সালমান রুশদি (Salman Rushdie) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক যাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ ১৯৮১ সালে ‘ম্যান বুকার পুরস্কার’ অর্জন করে। এই উপন্যাস তাঁকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকা অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের পরে ইংল্যান্ডের সেরা ৫০ জন সাহিত্যিকের তালিকায় ১৩ তম স্থানে রয়েছেন সালমান রুশদি।
১৯৪৭ সালের ১৯ জুন ভারতের মুম্বাই শহরে এক অভিজাত কাশ্মীরি মুসলমান ব্যবসায়ী পরিবারে সালমান রুশদির জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম হল আহমেদ সালমান রুশদি। তাঁর বাবা আনিস আহমেদ রুশদি ছিলেন কেমব্রিজ থেকে পাশ করা আইনজ্ঞ যিনি পরবর্তীকালে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
রুশদি প্রথমে মুম্বাইয়ের ক্যাথিড্রাল এবং জন কোনন স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারের রাগবি স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে এম.এ পাস করেন।
কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কপি রাইটার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গ্রিমাস’প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ সালে তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি ‘বুকার পুরস্কার’ অর্জন করেছিল। এছাড়াও উপন্যাসটি ‘জেমস টেট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল’ পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৯৩ এবং ২০০৮ সালে এই উপন্যাসটি ‘বেস্ট অফ দ্য বুকারস’ পুরস্কার অর্জন করে।১৯৮৩ সালে তাঁর ‘শেম’ উপন্যাসটি ফরাসি পুরস্কার ‘Prix du Meilleur Livre Etranger’ লাভ করে এবং বুকার পুরস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। এই উপন্যাসটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় ওঠে। বেশ কয়েকটি দেশের ইসলাম ধর্মবলম্বীরা এই বইটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় যা অনেক সময় এই প্রতিবাদ সহিংস রূপ ধারণ করে। কিছু দেশের সরকার এই বইটি নিষিদ্ধ করে দেয়।
১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী এই উপন্যাসটি রচনার জন্য রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া জারি করেন। এই ঘটনায় রুশদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পুলিশি প্রহরায় আত্মগোপন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সালে ইরান সরকার এই ফতোয়া বাতিল করে দেন। আত্মগোপনের সময় তিনি ছদ্মনামে তাঁর লেখা চালিয়ে গেছেন। মৃত্যু পরোয়ানা সত্ত্বেও তিনি তাঁর লেখনী থামাননি। এই সময়ের রচনাগুলির মধ্যে ‘ইমাজিনারি হোমল্যান্ড’, ‘হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিস’,’দ্য মুরস লাস্ট সাই’ ছিল উল্লেখযোগ্য।
প্রকাশ্য জনজীবনে ফিরে আসার পর প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফুরি’। তাঁর কিছু প্রবন্ধ নিয়ে রচিত হয় ‘স্টেপ অ্যাক্রস দিস লাইন’। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ‘শালিমার দ্য ক্লাউন’। এছাড়াও মুঘল সম্রাট আকবরের ওপর রচিত উপন্যাস ‘দ্য এনচ্যানট্রেস অফ ফ্লোরেন্স’ তাঁর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। ছোটদের জন্যও তিনি কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন যেমন- ‘লুকা এন্ড দ্য ফায়ার অফ লাইফ’, ‘টু ইয়ারস এইট মান্থস এন্ড টোয়েন্টি এইট নাইটস’ তাঁর রচিত আর একটি উপন্যাস। ২০১৭ সালে লেখেন ‘দ্য গোল্ডেন হাউজ’ এবং ২০১৯ সালে লেখেন পরবর্তী উপন্যাস ‘কুইয়োতে’। এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং উপন্যাস তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে সালমান রুশদি ফ্রান্সের Order des Arts et des Letters-এর একজন কমান্ডার মনোনীত হন। ২০০৭ সালের জুন মাসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ‘নাইট ব্যাচেলর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস’ ১৯৪৫ সালের পর থেকে যুক্তরাজ্যের সেরা ৫০ জন সাহিত্যিকের তালিকায় ১৩ তম স্থানটি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করে। পাঁচবার তিনি বুকার পুরস্কারের জন্য তালিকা ভুক্ত হয়েছিলেন। ২০০৫ সালে ‘শালিমার দ্য ক্লাউন’ উপন্যাসটি ভারতের সম্মানজনক ‘হাচ ক্রসওয়ার্ড বুক আ্যওয়ার্ড’ পায়। এছাড়া তিনি জার্মানি ও ইতালিতেও তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য পুরস্কার পান। ১৯৯৫ এবং ১৯৮৮ সালে তিনি কোস্টা বুক অ্যাওয়ার্ডস পান। তিনি পেন আমেরিকান সেন্টার (PEN American Centre)এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এবং পেন ওয়ার্ল্ড ভয়েস ফেস্টিভালের (PEN World Voices) প্রবর্তক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ নিয়ে দীপা মেহতার পরিচালনায় একটি সিনেমা তৈরি হয়। এই সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন সীমা বিশ্বাস, শাবানা আজমি, নন্দিতা দাশ এবং ইরফান খান। ২০১২ সালে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল।
২০০০ সাল থেকে রুশদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ইউনিয়ন স্কোয়ার এলাকায় বাস করতে শুরু করেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অবস্থিত ইমোরি ইউনিভার্সিটিতে ডিস্টিঙ্গুইশড রাইটার হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। ২০০৮ সালের মে মাসে ‘আমেরিকান একাডেমী অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’- এর তরফ থেকে তাঁকে সম্মানসূচক বিদেশি সদস্যপদ প্রদান করা হয়। তিনি ‘আউটস্ট্যান্ডিং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল হিউম্যানিজম’-এর জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পুরস্কৃত হন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয ‘জোসেফ আ্যনটন: আ মেমোয়ার’ । এটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও জীবন ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়।
সালমান রুশদি ‘লাঞ্চ বক্স’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থার উপদেষ্টা কমিটিতে রয়েছেন। এই সংস্থাটি সাউথ আফ্রিকার বিভিন্ন স্কুলে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করে। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু সংস্থা ও কমিটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চারবার বিয়ে করেন কিন্তু প্রতিবারই ডিভোর্স হয়ে যায়। তাঁর দুই সন্তান রয়েছে।
২০২২ সালের ১২ আগস্ট আমেরিকার নিউইয়র্কের এক মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার সময় হাদি মাতার নামে এক হামলাকারী সালমান রুশদিকে ছুরি দিয়ে ঘাড়ের কাছে বেশ কয়েকবার আঘাত করে। সালমান রুশদিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং এ কোনরকমে প্রাণে বেঁচে যান।
One comment