সতীপীঠ গোদাবরীতীর

সতীপীঠ গোদাবরীতীর

গোদাবরীতীর সতীপীঠটি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রিতে গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত। সতীপীঠ গোদাবরীতীর একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর ‘বাম গন্ড’ বা বাম গাল পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন বিশ্বমাতৃকা এবং ভৈরব হলেন দণ্ডপাণি। এই সতীপীঠের আর একটি নাম হল সর্বশৈল সতীপীঠ। 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়, বলা হয় সতীর বাম গাল পড়ে গোদাবরীতীর সতীপীঠটি গড়ে উঠেছে। 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, প্রাচীনকালে ব্রহ্মগিরি পর্বতে মহর্ষি গৌতম তাঁর স্ত্রী দেবী অহল্যাকে নিয়ে বাস করতেন। একদিন তাঁর ধানের ক্ষেতে একটি গরু ঢুকে পড়ে এবং ধানের গাছগুলি খেতে শুরু করে। গরুটি ধান নষ্ট করছে দেখে গৌতম গরুটিকে তাড়াতে যান। কিন্তু গরুটিকে খুব সামান্য আঘাত করতেই সেটি মাটিতে পড়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়। এর ফলে ঋষি গৌতমের গোহত্যার পাপ হয়। সেই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গৌতম মহাদেবের তপস্যা শুরু করেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব মহর্ষি গৌতমের সামনে আসেন এবং তাঁকে বর চাইতে বলেন। গৌতম তখন মহাদেবকে সমস্ত ঘটনা জানান এবং অনুরোধ করেন যেন মহাদেব সব পাপনাশিনী দেবী গঙ্গাকে সেই জায়গায় নিয়ে আসেন, যাতে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে গৌতম গোহত্যার মত ভয়ানক পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন। তাঁর কথা শুনে মহাদেব তখন দেবী গঙ্গাকে ডেকে এনে সেই জায়গায় প্রবাহিত হওয়ার আদেশ দেন। গঙ্গা সেই আদেশ পালন করেন এবং তারপর গঙ্গাস্নান করে মহর্ষি গৌতম পাপমুক্ত হন। মহর্ষি গৌতমের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য মহাদেব গঙ্গাকে এই জায়গায় প্রবাহিত হতে আদেশ করেছিলেন বলে এই নদীর নাম হয় ‘গৌতমী’। গোহত্যার পাপ দূর করতে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল বলে এই জায়গায় গঙ্গার নাম হয়েছে ‘গোদাবরী’। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই নদীতে স্নান করেছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে গোদাবরীতীর সতীপীঠের মন্দিরটি পাঁচহাজার বছরেরও বেশি আগে নির্মিত প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। তবে এই মন্দির কবে এবং কারা নির্মাণ করেছিল তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু মন্দিরের তোরণ বা ‘গোপুরম’-এর উঁচু দেয়ালে এবং মূল মন্দিরের স্থাপত্য এবং সূক্ষ্ম ভাস্কর্যে ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। গোপুরমে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। গোদাবরীতীর সতীপীঠে দেবী হলেন ‘বিশ্বমাতৃকা’ এবং ভৈরব হলেন ‘দণ্ডপাণি’। অন্য মত অনুযায়ী দেবী ‘বিশ্বেশ্বরী’ এবং ‘রাকিনী’ নামেও পরিচিত। ভৈরবের অপর নাম ‘বৎস্নাভ’।

এই মন্দিরে দেবীর নিত্যপুজোর ব্যবস্থা আছে। সাধারণ সময়ে মন্দির সকাল ৬:০০ থেকে সন্ধ্যা ৭:৩০ অবধি ভক্তদের দর্শনের জন্য খোলা থাকে। তবে উৎসবের দিনগুলিতে এই সময়ের পরিবর্তন হয়। ভক্তেরা মায়ের কাছে প্রধানত আসেন সন্তানলাভের আশায় কিংবা বিয়ের বাধা কাটানোর জন্য। আশ্বিন মাস ও চৈত্র মাসের নবরাত্রি এখানে খুব ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। এছাড়াও খুব বড় করে পালিত হয় ফাল্গুন মাসের মহাশিবরাত্রি। বারো বছর পর পর আষাঢ় মাসে এখানে ‘পুষ্কর মেলা’ বসে। এইসময় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী এখানে আসেন এবং নিজেদের সব পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার আশায় গোদাবরী নদীতে স্নান করেন।

আপনার মতামত জানান