ফুল্লরা

সতীপীঠ ফুল্লরা ।। সতীপীঠ অট্টহাস

সতীপীঠ অট্টহাস বা ফুল্লরা মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। মতান্তরে এই পীঠকে উপপীঠ বলেও উল্লেখ করা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী ফুল্লরা এবং ভৈরব হলেন বিশ্বেশ। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় ফুল্লরা মেলাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত মায়ের দর্শন পেতে ছুটে আসে। অনেকের মতে আবার অট্টহাস মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার লাভপুরের কাছে দক্ষিণডিহি গ্রামে অবস্থিত।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় ফুল্লরা মন্দিরে সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল। তন্ত্রচূড়ামণি এবং শিবচরিতে ফুল্লরাকে উপপীঠ হিসাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু শিবসংহিতা অনুসারে ফুল্লরা হল মহাপীঠ। কারও মতে অট্টহাস সতীপীঠ বর্ধমানে অবস্থিত।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে কৃষ্ণানন্দ গিরি কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটে ঈশ্বরসাধনা করতেন। এক মাঘীপূর্ণিমায় তিনি লাভপুরে এসে মা ফুল্লরাকে দেবী দুর্গারূপে পূজা করার জন্য স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মায়ের আদেশে তিনি দুর্গম পথ পেরিয়ে মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে এসে দেবীর পূজা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি মাঘীপূর্ণিমায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বলে এই সময় দশ-বারোদিনব্যাপী মেলা হয় এখানে।

ফুল্লরাকে নিয়ে গবেষক প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী ৭৪২ সালে বেদগর্ভ তৎকালীন বঙ্গাধিপতি আদিশুরের কাছ থেকে বটগ্রাম পেয়েছিলেন। তার পুত্র বশিষ্ট পেয়েছিলেন সিদ্ধলগ্রাম, যা বর্তমানে শীতলগ্রাম। বশিষ্ট এর পুত্র অট্টহাসই হলেন এই সতীপীঠের প্রথম সাধক এবং তার নামেই বর্তমান লাভপুরের নাম হয়েছিল অট্টহাস। অট্টহাসের উত্তরসূরিরাই দেবীর পূজার দায়িত্ব ও মন্দির দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আনুমানিক ১১৭৯ সালে অট্টহাসের বংশধর ভবদেব ভট্ট কয়েক জন ব্রাহ্মণকে দেবী ফুল্লরার পূজারি রূপে নিয়োগ করেন। তখন থেকে শুরু হয় দেবীর নিত্যপূজা। এর প্রায় দুই শতক পরে এই ব্রাহ্মণদের বংশধর দিনমণি মিশ্র বাহাদুরের আমলেই প্রাচীন ফুল্লরা মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান মন্দিরটি ১৮৯৫ সালে বা ১৩০২ বঙ্গাব্দে যাদব লাল বন্দ্যোপাধ্যায় নির্মাণ করান।

প্রধান মন্দিরের সামনে বড় মঞ্চ। সামনে দুটো শিব মন্দির সিঁড়ি নেমে গেছে দিঘিতে। এই দিঘির নাম দেবীদহ বা দলদলি। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে যখন শ্রী রাম দুর্গাপূজার আয়োজন করছিলেন, তখন হনুমান এই দিঘি থেকে একশো আট পদ্ম তুলে এনেছিলেন। প্রতিদিন দেবীর অন্নভোগে থাকে ভাত, ডাল, তরকারী, মাছের টক। আগে দেবীর অন্নভোগে শিয়ালকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল। সেই জন্য আছে শিবাভোগ বেদী। বলা হয় আগে এখানে রূপী আর সুপী নামে দুটি শেয়াল ছিল। তবে এখন আর শিয়ালেরা আসে না। মন্দিরের ভেতরে পঞ্চমুন্ডির আসন রয়েছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মায়ের হাঁড়িকাঠের মাটি চর্মরোগের অবসান ঘটায়, বিশেষ করে শ্বেতী।

মন্দিরের ভিতরে মায়ের শিলাখন্ডটি অনেকটা ওষ্ঠাকৃতির। এই শিলার রঙ টুকটুকে লাল। আলাদা করে দেবীর কোন বিগ্রহ এখানে নেই।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এখানে সতীর রূপ হলেন ফুল্লরা এবং ভৈরব হলেন বিশ্বেশ।

প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় এখানে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৩রা ফাল্গুন প্রথম মেলা বসেছিল। এই মেলা বীরভূম জেলার অন্যতম প্রাচীন ও বড় মেলা। এই মেলা দশ থেকে বারোদিন অবধি হয়। সেইসময় কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এখানে।

তথ্যসূত্র


  1. একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৭, লাভপুরে ফুল্লরা তীর্থে
  2. https://www.templepurohit.com/
  3. https://thewall.in/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. https://www.janadarpan.in/

আপনার মতামত জানান