গম্ভীর সিং মুড়া (Gambhir Singh Mura) একজন আদিবাসী ছৌ নৃত্যশিল্পী যিনি তাঁর অসাধারণ নৃত্য শৈলীর মাধ্যমে ছৌ নৃত্যের সর্বাধিক প্রসার ও প্রচার করেছিলেন। বিশ্বব্যাপী ছৌ নাচের জনপ্রিয়তা মূলত তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল।
১৯২৫ সালের ৩ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের মানভূম জেলার অন্তর্গত অযোধ্যা পাহাড়ের সংলগ্ন পিটিদীরি গ্রামে গম্ভীর সিং মুড়ার জন্ম হয়। বাবার নাম জিপা সিং মুড়া ও মায়ের নাম ফুলমণি। গম্ভীরের জন্মের আগেই বিষাক্ত মদ খেয়ে জিপা সিং মুড়ার অকাল মৃত্যু হয়। বাবা মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন গম্ভীর। তাঁর দাদার নাম ছিল কমলাকান্ত। গম্ভীর সিং মুড়া – র স্ত্রীয়ের নাম চিন্তামণি। তাঁদের পাঁচ সন্তান – তিন পুত্র – কার্তিক, গণেশ, পরশুরাম ও দুই কন্যা – বিবি ও বুড়ি।
প্রবল আর্থিক অনটনের মধ্যে গম্ভীর সিং মুড়ার শৈশব অতিবাহিত হয়েছে। প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগই তিনি পাননি কখনও। মূলত গরু চড়িয়েই তাঁর দিন কাটতো। গোটা গ্রামের প্রায় শতাধিক গরু নিয়ে সেই ভোরে তিনি জঙ্গলে প্রবেশ করতেন এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগে আবার গ্রামে লোকালয়ে ফিরে আসতেন সমস্ত গরু নিয়ে। জঙ্গলে একবার একটি গরু বাছুর প্রসব করলে তিনি বাছুরটিকে কাঁধে চাপিয়ে তার মালিকের কাছে পৌঁছে দিলে সেই মালিক খুশি হয়ে গম্ভীরকে দুটো আট হাতি গামছা উপহার দিয়েছিলেন। গম্ভীর সেই দুটি গামছা তাঁর মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন লজ্জা নিবারণের জন্য। পরবর্তী সময়ে জঙ্গলে গরু চড়াতে গিয়ে গম্ভীর ওই বাছুর এবং তাঁর মায়ের মধ্যেকার খুনসুটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। পরবর্তীকালে এই গরু টিকেই তিনি তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু হিসেবে স্বীকার করেছিলেন।
গম্ভীর সিংয়ের ছৌ নাচের জগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি বড় ভাই কমলাকান্ত সিং মুড়া। এছাড়াও তাঁর জীবনে বিজয়চন্দ্র রায়, সহদেব গড়াই, সুচাদ সুত্রধর, গোলাম
মহম্মদ প্রভৃতি ব্যক্তির অশেষ অবদান রয়েছে। গম্ভীর সিং তাঁর বিয়ের বাসরে চড়িদা গ্রামের শিবমণ্ডপে “বাবু পান খেয়েছে, বিধুমুখী পাগল হয়েছে”- গানের সুরে নাচ দেখান তিনি।
আর একবার অন্য গ্রামে গম্ভীর সিং তাঁর নাচের দল নিয়ে নাচতে যান। সেখানে তাঁর মহিষাসুরের ভূমিকায় নাচ দেখতে দর্শকদের মধ্যে এমন হুড়োহুড়ি পড়ে যায় যে নাচের মাচাটি মড়মড় করে ভেঙে পড়ে মাটিতে। এই ঘটনার পর থেকে তিনি পরিচিত হন ‘মাচাভাঙা ওস্তাদ গম্ভীর সিং’ নামে। লোক সংস্কৃতি গবেষক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গম্ভীর সিং সতেরো জন শিল্পীর দল সহ ১৯৭২ সালের ১৭ই মে প্রথম ইউরোপ যাত্রা করেন। লন্ডনের স্যাডলার ওয়েলস্ থিয়েটারে প্রথম ছৌ নাচ অনুষ্ঠিত পরিবেশন করেন তিনি। সেই বছর ২৫ শে মে বি.বি. সির মাধ্যমে গোটা ইংল্যান্ড ছৌ নাচ দর্শন করে।
এরপর প্যারিসে ১৫ দিন ধরে গম্ভীর ও তাঁর দল নৃত্য পরিবেশন করেন। তদানীন্তন ফরাসী প্রেসিডেন্ট তাঁর দলের ছৌ নৃত্য দেখে খুশী হয়ে নৃত্য শিল্পীদের নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান ও উপহার দেন। এরপর একে একে আমস্টারডাম, মাদ্রিদ সহ বিভিন্ন শহরে সাতদিন ধরে ছৌ নাচ পরিবেশন করেন।
১৯৭৫ সালে ১৬ই জানুযারী তিনি আমেরিকা যাত্রা করেন। নিউইয়র্কে পরপর দুই দিন কানাডার টরেন্টোতে দুই দিন বস্টনে চার দিন ক্যালিফোর্নিয়ায় ছয় দিন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে দুই দিন এবং হনলুলুতে দুই দিন অনুষ্ঠান করেন তিনি।
১৯৮১ সালের ২৬ জানুয়ারি গম্ভীর সিং মুড়া পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৮২ সালে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ‘সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয় তাঁকে।
২০০২ সালের ৯ নভেম্বর ৩১৫ আপ হাওড়া চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনে হৃদরোগে তাঁর মৃত্যু হয়।
2 comments