বাঁকুড়া পুরুলিয়ার পাঁচটি জনপ্রিয় পাহাড়

বাঁকুড়া পুরুলিয়ার পাঁচটি জনপ্রিয় পাহাড়

ভৌগোলিক দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে মরুভূমি ছাড়া প্রায় সবই আছে। উত্তরে দার্জিলিং বা ডুয়ার্স থেকে শুরু করে দক্ষিণে সুন্দরবন বা বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত, কী নেই এখানে! পাহাড় থেকে জঙ্গল, নদী থেকে সমুদ্র, ঐতিহাসিক স্থান থেকে ধর্মস্থান সবকিছু দেখতে পাওয়া যায় এই বাংলায়। যে কারণে তাকে ভারতের ছোট সংস্করণ বলাই যায়। উত্তরবঙ্গের পাহাড় ছাড়াও বাঁকুড়া পুরুলিয়া জুড়ে রয়েছে অজস্র ছোট বড় পাহাড়। গরমে এখানের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেশি থাকে, তবে বসন্তকালে এখানে পলাশের ছোঁয়ায় সেই পাহাড়েরা লাল হয়ে ওঠে, আবার বর্ষাকালে সবুজের রূপ নেয়। সেই সমস্ত পাহাড়গুলোর মধ্যে থেকে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার পাঁচটি জনপ্রিয় পাহাড় নিয়ে এখানে আলোচনা করা হল। এই জায়গাগুলোতে কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এইসব বিস্তারিত জানতে উল্লিখিত লিঙ্কে ক্লিক করুন।

প্রথম পাহাড়ের মাথা তেকে তোলা দৃশ্য
শুশুনিয়া পাহাড়ের প্রথম ধাপ থেকে তোলা দৃশ্য। ছবি সববাংলায়

শুশুনিয়া পাহাড় (বাঁকুড়া) – শুশুনিয়া পাহাড় পর্যটক বা পর্বতারোহীদের অন্যতম সেরা পছন্দের মধ্যে পড়ে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শিলালিপিটি এই পাহাড়েই অবস্থিত। ইতিহাসবিদদের মতে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে চন্দ্রবর্মণ তাঁর শিলালিপি পাহাড়ের বুকে লিখে রাখেন। মনে করা হয় এটিই বাংলার প্রাচীন শিলালিপি।পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে এই শিলালিপি সংরক্ষিতও করা হয়েছে। এই শিলালিপি বা বিভিন্ন প্রাচীন জীবাশ্ম থাকার ফলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছেও এই জায়গার গুরুত্ব অপরিসীম। পাহাড়ের নিচে ঝর্ণার মুখে একটি প্রাচীন এক পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখা যায়। সেই ঝর্ণার উৎস নাকি আজও অজানা। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই ঝর্ণায় স্নান করলে আপনার শরীর-মন দুই ভাল হয়ে যাবে, আবার এই ঝর্ণার জল পান করলে আপনার হজম এর সমস্ত সমস্যা দূর হয়ে যাবে। পাহাড়ের তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম পাহাড় ওঠার পর উপর থেকে চারিদিকে সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তারপর দ্বিতীয় পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রাস্তা চলে গেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আপনি ইচ্ছা করলে সারা দিনই এই পাহাড়ে ট্রেকিং করতে পারবেন তবে সঙ্গে গাইড রাখা সুবিধাজনক।

ট্রেনে যেতে হলে ছাতনা স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে বাস বা অটো করে একেবারে শুশুনিয়া পাহাড়। রাতে থাকবার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলের থেকে মানুষেরা রাতে থাকার জন্য এলেও বাঁকুড়া বা সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি পিকনিক স্পট হিসেবে বেশি জনপ্রিয়। পাহাড়ের পাথর নিয়ে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে বিখ্যাত প্রস্তরশিল্প। যে শিল্পের কদর শুধু বাংলা নয়, তার খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশে। রয়েছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রস্তরশিল্পীও। তাদের থেকে কেনাকাটা করতে পারেন। শুশুনিয়া পাহাড় ভ্রমণের খুঁটিনাটি পড়ুন এখানে

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিহারীনাথ মন্দিরের শিবলিঙ্গ। ছবি সববাংলায়

বিহারীনাথ পাহাড় (বাঁকুড়া) – বাঁকুড়া জেলার সর্বোচ্চ পাহাড় বিহারীনাথ পাহাড়। এই পাহাড়কে পশ্চিমবঙ্গের আরাকু ভ্যালি বলা হয়। এই পাহাড় এখনও আদিম রূপে আছে এবং ঘন জঙ্গলে ঘেরা। সবুজে ঘেরা এই পাহাড়ে অনেকরকম বিরল প্রাণীর বাস। পাহাড়ের নিচে আছে বিখ্যাত বিহারীনাথ মন্দির। বিহারীনাথ ধাম নামেই এই মন্দির প্রসিদ্ধ। এখানে শিবের নাম বিহারীনাথ এবং তাঁর নামেই এই পাহাড়ের নামকরণ। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে এই বিহারীনাথের শিবলিঙ্গটি এখানের রাজা স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন।

ট্রেনে করে বিহারীনাথ পাহাড়ে যাওয়ার জন্য আসানসোল থেকে মধুকুণ্ড রেল স্টেশনে যেতে হবে। অথবা আসানসোল থেকে ট্রেনে করে রানীগঞ্জ গিয়েও ভাড়া করা গাড়ি করে বিহারীনাথ যাওয়া যায়। রাত্রিযাপনের জন্য কয়েকটি হোটেল রয়েছে। কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলের থেকে মানুষেরা রাত্রিযাপনের জন্য এলেও বাঁকুড়া বা সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি পিকনিক স্পট হিসেবে বেশি জনপ্রিয়। বিহারীনাথ পাহাড় ভ্রমণের খুঁটিনাটি পড়ুন এখানে

অযোধ্যার ময়ূর পাহাড়। ছবি ইন্টারনেট

অযোধ্যা পাহাড় (পুরুলিয়া) – এটি পুরুলিয়া জেলার অন্যতম বিখ্যাত ভ্রমণস্থান এবং এখানের সবচেয়ে বড় পাহাড়শ্রেণী যা পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি সম্প্রসারিত অংশ। অযোধ্যা পাহাড়ের গড় উচ্চতা প্রায় ২০০০ ফুট আর পাহাড়ের মাথাটি প্রায় সমতল। জনশ্রুতি আছে যে স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র এই পাহাড়ে এসেছিলেন। সীতার তৃষ্ণা পেলে শ্রীরামচন্দ্র তীর ছুঁড়ে পাহাড়ের বুক চিরে বের করেন জল। হিলটপের কাছে সেই জায়গাটি এখন সীতাকুন্ড নামে পরিচিত। মাটির ভেতর থেকে অবিরাম জলের ধারা এই কুণ্ডে এসে পরে। গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড গরমে নলকূপ ও জলের অন্যান্য উৎসগুলিতে জল না পাওয়া গেলেও এই সীতাকুণ্ডে জল পাওয়া যায়। অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার জন্য অনেকগুলি ট্রেকিং রুট বা গ্রাম্য রাস্তা থাকলেও প্রধান প্রবেশদ্বার দুইটি। সিরকাবাদ, যেটি পুরুলিয়া শহরের দিক থেকে আসতে গেলে পরে। আর বরাভূম স্টেশনের দিক দিয়ে এলে বাঘমুন্ডি। শাল, সেগুন পলাশের বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা একে বেঁকে উঠে গেছে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। অযোধ্যার অরণ্যে এখনও চিতা বাঘ, হায়না, জংলী কুকুর, বুনো শুয়োরের মতো বন্যপ্রাণীর দেখা পাওয়া যেতে পারে।

ট্রেনে করে অযোধ্যা পাহাড় যাওয়ার জন্য সুবিধেজনক নামবার স্টেশন হলো বরাভূম বা পুরুলিয়া। থাকবার জন্য এখানে অনেক হোটেল রয়েছে। গরমকাল বাদ দিয়ে যে কোনো সময় যেতে পারেন। যদি লাল পলাশ ফুল দেখতে চান তাহলে মার্চে যেতে হবে। অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণের খুঁটিনাটি পড়ুন এখানে

কাছ থেকে গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি- কৃষ্ণাশিষ রায়
গড়পঞ্চকোট গড় । ছবি সববাংলায়

পঞ্চকোট পাহাড় (পুরুলিয়া) – পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গড়পঞ্চকোট পুরুলিয়ার একটি সুন্দর গন্তব্য। এটি ছিল পুরাতন রাজাদের দুর্গ। ‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী গোষ্ঠীর সর্দারদের সাহায্যে পঞ্চকোটের প্রথম রাজা দামোদর শেখর তাঁর রাজত্ব গড়ে তোলেন। সেই থেকেই এই জায়গার নাম গড়পঞ্চকোট। এই রাজার উত্তরসূরীরাই ছোট বড় মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। সেই মন্দিরগুলো ধ্বংস হয় মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে। পঞ্চকোট পাহাড়ে থাকা গড়পঞ্চকোট দূর্গের কোনও চিহ্ন এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলো, ওয়াচ টাওয়ার, রানি মহল এইসব ঘুরে দেখলে এখনও এক উজ্জ্বল ইতিহাস মনে স্থান পাবে। পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে গোটা এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। শাল, পিয়াল, মহুল, হরিতকি থেকে নানারকম বনৌষধি গাছগাছড়ায় সমৃদ্ধ এই পাহাড়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে এখানে আসতেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা। পাখি এবং প্রজাপতির পাশাপাশি গড়পঞ্চকোটের জঙ্গলে প্রচুর ময়াল ও পাইথনও রয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে হায়না এবং অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়।

ট্রেনে যেতে চাইলে গড়পঞ্চকোটের নিকটবর্তী স্টেশন হল পশ্চিম বর্ধমানের বরাকর। গড়পঞ্চকোটে থাকার মধ্যে আছে কিছু সরকারি বাংলো, লজ ও গুটি কয়েক প্রাইভেট লজ। পঞ্চকোট পাহাড় তথা গড়পঞ্চকোট ভ্রমণের খুঁটিনাটি পড়ুন এখানে

জয়চন্ডী পাহাড়। ছবি সববাংলায়

জয়চণ্ডী পাহাড় (পুরুলিয়া) – জয়চণ্ডী পাহাড় পুরুলিয়ার একটি পাহাড়ি স্থান যা জনপ্রিয় হয়ে যায় ১৯৭৮ সালে সত্যজিৎ রায় তাঁর হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটির শুটিং করার পর থেকে। এখানে সেই দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল, যেখানে উদয়ন পন্ডিত একটি পাহাড়ের গুহায় লুকিয়েছিল। তারপর তার সাথে গুপী ও বাঘার সাক্ষাৎ। পাহাড়ের সামনে গেলেই চোখের সামনে আজও ভেসে উঠবে গুপি বাঘার ভোজন দৃশ্য অথবা উদয়ন পন্ডিতের সঙ্গে গুপি বাঘার প্রথম দেখা হওয়ার সেই দৃশ্যটি। পাহাড়ের ওপর রয়েছে মা চণ্ডীর মন্দির। বলা হয় এই মন্দির থেকেই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। এই পাহাড় ছোট নাগপুর মালভূমির অংশ। পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৮০০ ফুট। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর বা বোল্ডার। তারই মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রধান তিনটি পাহাড়। জয়চন্ডী, দক্ষিণাকালী বা কালী পাহাড়, এবং যুগঢাল। এর মধ্যে জয়চন্ডী পাহাড়েই ওঠার রাস্তা রয়েছে।

ট্রেনে করে জয়চন্ডী পাহাড় যাওয়ার জন্য বর্তমানে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশন তৈরি হয়েছে। আগে আদ্রা স্টেশন থেকে যেতে হত। জয়চন্ডী পাহাড়ে থাকবার খুব বেশি হোটেল নেই। বসন্তকালে গেলে পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলে লাল পলাশের রঙ দেখতে পাওয়া যাবে। জয়চণ্ডী পাহাড় ভ্রমণের খুঁটিনাটি পড়ুন এখানে

এই পাঁচটি পাহাড় ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য পাহাড় বা ভ্রমণস্থান নিয়ে জানতে এখানে পড়ুন


সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব সংকলন

আপনার মতামত জানান