ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট

ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস যেসব প্রতিভাবান রাজনীতিবিদের অবদানে এবং কৃতিত্বে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (Franklin D. Roosevelt)। আমেরিকার ৩২তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি এবং আমৃত্যু এই পদেই বহাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ করেছিলেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হিসেবে তিনি দুইয়ের বেশি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তাছাড়া নিউইয়র্ক স্টেট সেনেটের নির্বাচনে জিতেছেন, নিউইয়র্কের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন এবং উড্রো উইলসনের অধীনে নৌবাহিনীর সহকারী সচিব হিসেবেও কাজ করেছিলেন রুজভেল্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়ে তিনি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচির প্রবর্তন করেন। ‘নিউ ডিল’ নামে পরিচিত তাঁর একাধিক কর্মসূচি ও সংস্কারের মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেন তিনি। কৃষি সামঞ্জস্য আইনের মাধ্যমে রুজভেল্ট যেমন কৃষকদের ত্রাণ প্রদান করেছিলেন, তেমনি অর্থ, যোগাযোগ এবং শ্রম সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্কার সাধনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। পন্ডিতদের মতে দেশের তিনজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতির মধ্যে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ছিলেন অন্যতম।

১৮৮২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিউইয়র্কের হাইড পার্কের হাডসন ভ্যালি শহরে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের জন্ম হয়। তাঁর পরিবার মোটামুটিভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। রুজভেল্টের বাবা জেমস রুজভেল্ট (James Roosevelt) ছিলেন একজন জমির মালিক ও একাধারে একজন সফল ব্যবসায়ী। ফ্রাঙ্কলিনের মা সারা অ্যান ডেলানো (Sara Ann Delano) ছিলেন জেমস রুজভেল্টের দ্বিতীয় পত্নী। যখন ফ্রাঙ্কলিনের জন্ম হয়, তখন তাঁর মায়ের বয়স সাতাশ বছর। রুজভেল্টের জীবনে তাঁর মায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। জন্মের পর থেকেই সারা তাঁর সন্তানকে সবসময় প্রায় নজরে নজরে রাখতেন বলা চলে। মাত্র দুই বছর বয়স থেকে এবং পরবর্তীতে সাত থেকে পনের বছর সময়কালের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ইউরোপ ভ্রমণে সামিল হতেন রুজভেল্ট। এই ভ্রমণের ফলেই জার্মান এবং ফরাসি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন তিনি। হার্ভার্ডে পড়াকালীন তিনি থিওডোর রুজভেল্টের ভাগ্নী এলেনর রুজভেল্টের (Eleanor Roosevelt) সঙ্গে পরিচিত হন এবং প্রেম-পরিণয়ে আবদ্ধ হন। ১৯০৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন প্রস্তাব দেন তাঁকে এবং ১৯০৫ সালের ১৭ মার্চ তাঁরা বিবাহ করেন। এলেনর এবং ফ্রাঙ্কলিনের মোট ছয়টি সন্তানের জন্ম হয়। তাঁদের দ্বিতীয় পুত্রটি শৈশবেই মারা গিয়েছিল। রুজভেল্ট একটি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন এলেনরের সেক্রেটারি লুসি মার্সারের সঙ্গে। এই সম্পর্কের ফলে এলেনর তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য একটি পৃথক বাসস্থানে বসবাস করতেন। রুজভেল্টের পুত্ররা পরে দাবি করেছিল আরও বিভিন্ন মহিলার সঙ্গেই তাঁদের বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।

নয় বছর বয়সে জার্মানিতে পাবলিক স্কুলে কিছু সময়ের জন্য ভর্তি হলেও মূলত ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর ম্যাসাচুসেটসের গ্রোটনে অবস্থিত বিশপের অধিকারভুক্ত বোর্ডিং স্কুল গ্রোটন-এ ভর্তি করা হয় তাঁকে। যদিও বিদ্যালয়ে তিনি খুব জনপ্রিয় ছাত্র ছিলেন না। খেলাধুলা করলেও তাতে খুব ভাল ছিলেন না তিনি। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এন্ডিকট পিবডি তাঁর জীবনে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেন। এরপর তাঁর বেশিরভাগ স্কুল সহপাঠীর মত তিনিও হার্ভার্ড কলেজে প্রবেশ করেন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। সেখানে তিনি আলফা ডেল্টা ফি এবং ফ্লাই ক্লাবের সদস্য ছিলেন। এখানে থাকাকালীন রুজভেল্ট ‘দ্য হার্ভার্ড ক্রিমসন’ নামক দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এটি এমন একটি পদ যার জন্য অন্যদের পরিচালনা করার ক্ষমতা প্রয়োজন ছিল। রুজভেল্ট তা সফলভাবেই করতে পেরেছিলেন। ১৯০০ সালে বাবার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তী বছর তাঁর পরিবারেরই একজন থিওডোর রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হন। থিওডোরের জোরালো নেতৃত্ব এবং জনহিতকর সংস্কারের উদ্যোগ দেখে ফ্রাঙ্কলিন তাঁকে নিজের রোল মডেল হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন মনে মনে। ১৯০৩ সালে হার্ভার্ড কলেজ থেকে ইতিহাসে এ. বি সহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ১৯০৪ সালে কলম্বিয়া ল স্কুলে প্রবেশ করেন তিনি আইন অধ্যয়নের জন্য কিন্তু এই পড়াশোনায় খুব বেশি আগ্রহ ছিল না তাঁর। ১৯০৭ সালে নিউইয়র্ক বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলম্বিয়া ল স্কুল পরিত্যাগ করেন এবং পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯০৮ সালে কার্টার লেডইয়ার্ড অ্যান্ড মিলবার্নের মর্যাদাপূর্ণ আইন সংস্থায় চাকরি নেন ও ফার্মের অ্যাডমিরালটি আইন বিভাগে কাজ করতে থাকেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আইনের অনুশীলন করতে একেবারেই ভাল লাগত না রুজভেল্টের। তার বদলে, রাজনীতি তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত। অবশেষে নিজের বাবার মতই রুজভেল্টও ডেমোক্রেটিক দলে যোগদান করেন এবং এই দলের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নিয়োগ করা হয়। এরপর ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট রাজ্য সিনেটের একটি আসনের জন্য লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ডাচেস, কলম্বিয়া এবং পুটনামে অবস্থিত সিনেট জেলাটি দৃঢ়ভাবে রিপাবলিকান ছিল। রুজভেল্ট আশঙ্কা করেছিলেন থিওডোরের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের জন্য খারাপ হতে পারে, যদিও থিওডোর তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ব্যাপক প্রচারের ফলে হাডসন উপত্যকায় তাঁর নাম পরিচিতি লাভ করে ও ১৯১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের সদস্য হিসেবে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯১২ সালে টাইফয়েড জ্বরে কাবু হয়ে, সাংবাদিক লুই ম্যাকহেনরি হাওয়ের সহায়তায়  স্টেট সেনেটে পুনঃনির্বাচিত হন রুজভেল্ট এবং ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী উড্রো উইলসনকে সমর্থন করেন। এই সমর্থনের পুরস্কার হিসেবে উইলসন তাঁকে ১৯১৩ সালে নৌ-বাহিনীর সহকারি সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এই পদে থাকাকালীন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নৌ-বাহিনীর প্রতি এমনিতেও ভীষণ অনুরাগ ছিল তাঁর। একটি বৃহৎ দক্ষ বাহিনী গঠনের দিকে মনোযোগ দেন তিনি। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট নৌ-বাহিনীর বেসামরিক কর্মচারীদের তত্ত্বাবধান করতেন এবং যে কোনও বিরোধের ন্যায্য মীমাংসা করবার জন্য ইউনিয়ন নেতাদের সম্মানও অর্জন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ‘কাউন্সিল অফ ন্যাশনাল ডিফেন্স’ প্রতিষ্ঠা করতেও সহায়তা করেছিলেন। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি।

১৯২০ সালেই ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট রাষ্ট্রপতি মনোনীত জেমস এম কক্সের সঙ্গে একটি টিকিটেই ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য মনোনয়ন পান। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকান ওয়ারেন. জি. হার্ডিং এবং ক্যালভিন কুলিজের কাছে পরাজিত হয়। রুজভেল্ট তারপরে একটি বন্ডিং কোম্পানি, ফিডেলিটি অ্যান্ড ডিপোজিট কোম্পানি অফ মেরিল্যান্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে প্রবেশ করেন।

১৯২১ সালে রুজভেল্ট যখন কানাডার ক্যাম্পোবেলো দ্বীপে ছুটিতে ছিলেন তখন পোলিওমাইলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর জীবন বদলে যায়। ভীষণ ভুগেছিলেন তিনি এই রোগে এবং কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও এই পক্ষাঘাতের পরে তিনি নিজের পায়ের ব্যবহারিক সক্ষমতা আর ফিরে পাননি। পরবর্তীকালে পোলিও রোগে ভুক্তভোগী রুজভেল্ট অন্যান্য পোলিও আক্রান্তদের সাহায্য করবার জন্য জর্জিয়ার ওয়ার্ম স্প্রিংসে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, এছাড়াও ১৯৩৮ সালে তিনি ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইনফ্যান্টাইল প্যারালাইসিস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মার্চ অফ ডাইমস প্রোগ্রামকে অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি পোলিওর একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য অর্থায়ন করেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। সেসময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাঁর চলার অক্ষমতা যেন প্রকাশ্যে না আসে।

স্ত্রী এলেনর এবং রাজনৈতিক আস্থাভাজন লুই হাওয়ের উৎসাহ ও সাহায্যে রুজভেল্ট পুনরায় রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২৪ সালে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে নিউইয়র্কের গভর্নর আলফ্রেড ইমানুয়েল স্মিথকে রাষ্ট্রপতি পদের মনোনয়নের জন্য সমর্থন করে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে স্মিথ রুজভেল্টকে টাকোনিক স্টেট পার্ক কমিশনে নিযুক্ত করেছিল। তাঁর সহযোগী কমিশনাররা রুজভেল্টকে চেয়ারম্যান হিসেবে বেছে নেয়। ১৯২৮ সালে স্মিথ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনীত হন এবং সে বছরই রুজভেল্টের জন্য নিউইয়র্কের গভর্নর পদের মনোনয়নের ব্যবস্থা করেন। স্মিথকে হারিয়ে হার্বার্ট হুভার রাষ্ট্রপতি হলেও ১৯২৮ সালে নিউইয়র্কের গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। 

১৯২৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মহামন্দার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। এসময় রুজভেল্ট বেশ কিছু ত্রাণ এবং পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ বাস্তবায়িত করেন। এসময় রাষ্ট্রীয় কর্মসংস্থান কমিশনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বেকারত্ব বীমা, বয়স্কদের জন্য পেনশন, বিশাল পাবলিক ওয়ার্ক প্রকল্প, ইত্যাদি তাঁকে এক উদার সংস্কারক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে এবং মহামন্দার এইরূপ মোকাবিলা ১৯৩০ সালে পুনরায় তাঁকে গভর্নর হিসেবে পুনর্নিবাচিত করেছিল। ১৯৩১ সালে তিনি হিউইট সংশোধনীর মাধ্যমে পুনর্বনায়নকে (Reforestation) সমর্থন করেছিলেন যা নিউইয়র্কে রাজ্য বন ব্যবস্থার জন্ম দেয়।

১৯৩২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রুজভেল্ট জাতীয় রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন। হাওয়ে এবং ফারলির নেতৃত্বে একটি প্রচারাভিযান দল গঠন করেন এবং নীতিউপদেষ্টাদের একটি দলও তৈরি করেন যাঁ মূলত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সমন্বয়ে গঠিত। জনসমক্ষে বক্তৃতায় তিনি আমেরিকার অধিবাসীদের কাছে একটি ‘নিউ ডিল’ বা ‘নতুন চুক্তি’র অঙ্গীকার করেছিলেন। রুজভেল্ট জনপ্রিয় ভোটের ৫৭ শতাংশ লাভ করেন। মূলত ছোট কৃষক, দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ, শ্রমিক ইউনিয়ন, ক্যাথলিক, উত্তর আফ্রিকান-আমেরিকান, ইহুদী, বুদ্ধিজীবি প্রভৃতির সমর্থনেই রাষ্ট্রপতির পদ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন রুজভেল্ট।
১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিউসেপ জাঙ্গারা নামে একজন তাঁকে হত্যার চেষ্টা করলেও তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

যখন দেশের শাসনভার তিনি গ্রহণ করেন, অর্থনৈতিক মন্দার জেরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা তখন বেজায় খারাপ। শ্রম-শক্তির এক চতুর্থাংশ ছিল বেকার। শিল্পোৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছিল। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো ও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন রুজভেল্ট। তিনি চারদিনের ব্যাঙ্ক ছুটি ঘোষণা করেছিলেন আমানতকারীদের তহবিল উত্তোলন করতে চাওয়া বন্ধ করার জন্য। জরুরি ব্যাঙ্কিং আইন জারি করা হয়েছিল যার ফলে রাষ্ট্রপতির হাতে ব্যাঙ্ক খোলা এবং বন্ধের নিয়ন্ত্রণ থাকে। নিউ ডিলের অন্তর্গত একটি ত্রাণ কর্মসূচি ছিল সিভিলিয়ান কনজারভেশন কর্পস যা গ্রামীণ প্রকল্পগুলিতে কাজের জন্য ২৫ হাজার বেকার পুরুষ নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিল। রেলপথ এবং শিল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এগ্রিকালচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্মসূচির সূচনা করেছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। গ্লাস-টেগাল আইনের দ্বারা অর্থনৈতিক আইন সংস্কারের চেষ্টা করেন রুজভেল্ট। ‘নিউ ডিল’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য ১৪টি আইনে স্বাক্ষর করেন তিনি। রুজভেল্ট আমেরিকার ইতিহাসের বৃহত্তম সরকারি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান টেনেসি ভ্যালি অথরিটি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এটি বাঁধ ও পাওয়ার স্টেশন তৈরি করেছিল, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষির আধুনিকীকরণ করেছিল। মুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলার জন্য এক্সিকিউটিভ অর্ডার ৬১০২ ঘোষণা করেন রুজভেল্ট। তাঁর প্রবর্তিত সামাজিক বীমা কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিল, বয়স্ক, দরিদ্র ও অসুস্থদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শিশু শ্রমকেও বেআইনি ঘোষণা করেন তিনি। এছাড়াও জাতীয় উদ্যানের সম্প্রসারণ, জাতীয় বন ব্যবস্থার প্রচলনেরও কান্ডারি ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট।

১৯৩৯-এ শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রুজভেল্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি ভেবেছিলেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে দূরে রাখবেন, যতক্ষণ না বাইরের আঁচ এসে পড়ে তার গায়ে। কিন্তু ব্রিটেন, চিন, ফ্রান্স প্রভৃতি জার্মানি এবং ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দেশগুলিকে সাহায্য করতে থাকেন রুজভেল্ট। অবশেষে জাপান ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে আক্রমণ করলে রুজভেল্ট তাঁর নীতি পরিবর্তন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মহাজোট তৈরিতে অগ্রসর হন।

অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল স্ট্রোকের ফলে ৬৩ বছর বয়সে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান