্রযাত্রায় ভীষণ শারীরিক অসুস্থতা ভোগ করা সত্ত্বেও প্রচুর নোট লিখেছিলেন তিনি এবং বহু উদ্ভিদ, প্রাণীর জীবাশ্ম সংগ্রহ করেছিলেন।
কেপ ভার্দের সেন্ট জাগো উপকূলে প্রথম নোঙর করেন তাঁরা। এরপর ব্রাজিলে পৌঁছে গ্রীষ্মন্ডলীয় বনভূমি তাঁকে আনন্দ দেয়। কিন্তু সেখানকার দাস প্রথাকে ঘৃণা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তিনি। বাহিয়া ব্লাঙ্কায় তাঁরা আবার থামেন এবং পুন্টা আলটার নিকটে সমুদ্রের পাশে বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্মের হাড়ের সন্ধান পান। এই আবিষ্কার ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। ভূতত্ত্ব অন্বেষণ এবং আরও জীবাশ্মের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন তাঁরা। তবে লায়েলের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত ছিলেন ডারউইন। লায়েলের ধারণার উপর ভিত্তি করেই দক্ষিণ আমেরিকার ভূতত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির দ্বীপ, প্রবাল প্রাচীরের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। জীবাশ্ম সংগ্রহ এবং সেই সংক্রান্ত নোট নেওয়ার পাশাপাশি সংগৃহীত উপাদানগুলির স্কেচ নেওয়াও শুরু করেন তিনি। ১৮৩৫ সালে চিলিতে একটি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হন চার্লস ডারউইন। আন্দিজের উচ্চতায় ঝিনুক এবং বালির সৈকতে বেড়ে ওঠা বেশ কিছু জীবাশ্ম গাছও দেখেছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়েই তিনি একটি নতুন তত্ত্ব দেন যে, ভূমি উত্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাসাগরীয় দ্বীপগুলি ডুবে গিয়েছিল। বিগল জাহাজটি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ কাটিয়েছিল। সেই সময়ে, ডারউইন একাধিক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যা প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর নতুন তত্ত্বগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। সেই দ্বীপপুঞ্জে ‘ফিঞ্চ’ নামক গায়ক পাখি এবং কচ্ছপদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বিভিন্ন প্রজাতির জীবের বিবর্তনের সঙ্গে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন জড়িয়ে আছে তা বুঝতে পারেন। এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার নানা অভিজ্ঞতা এবং তাঁর সংগ্রহের বিবরণ একটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন ডারউইন। এই ডায়েরি থেকেই পরবর্তীকালে বিখ্যাত বই ‘জার্নাল অফ রিসার্চেস’ (১৮৩৯)-এর জন্ম হয়। বইটির শিরোনাম পরে পাল্টে হয়েছিল ‘ভয়েজ অফ দ্য বিগল’।
১৮৩৬ সালের ২ অক্টোবর বিগল জাহাজ ফিরে আসে। ডারউইন তাঁর সংগৃহীত আধুনিক উদ্ভিদের উপর কাজ করবার জন্য হেনস্লোকে রাজি করান এবং তাঁর সংগ্রহগুলি সময়মতো প্রকাশের জন্য ভালো প্রকৃতিবিদের সন্ধানে লন্ডনের প্রতিষ্ঠানে যান। ১৮৩৭ সালের ৪ জানুয়ারি লন্ডনের জিওলজিকাল সোসাইটিতে ডারউইন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র পাঠ করেন। সেদিনই তিনি তাঁর স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখির নমুনা সেই সোসাইটিতে জমা দেন। ১৮৩৮ সালে তাঁর সম্পাদিত পাঁচ খন্ডে সম্পূর্ণ ‘জুওলজি অফ দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল’ গ্রন্থের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। সেখানে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের রচনা তো ছিলই, তার পাশাপাশি তিনি নিজেও প্রাণীদের প্রজাতির বন্টন এবং জীবাশ্ম সম্পর্কিত ভূতাত্ত্বিক নোটগুলি সম্পর্কে লিখেছিলেন। ১৮৩৮ সালে জনসংখ্যার নীতির উপর ম্যালথাসের একটি প্রবন্ধ পাঠ করার ফলে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও পরিমার্জিত হয়। ১৮৩৮ সালে জিওলজিকাল সোসাইটির সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করেন চার্লস ডারউইন।
১৮৪০-৫০-এর দশকে একজন প্রকৃতিবিদ হিসেবে খ্যাতি বৃদ্ধি পেলেও প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে ধারণাগুলি প্রথমে প্রকাশ করেননি ডারউইন। ১৮৪২ সালে প্রবাল প্রাচীর গঠনের তত্ত্ব নিয়ে ‘দ্য স্ট্রাকচার অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অফ কোরাল রিফস’ নামক তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৪৬ সালে তাঁর তৃতীয় ভূতাত্ত্বিক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে বহু প্রকৃতিবিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং আরও বিস্তৃত গবেষণার জন্য সময় নিয়েছিলেন। ১৮৪৭ সালে ডারউইনের এই সৃষ্টির ক্রিয়াকলাপের ক্রমাগত বিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হুকার। ১৮৫৪ সালে ‘লিনিয়ান সোসাইটি অফ লন্ডন’-এর সদস্য হন চার্লস ডারউইন। লিয়েল যখন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের গবেষণাপত্র পড়ে ডারউইনের সঙ্গে মিল পান, তখন ডারউইনকে তাঁর তত্ত্ব রচনা এবং প্রকাশ করতে আহ্বান জানান। ১৮৫৬ সালে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ নামে একটি খসড়া তৈরি করেন ডারউইন, কিন্তু তা প্রকাশ করেননি তিনি। ১৮৫৮ সালে ওয়ালেসের কাছ থেকে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন সংক্রান্ত একটি লেখা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হুকার এবং লিয়েলের উদ্যোগে ১৮৫৮ সালে ডারউইন ও ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব যৌথভাবে প্রকাশিত হয় লিনিয়ান সোসাইটি থেকে। কিন্তু ডারউইন এককভাবে এই তত্ত্বের ওপর একটি বড় গ্রন্থ রচনা করলেন এবং ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ নামের সেই বিখ্যাত বইটি। প্রকাশ হওয়ার পরপরই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এই বই। কিন্তু পাশাপাশি বহু সমালোচনা এবং প্রত্যাখানেরও সম্মুখীন হতে হয় গ্রন্থটিকে। রিচার্ড ওয়েনের মতো কিছু মানুষ তাঁর তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ডারউইনবাদ বিবর্তনবাদী ধারণার পরিসরে এক আন্দোলনে পরিণত হয়।
এরপর ডারউইন মানুষের বংশগতি বিষয়ক তাঁর চিন্তা প্রকাশ করেন ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য ভেরিয়েশন অফ অ্যানিমেলস্ অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’ গ্রন্থে। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’ গ্রন্থে তিনি আলোচনা করেন যৌন নির্বাচন বিষয়ে এবং দেখান মানুষের বিবর্তন প্রক্রিয়া অন্যান্য জীবের মতোই। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিমালস’ গ্রন্থে মানুষের মনোবিজ্ঞানের বিবর্তন এবং প্রাণীদের আচরণের সাথে এর ধারাবাহিকতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তিনি। ১৮৮১ সালে তাঁর শেষ বই ‘দ্য ফর্মেশন অফ ভেজিটেবল মোল্ড থ্রু দ্য অ্যাকশন অফ ওয়ার্মস, উইথ অবজারভেশনস অন দেয়ার হ্যাবিটস’-এ কেঁচোর আচরণ ও বাস্তুশাস্ত্র বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন ডারউইন।
বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অবদানের জন্য চার্লস ডারউইন ‘রয়্যাল মেডেল’ (১৮৫৩), ‘ওলাস্টন মেডেল’ (১৮৫৯), ‘কোপলে মেডেল’ (১৮৬৪) ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ইংল্যান্ডে নিজের বাড়ি ডাউন হাউসে করোনারি থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে চার্লস ডারউইনের মৃত্যু হয়।
2 comments