ডেলো পাহাড় ভ্রমণ

ডেলো পাহাড় ভ্রমণ

পাহাড়ে ঘুরতে কার না ভালো লাগে আর সেই পাহাড় যদি বাঙালি চিরচেনা ছকের বাইরে একটু অন্যত্র হয় তাহলে ভ্রমণের মজাটা আরও বেড়ে যায়। বাঙালিদের কাছে পাহাড় বলতে যে চিরকালীন গন্তব্য দার্জিলিং সেই পছন্দটা একটু একটু করে বদলাচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বহু মানুষ এখন উত্তরোত্তর অনাবিষ্কৃত পর্যটনকেন্দ্রগুলি খুঁজে বের করার রোমাঞ্চকর নেশায় মেতে ওঠে আর ঠিক তাদের জন্যেই সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে দার্জিলিংয়ের অনতিদূরে কালিম্পং-এ ডেলো পাহাড় । পাহাড় হলেও এ যেন এক ভিন্ন স্বাদের ঠিকানা। রেলি উপত্যকা আর উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণি আর কিছুটা সিকিমের পাহাড়চূড়া কিংবা তিস্তা নদীর অপরূপ সুন্দর ধারা দুই চোখ ভরে দেখার অভিজ্ঞতা পেতে ডেলো পাহাড় এক আদর্শ জায়গা। কালিম্পং-এ বেড়াতে এসে এই মনোরম পার্বত্য প্রকৃতিকে একবার দেখে নেওয়াই যায়।

সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৫৬০০ ফুট উচ্চতায় কালিম্পং-এর সর্বোচ্চ স্থান এই ডেলো পাহাড় । ভৌগোলিকভাবে কালিম্পং-এর ঠিক উত্তর-পূর্বদিকে এই ডেলো পাহাড় রয়েছে। ডেলো পাহাড় আর দুরপিনদারা পাহাড় এরই মাঝে কালিম্পং অবস্থিত। ডেলো পাহাড়ের উত্তরে সিকিম, পূর্বে ভুটান, দক্ষিণে জলপাইগুড়ি এবং পশ্চিমদিকে রয়েছে দার্জিলিং। দার্জিলিং থেকে ডেলো পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ৫৮ কিলোমিটার।

শৈলশহর কালিম্পং এমনিতেই অনবদ্য সুন্দর। পার্বত্য প্রকৃতির মাঝে অজস্র নাম না জানা বুনো ফুলের বাহার মনকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। পাহাড় আর মেঘের খেলা দেখতে দেখতে কখন যে বেলা গড়িয়ে যায় সে কথা খেয়ালই থাকে না। রেলি উপত্যকার ছোটো ছোটো গ্রাম, তিস্তা নদীর অবিরাম খরস্রোতে বয়ে চলা নিজে চোখে দেখার আনন্দই যেন আলাদা। ডেলো পাহাড়ের উপর উঠলে পশ্চিম সিকিমের বরফে ঢাকা পাহাড়গুলিও খুব সহজে চোখে পড়ে। ও যেন আরেক স্বপ্নের দেশ। কত জায়গা থেকেই না আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে ভালোবাসি, ডেলো পাহাড়ও তার ব্যতিক্রম হবে না। বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহের মধ্যে উঁচু উঁচু রডোডেন্ড্রন গাছ কিংবা হলুদ, নীল বুনো কোনো ফুল নিমেষে মন ভুলিয়ে দিতে পারে। সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের কাছে ডেলো পাহাড়ের অসীম নীল আকাশে সাদা মেঘই যথেষ্ট।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ট্রেনে করে আসতে গেলে অবশ্যই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে খুব সহজেই ডেলো পাহাড়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং-এ পৌঁছানোর জন্য ট্যাক্সিভাড়া মোটামুটিভাবে ৫০০-৬০০ টাকা এবং সেখান থেকে আবারও ট্যাক্সি রিজার্ভ করে পুরো কালিম্পং ঘুরে দেখার পাশাপাশি ডেলো পাহাড়ও ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। আর যদি কেউ নিজস্ব গাড়িতে সরাসরি ডেলো পাহাড়ে পৌঁছাতে চায়, সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি-সিকিম ও কালিম্পং যোগাযোগকারী ১০ নং সড়ক ধরে সোজা চলে আসা যাবে ডেলো পাহাড়ে। বাসে বা গাড়িতে মোটামুটিভাবে কালিম্পং টাউন থেকে ডেলো পাহাড় ১০ কিলোমিটারের রাস্তা। আকাশপথে বিমানে চড়ে আসার ক্ষেত্রে কাছাকাছি বিমানবন্দর হল বাগডোগরা। বাসে করে আসার ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে প্রতিদিনই যে শিলিগুড়িগামী বাস ছাড়ে সেগুলি ধরতে হবে। প্রায় ১২ ঘন্টা সময়ে শিলিগুড়ি এবং সেখান থেকে আরো সাড়ে তিন ঘন্টা মতো সময় পরে কালিম্পংয়ের ডেলো পাহাড়ে পৌঁছানো সম্ভব। তবে ট্রেনে এলে ভ্রমণের আনন্দ আরেকটু বেড়ে যায় বলেই মনে হয়।

ডেলো পাহাড় যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়াই সুবিধেজনক হবে কারণ এতে ভোরবেলা বা খুব সকালবেলাই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। ফলে একটা সুন্দর সোনালি সকালের প্রায় বেশিরভাগ সময়টাই উপভোগ করতে পারবেন।

ডেলো পাহাড়ের কাছাকাছি থাকার জায়গা বলতে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল পরিচালিত একটি ট্যুরিস্ট লজ আছে যা খুবই জনপ্রিয় স্থানীয় এলাকার মধ্যে। মোটামুটিভাবে এই লজের ভাড়া ডবল বেডের ঘরের জন্য ২১০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত। এখানে থাকতে চাইলে লজটির ছবির মতো মনোরম পরিবেশের কারণে প্রবল চাহিদা থাকে, তাই এক মাস আগে থেকে বুকিং করে রাখা ভালো। তবে চাইলে কালিম্পং-এও থেকে যাওয়া যায়। ডেলো পাহাড়ের তুলনায় কালিম্পং-এ হোটেলের সংখ্যা বেশি। কালিম্পং-এর হোটেলগুলির ভাড়া মোটামুটিভাবে ৭০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। হোটেল বা হোমস্টে যেখানেই থাকা হোক না কেন, খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত আছে কিনা খোঁজ নিয়ে তবেই বুক করবেন। হোটেল বুকিংয়ের ক্ষেত্রে এক মাস আগে থেকে বুক করে রাখাই ভালো। ঘুরতে এসে বুকিং পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।

ডেলো পাহাড়ে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে প্রথমেই পড়ে চারদিকের পার্বত্য প্রকৃতিকে মন ভরে দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন। এই পয়েন্ট থেকে আশেপাশের প্রকৃতির পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। তাছাড়া রয়েছে –

· ডেলো পার্ক – এই মনোরম উদ্যানের মধ্যে রয়েছে কিছু বাংলো, হরেকরকমের বাহারি রঙিন ফুলের বাগান, বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। এখানে এসে ঘোড়ায় চড়া বা প্যারাগ্লাইডিং করতে পারেন আগ্রহী পর্যটকরা। প্যারাগ্লাইডিং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যাপার, ফলে সাবধানতা অবলম্বন করা সর্বাগ্রে জরুরি। প্যারাগ্লাইডিং-এর খরচ মরশুমে অনেক বেশি থাকে।

· সায়েন্স সেন্টার – ডেলো পাহাড়ে ওঠার মুখেই রয়েছে এই সায়েন্স সেন্টার যা ঘুরে দেখাই যায়। তবে এই সায়েন্স সেন্টার সোমবার বন্ধ থাকে।

একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নীচে তিস্তার বয়ে যাওয়া একত্রে দেখার অভিজ্ঞতা কেবলমাত্র ডেলো পাহাড়ে এলেই সম্ভব। পিকনিক স্পট হিসেবে এই পাহাড় অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাহাড়ের ট্রেইল ধরে ডেলোতে ওঠার সময় নীচে তিস্তার বয়ে চলা দেখতে পারেন কিছুক্ষণ। ভিড় থেকে দূরে কিছুক্ষণ একা নির্জনে কাটাতে চাইলে ডেলো পার্কের মধ্যে কিছু বেঞ্চ আছে সেখানে বসে সামনে তুষারবৃত পর্তশ্রেণির দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন ঘন্টাখানেক। আর সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে মুক্ত বিশুদ্ধ অক্সিজেন তো আছেই।

সাইটসিইং-এর মধ্যে পড়বে কালিম্পং-এর থোংসা গুম্ফা, শেরপা ভিউ পয়েন্ট, থারপা চোলিং মঠ, ম্যাকফার্লেন চার্চ, স্যার গ্রাহামস হোম কিংবা পাইন ভিউ নার্সারির ক্যাকটাসের সমারোহ। বাঙালি হলে কালিম্পং-এর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সেই গৌরীপুর টেগোর হাউজ দেখার জন্য প্রাণটা আঁকু-পাঁকু করবে। কালিম্পং শহরের কাছে হওয়ায় ডেলো পাহাড় থেকে এখানে যেতে অনেকটা পথ পেরোতে হবে গাড়িতে। এছাড়া দেখে আসা যায় মর্গ্যানস হোম বা হনুমান মন্দির। ডেলো পাহাড় থেকে এগুলি খুব বেশি দূরে নয়, ভাড়ার গাড়ি করে আলাদা আলাদাভাবে বা গাড়ি রিজার্ভ করে কালিম্পং-এর বেশ কিছু জায়গা ঘুরে নেওয়া যায়। এখানে বলে রাখা ভালো কালিম্পং-এ হোম স্টে ভাড়া করে থাকলে সেখানকার নিজস্ব গাড়ির বন্দোবস্ত থাকে সাইটসিইং-এর জন্য। ডেলো পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যে সময়ই আসুন না কেন, সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে রাখা অবশ্যই দরকার। এখানে কাছেপিঠে ওষুধের দোকান প্রায় নেই বললেই চলে। বর্ষাকালে না এলেও সঙ্গে ছাতা রাখা দরকার। মাঝেমধ্যে উড়ো মেঘে দু-এক পশলা হাল্কা বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকেই। তাছাড়া যদি গাড়ি রিজার্ভ করে ঘুরতে চান, সেক্ষেত্রে আগেভাগে ভাড়া স্থির করে তবেই ওঠা উচিত।

সারা বছরই এখানকার আবহাওয়া থাকে মনোরম ও উপভোগ্য। তবে মার্চ মাস থেকে জুন মাস এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এলে এখানকার পরিবেশের আনন্দ উপভোগ করা যায় সবথেকে বেশি। তবে বর্ষাকালে না আসাই ভালো।

ডেলো পাহাড়ে কেনাকাটা করার কোনো সুযোগ নেই একেবারেই। তবে নিতান্ত উৎসুক হলে কালিম্পং-এর তিস্তা বাজারে যাওয়া যেতে পারে কেনাকাটা করার জন্য।

ট্রিপ টিপস –

কীভাবে যাবেন – ট্রেনে এলে প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে ভাড়ার গাড়ি বা ট্যাক্সি করে কালিম্পং

এবং সেখান থেকে আবার একইভাবে গাড়িতে চেপে ডেলো পাহাড়। বাসে এলে শিলিগুড়িতে নেমে সেখান থেকে নতুন বাস বা গাড়ি ধরতে হবে কালিম্পং-এর জন্য।

কোথায় থাকবেন – ডেলো পাহাড়ের উপরে থাকার জন্য একটি ট্যুরিস্ট লজ আছে। এছাড়া কালিম্পং-এ যে

কোনো হোম স্টে বা হোটেলেও থাকা যায়। স্থানবিশেষে ঘরভাড়া মোটামুটিভাবে ৭০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।

কি দেখবেন – ডেলো পার্ক, সায়েন্স সেন্টার, থোংসা গুম্ফা, শেরপা ভিউ পয়েন্ট, থারপা চোলিং মঠ, ম্যাকফার্লেন

চার্চ, স্যার গ্রাহামস হোম কিংবা পাইন ভিউ নার্সারি, গৌরীপুর হাউজ, মর্গ্যানস হোম ইত্যাদি। এর সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং তিস্তা নদীর সৌন্দর্য তো রয়েইছে।

কখন যাবেন – মার্চ থেকে জুন মাস এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস আদর্শ সময়। বর্ষাকাল এড়িয়ে চলাই

ভালো।

সতর্কতা – হোটেল আগে থেকে বুকিং করে আসা উচিত। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখা দরকার। গাড়ি

রিজার্ভ করে ঘোরার ক্ষেত্রে ভাড়া আগে থেকে স্থির করে নিতে হবে।

বিশেষ পরামর্শ – রাতের ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি এলে দিনের অনেকটা সময় উপভোগ করা যায় পাহাড়ি

পরিবেশ।

আপনার মতামত জানান