চারু মজুমদার (Charu Majumdar) একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি নকশালপন্থী ও বামপন্থী নেতা। ষাট দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের প্রথমে বাংলার নকশাল আন্দোলনে তিনি অন্যতম মুখ ছিলেন।
১৯১৯ সালের ১৫ মে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় হাগুরিয়া গ্রামে চারু মজুমদারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা বীরেশ্বর মজুমদার কংগ্রেসের দার্জিলিং জেলা কমিটির সভাপতি ও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর মা উমাশঙ্করী দেবী ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী এবং তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন তিনি। তাঁদের আদি বাড়ি শিলিগুড়িতে।
চারু মজুমদারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় শিলিগুড়ি বয়েজ হাইস্কুলে। ১৯৩৩ সালে তিনি সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে (Pubna Edward College) আই এ (IA) পড়তে ভর্তি হয়েও শেষ সাম্যবাদী ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখাপড়া ত্যাগ করে জলপাইগুড়ি জেলার তেভাগা আন্দোলনে যোগদান করেন।
১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে (Communist Party of India, CPI) যোগদান করে দ্রুতই তিনি পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। জলপাইগুড়ির জেলা সম্পাদক শচীন দাশগুপ্তের সাথে তিনি সেই জেলার নানান প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের কথা শোনেন। তাঁরা গরিব চাষীদের ঘরে আশ্রয় নিতেন এবং যখন যা পেতেন তাই খেতেন। সেই সময় কখনো খোলা আকাশের নীচে, কখনো জলঢাকা নদী ব্রিজের উপর, আবার কখনো বা গোয়ালঘরেও তাঁদের থাকতে হয়েছে। এই ভাবেই যেকোনো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে এবং কৃষকদের সাথে একাত্ম হতে তিনি শিখেছিলেন। এই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে বাধ্য হয়ে তাঁকে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হয়।
১৯৩৯ সাল নাগাদ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তিনি এবং তাঁর দলীয় কর্মীরা পার্টির কাজ চালিয়ে যান গোপনে। ১৯৪২ সালে তাঁকে জলপাইগুড়ি জেলার সিপিআই কমিটির সর্বক্ষণের সদস্য করা হয় এবং ক্রমশই তিনি কৃষক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার প্রতিবাদ করে সিপিআই পার্টি যখন কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে নিপীড়িত কৃষকরা তাঁদের ওপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। চারু মজুমদার অত্যন্ত দ্রুত কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর সাথে কৃষকদের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাঁর প্রতিটা কথা কৃষকদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ এবং প্রভাবিত করত। তিনি কৃষকদের সমস্যার কথা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন। ১৯৪২ সাল পরবর্তী সময়ে চা-বাগান ও রেল-শ্রমিকদের সাথেও তিনি সহজে মিশে গেছিলেন।
১৯৪৫ সালে তেভাগা আন্দোলন শুরু হলে চারু মজুমদারকে এই পচাগড় কেন্দ্র থেকে এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হয়। এই সময়ে মূলত আত্মগোপনে ছিলেন। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর পরিচালনায় বিশাল একটি অঞ্চল প্রায় মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এই সময় তিনি যে সমস্ত মূল্যবান শিক্ষা পান তা পরবর্তীকালে তাঁকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানে সাহায্য করে। এরপর পুলিশের অমানবিক অত্যাচার অগ্রাহ্য করে সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। যখন সিপিআই পার্টি কর্মীরা শ্রমিক ও কৃষকদের সম্মিলিত আন্দোলনকে সমস্ত বাধা বিপত্তি পার করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই পার্টির রাজ্য কমিটি আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তিনি এবং স্থানীয় অন্যান্য নেতৃবর্গ পিছু হটতে অস্বীকার করেন। রাজ্য কমিটি ম্যানডেট (mandate) জারি করে এবং দার্জিলিঙের কমরেডদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর কাছে সেটা একটা বড় মানসিক ধাক্কা ছিল। ১৯৪৮ সালে পার্টি অফিস থেকে পুলিশ তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। তাঁকে প্রথমে জলপাইগুড়ি জেলে আটক রাখা হয়। এরপর তাঁকে দমদম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে তাঁকে দমদম থেকে সরাসরি বক্সার জেলে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৫১ সালে তিনি মুক্তি পান।
১৯৫২ সালের ৯ জানুয়ারি চারু মজুমদারের সাথে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী লীলা সেনগুপ্তের বিয়ে হয়। তাঁদের দুটি সন্তান। বিয়ের পর তাঁরা দুজনেই সিপিআই দার্জিলিং জেলা কমিটির সদস্য হন। সেই সময় তিনি গ্রামাঞ্চলে কাজ করার সাথে সাথে চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যেও কাজ করতেন। তিনি শিলিগুড়ি রিক্সাচালক ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পালঘাটে অনুষ্ঠিত সিপিআই এর তৃতীয় অধিবেশনের তিনি অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন। সেই সময় থেকেই সিপিআই নেতাদের সাথে তাঁর বিরোধ বাড়তে শুরু করে। ১৯৫৭ সালে পার্টি নেতৃত্ব তাঁকে কলকাতায় যাওয়ার আহ্বান জানায় এবং রাজ্য স্তরে কৃষক সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দিতে চাইলেও তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সময় তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।
১৯৬০ সালের শুরুতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংয়ের দুটি নির্দিষ্ট এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে দলিল প্রস্তুতের দায়িত্ব চারু মজুমদারের উপর বর্তায় এবং তিনি নকশালবাড়ি এলাকায় দলের সমস্ত কার্যাবলী পরিচালনা করতে শুরু করেন।
চারু মজুমদার বহুবার কারাবরণ করেছিলেন। বন্দী দশায় থাকাকালীন তিনি নিজেকে গভীর অধ্যয়নে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৬ জুলাই ১৯৭২ সালে শেষবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কলকাতার লালবাজারের লক-আপে’জিজ্ঞাসাবাদের করাকালীন তাঁর ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা সত্ত্বেও তিনি কোন গোপন তথ্য পুলিশের কাছে ফাঁস করেননি।
তাঁকে বহুবার কারাবন্দি থাকতে হয়েছে। বন্দি জীবনকে তিনি গভীর অধ্যয়নের কাজে লাগাতেন। ১৬ জুলাই ১৯৭২ শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত আত্মগোপন করে বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কলকাতার কুখ্যাত লালবাজার লক-আপে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ সময় তাঁকে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। কিন্তু কোনো স্বীকারোক্তি বা কোন গোপন তথ্য তাঁর কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারেনি।
চারু মজুমদারের ১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই ভোর ৪টের সময় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। পুলিশ তাঁর দেহ তাঁর পরিবারের নিকটতম সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গোপনে সৎকার করে। শ্মশানের সমস্ত এলাকা পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়।
জন্মের শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও তিনি আজও বাংলার মানুষের কাছে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর আদর্শ এখনও মানুষকে সমানভাবে অনুপ্রাণিত করে।
One comment