হেনরিক ইবসেন

হেনরিক ইবসেন

সারা বিশ্বের নাটকের ইতিহাস রচিত হলে তাতে অনিবার্যভাবে যাঁরা সসম্মানে স্থান পাওয়ার যোগ্য তাঁদেরই মধ্যে একজন হলেন হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen)। তিনি একজন নাট্যকার ও নাট্য-পরিচালক ছিলেন। নাটকে কঠিন ও রূঢ় বাস্তবকে তুলে ধরার জন্য তাঁকে নাটকে বাস্তবতাবাদ ও আধুনিকতাবাদের জনকও বলা হয়ে থাকে। ইবসেন তাঁর নাটকগুলিতে এমন সব সত্যের মুখোশ নগ্ন করে তুলে ধরতেন যা তাঁর সমসাময়িকদের বিড়ম্বনায় ফেলেছিল। নাটকের মধ্যে দিয়ে যেমন জীবনের নৈতিকতার সন্ধান করেছিলেন তিনি তেমনই ইউরোপের যে পারিবারিক কঠোর নৈতিকতার প্রাচীর তাতে আঘাত হেনেছিলেন। তাঁকে গদ্য নাটকের জন্মদাতাও বলা হয়। ইবসেন যথাক্রমে ১৯০২, ১৯০৩ এবং ১৯০৪ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন কিন্তু নোবেল পুরষ্কার পাননি। নিজেকে দীর্ঘদিন নির্বাসনে রেখেছিলেন তিনি। শেক্সপিয়ারের পরে ইবসেনের নাটকই সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চস্থ হয়েছে।

১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের টেলিমার্কের অন্তর্গত একটি বন্দর শহর স্কিয়েনের একটি ধনী বনিক পরিবারে হেনরিক জোহান ইবসেনের জন্ম হয়। তাঁর পিতা নুড প্লেসনার ইবসেন একজন স্বচ্ছল বণিক ছিলেন। এই নুড ইবসেনের পূর্বপুরুষ ডেনিশ বংশোদ্ভূত এবং জাহাজের অধিনায়ক ছিলেন, কিন্তু প্রাথমিক সাফল্য লাভের পরে নুড ইবসেন ব্যবসায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জর্জেন হ্যাভ অবশ্য ইবসেনের পূর্বপুরুষদের জাহাজের অধিনায়ক বলেননি, সরকারী কর্মচারী বলেছেন। ইবসেনের মা মারিচেন আলটেনবার্গ স্কিয়েন শহরের এক ধনী বণিকের কন্যা ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ইবসেন ছিলেন সবচেয়ে বড়। তাঁর তিনটি ভাই এবং এক বোন ছিল।

ইবসেনের বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর বাবার ব্যবসা মন্দার দিকে যেতে শুরু করে এবং নুড ইবসেন ১৮৩৫ সাল নাগাদ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দেন। দেউলিয়া হয়ে ইবসেনের পিতার মেজাক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তিনি মদ্যাসক্ত হয়ে পড়েন। স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠতেন মাঝেমাঝেই। এই দুরাবস্থার কারণে ইবসেন পরিবার তাঁদের স্কিয়েনের প্রধান আলটেনবার্গ বিল্ডিং বিক্রয় করতে বাধ্য হন এবং ভেনস্টোপে তাঁদের গ্রীষ্মকালীন ছোট একটি বাড়িতে স্থায়ীভাবে চলে যান। এই যে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে ইবসেন বড় হয়ে উঠেছিলেন, এই যে অন্ধকার জগত দেখেছিলেন, এইসব উপকরণই পরবর্তীকালে তাঁর নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছিল৷ ইবসেনের অনেক নাটকের চরিত্রের মধ্যে তাঁর পিতার প্রতিচ্ছায়া লক্ষ করা যায়। এছাড়াও তাঁর নাটকে যেসব অসহায় ও দুঃখী নারীদের ভিড় দেখা যায় তারা পরোক্ষে ইবসেনের নিজেরই মা মারিচেন আলটেনবার্গের করুণ মূর্তিটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও ঐতিহাসিক জর্জেন হ্যাভ ইবসেনকে নিয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থে এগুলি ‘মিথ’ আখ্যা দিয়ে বলেন ভেনস্টোপে চলে যাওয়ার পর ইবসেনের একটি সুখী ও আরামদায়ক সময় কেটেছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শহরের যে স্কুলে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করত সম্ভবত সেখানেই ইবসেনদের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল কিন্তু আর্থিক দুর্গতির কারণে ১৮৪৩ সালে ১৫ বছর বয়সে ইবসেন স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো উপায় না থাকায় তাঁকে পরিবারের আর্থিক সহায়তার কাজে লেগে পড়তে হয়েছিল। সেই বছরই ২৭ ডিসেম্বর ইবসেন স্কিয়েন শহর ছেড়ে সত্তর মাইল দূরের আরেকটি ছোট শহর গ্রিমস্ট্যাডের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে সম্ভবত ছয় বছর ছিলেন তিনি। প্রথমে একজন ফার্মাসিস্টের শিক্ষানবিশ হিসেবে এবং ১৮৪৬ সালে সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি৷ গ্রিমস্ট্যাড জীবনের প্রথম তিন বছর ইবসেন সম্পূর্ণ একা থাকতেন। এই সময় সমসাময়িক কবিতা ও ধর্মতত্ত্ব নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। নিজে কবিতা লিখতেও শুরু করেন। এর কিছু আগে থেকেই নাটক রচনাও শুরু করেন ইবসেন।

এই নরওয়েজিয়ান গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশে প্রায় ছয় বছর অতিবাহিত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার বাসনা মনে মনে পোষণ করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি হিসেবে ল্যাটিন ভাষা অধ্যয়ন করেন এবং তা করতে গিয়ে সিসেরো পাঠ করে ক্যাটিলিনের চরিত্রটি নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘ক্যাটিলাইন’ নামক পদ্যে লেখা তাঁর প্রথম ঐতিহাসিক নাটকে ইবসেন এই চরিত্রটিকেই ব্যাখা করবার চেষ্টা করেছিলেন। এই নাটকটি ব্রাইনজলফ জার্মি (Brynjolf Bjarme) ছদ্মনামে লিখেছিলেন তিনি। এক বন্ধুর ব্যক্তিগত খরচে তা প্রকাশ করা গেলেও সেদিকে মানুষের দৃষ্টি পড়েনি, খুব অল্প কয়েকটি কপিই বিক্রি হয়েছিল।

গ্রিমস্ট্যাডে কাজ করে অর্থ জমিয়ে তিনি ক্রিশ্চিয়ানিয়ায় চলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার আশায়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করবার জন্য প্রস্তুত হতে একটি অনিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন তিনি। এখানেই পরবর্তীকালের নরওয়ের জাতীয় কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। প্রবেশিকা পরীক্ষায় গ্রীক ও পাটিগণিত বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় ইবসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। সেই সময় তাঁর ক্যাটিলাইন নাটকটিও ক্রিশ্চিয়ানিয়া থিয়েটার প্রত্যাখান করেছিল।  কিন্তু ১৮৫০ সালে তাঁর নাটক ‘দ্য বারিয়াল মাউন্ড’ মঞ্চস্থ হয়েছিল তিনবার। এটিই তাঁর প্রথম মঞ্চস্থ হওয়া নাটক। প্রথম দিকের নাটকগুলিতে ইবসেন নরওয়েজিয়ান লেখক হেনরিক ওয়ারগেল্যান্ড এবং পিটার ক্রিস্টেন অ্যাসবজর্নসেন ও জর্গেন মো দ্বারা সংগৃহীত নরওয়েজিয়ান লোককাহিনি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

১৮৫০ সালে বেহালা বাদক ওলে বুল (Ole Bull) বার্গেনে ডেটনর্স্ক থিয়েটার (Detnorske Theater) খুলে রীতিমতো এক নতুন আন্দোলনেরই সূত্রপাত করেছিলেন বলা যায়। ১৮৫১ সালে ওলে বুল এই থিয়েটারে ইবসেনকে একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। ক্রমে ক্রমে এই থিয়েটারের একজন অন্যতম নাট্যপরিচালক এবং নাট্যকার হয়ে ওঠেন ইবসেন৷ সেখানে থাকাকালীন প্রতি বছর ভেন্যুটির জন্য একটি নাটক লিখেছেন এবং প্রযোজনা করেছিলেন তিনি। এই থিয়েটারে শেক্সপিয়ার এবং ফরাসি নাট্যকার স্ক্রাইবের কাজ-সহ ১৫০টিরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ ক’রে ইবসেন মঞ্চশিল্পে শেক্সপিয়ার এবং মলিয়েরের মতো বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ইবসেনের ‘দ্য ওয়ারিয়ারস ব্যারো’ এবং ‘সেন্ট জনস নাইট’ নাটকগুলি ব্যর্থতার মুখ দেখলেও ১৮৫৫ সালে রচিত তাঁর ‘ইনগার অব ওস্ট্রাট’ এবং ১৮৫৬ সালের ‘দ্য ফিস্ট অ্যাট সোলহাগ’ নাটক দুটি সমালোচকদের অনুমোদন লাভ করেছিল। শেষোক্ত নাটকটি ১৮৫৭ সালে নরওয়ের বাইরে সুইডেনের রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল। সেই বছরই ক্রিশ্চিয়ানিয়া নর্স্ক থিয়েটারে সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ১৮৫৮ সালে ইবসেন সুজানা থোরসেনকে বিবাহ করেন এবং তার এক বছর পর তাঁদের পুত্র সিগুর্ডের জন্ম হয়। এই সিগুর্ড পরবর্তীকালে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সন্তানের জন্মের পর ইবসেন এক আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। এই সময় ইবসেনের জন্য বিখ্যাত কবি বজর্নসন অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন। এই সময়ে দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে জীবনের এই অধ্যায়ে প্রচন্ড হতাশা ও বিষাদে ভুগেছিলেন তিনি। নানারকম কাজের দায়িত্বের জন্য নিজের সৃজনশীল কাজে তিনি সময় দিতে পারছিলেন না। এছাড়াও থিয়েটারের মানও তাঁর এসময় খারাপ হওয়ায় বেতন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। ১৮৫৭ সালের পর থেকে ১৮৬২ সালে ‘লাভ’স কমেডি’ প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত আর কোনো নাটক প্রকাশ করেননি তিনি৷ তাঁর এই দুরবস্থা কেটে যায় যখন তিনি ‘দ্য প্রিটেন্ডারস’ রচনা করেছিলেন। সমালোচকরা এই নাটকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে৷ সরকার তাঁকে ইউরোপের অন্যান্য অংশের সাংস্কৃতিক প্রবণতার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য একটি ভ্রমণ বৃত্তি প্রদান করেছিল।

রোমে গিয়ে ইবসেন প্রথমবারের মতো শাস্ত্রীয় এবং রেনেসাঁ যুগের মহান শিল্পকর্মগুলো দেখেছিলেন। এখানকার মুক্ত পরিবেশে ইবসেন শ্লেসউইগ-হলস্টেইনের উপর প্রুসো-ড্যানিশ যুদ্ধের ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রচনা করেন ‘ব্র্যান্ড’। সৌন্দর্য থেকে নৈতিকতার দিকে ঘুরে যায় তাঁর কলমের মোড়। ঊনবিংশ শতাব্দীর নরওয়ের সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত এই নাটকটি। পরের বছর প্রকাশিত ‘পিয়ার গিন্ট’ ইবসেনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। বলা হয় যে, নরওয়ের জীবনে হতাশ হয়ে ইবসেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি আর নরওয়েতে ফিরে যাননি।

১৮৬৮ সালে ইবসেন ইতালি থেকে জার্মানির ড্রেসডনে চলে আসেন। সেখানে তিনি রোমান সম্রাট জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেটের জীবন ও সময়কে অবলম্বন করে রচনা করেন ‘এম্পারার অ্যান্ড গ্যালিলিয়ান’ নাটক। ইবসেন নিজে সবসময় এই নাটকটিকে তাঁর সমগ্র রচনার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখতেন।

১৮৭৫ সালে তিনি চলে আসেন মিউনিখে। তাঁর প্রথম বাস্তববাদী নাটক ‘দ্য পিলারস অব সোসাইটি’ রচনা শুরু করেন যা ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল৷ ১৮৭৯ সালে ইবসেন সেই বিখ্যাত নাটক ‘আ ডল’স হাউজ’ রচনা করেন। পুরুষ এবং মহিলাদের দ্বারা গৃহীত বৈবাহিক ভূমিকার একটি তীব্র সমালোচনা এই নাটক। তিনি নিজেই শেষদিককার নাটকগুলিকে সিরিজ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন নাটকের যে সিরিজ ‘আ ডল’স হাউজ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল ‘হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন’ দিয়ে তা শেষ হয়। ১৮৮১ সালে রচিত ‘ঘোস্ট’ নাটকটি সমাজের নৈতিকতার এক জঘন্য দিক প্রকাশ করেছিল৷ ১৮৮২ সালে রচনা করলেন ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি বলতে চাইলেন কখনও কখনও সংখ্যাগুরুর উল্টোদিকে দাঁড়ানো একা একজন ব্যক্তিও সঠিক হয়৷ ১৮৮৪ সালে রচিত ‘দ্য ওয়াইন্ড ডাক’কে অনেকে ইবসেনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করেন।

শেষদিকে ইবসেন বেশ কয়েকটি অন্তর্মুখী নাট্যরচনা করেছিলেন। সেসব নাটকে নৈতিক মূল্যবোধের তুলনায় মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যার প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি৷ এই ধরনের নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘হেড্ডা গ্যাবলার’, ‘দ্য মাস্টার বিল্ডার’ ইত্যাদি৷ ১৮৯১ সালে ইবসেন নরওয়েতে ফিরে গিয়েছিলেন।

ইবসেনকে ১৮৭৩ সালে নাইট, ১৮৯২ সালে কমান্ডার এবং ১৮৯৩ সালে ‘অর্ডার অফ সেন্ট ওলাভ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তাঁকে ‘অর্ডার অফ দ্য ড্যানেব্রোগ’, ‘অর্ডার অফ দ্য পোলার স্টার’ এবং ‘অর্ডার অফ ভাসার’ প্রথম শ্রেণীর নাইট ক্রস প্রদান করা হয়েছিল।

১৯০০ সালে ইবসেন একের পর এক স্ট্রোকের শিকার হন। অবশেষে ১৯০৬ সালের ২৩ মে ক্রিশ্চিয়ানিয়াতে আরবিন্স গেড ১-এ নিজের বাড়িতেই এই কিংবদন্তি নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান