ডেনিম জিন্স

ডেনিম জিন্সের উদ্ভব হল কীভাবে

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পোশাক পরিচ্ছদে বদল এসেছে অনেক। স্টাইল এবং ফ্যাশনের জন্য নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক তৈরি করছেন পোশাক শিল্পীরা। পুরুষদের পোশাকের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পোশাক হল ডেনিম জিন্স। মূলত পুরুষদের পোশাক হিসেবে ডেনিম জিন্সের প্রচলন শুরু হলেও সাম্প্রতিককালে মহিলা মহলেও এই জিন্স নিজের আধিপত্য জাহির করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন রঙের জিন্স বাজারে প্রচলিত থাকলেও ‘ডেনিম ব্লু জিন্স’ বা নীল রঙের জিন্সের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি।  কঠোর পরিশ্রমেও টেকসই হতে পারে এমন এক ধরণের কাপড় বানানোর প্রচেষ্টা থেকেই ডেনিম জিন্সের জন্ম হয়েছে বলা যেতে পারে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খনি শ্রমিকদের কাজের পোশাক থেকে আজ সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সর্বস্তরের মানুষের ফ্যাশনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে ডেনিম জিন্স। 

কাপড় বোনার বিভিন্ন ধরণের মধ্যে প্রধান তিনটি ধরণ হল – সাধারণ বুনন বা প্লেইন বুনন, সাটিন বুনন এবং টুইল বুনন। সমস্ত বুনন পদ্ধতির মধ্যে এই টুইল বুনন সবথেকে টেকসই ও শক্তপোক্ত বুনন। জিন্সের কাপড় এই টুইল পদ্ধতিতেই বোনা হয়ে থাকে। এখন ডেনিম জিন্স বলতে আজ আমরা যে নীল রঙের ধাতব বোতাম লাগানো শক্তপোক্ত প্যান্ট বুঝি আসলে কিন্তু ডেনিম এবং জিন্স সম্পূর্ণ আলাদা দুটি শব্দ যার উৎপত্তি এবং অর্থ দুইই একেবারে ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র। 

ইতালির একটি শহর জিনোয়া (Genoa)। এখানকার তাঁতিরা বহু বছর ধরেই এমন এক বিশেষ ধরণের কাপড় বানাতো যা অত্যন্ত টেকসই এবং শক্তপোক্ত হত।  ইতালির ‘জিনোয়া’ শহরে এই কাপড়ের উৎপত্তির কারণে এটি ‘জিন’ (jean) নামে পরিচিত ছিল।  এই ‘জিন’ ই যে কালক্রমে ‘জিন্স’ হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।  ফ্রান্সও অনেকদিন ধরে নিজস্ব পদ্ধতিতে এই ধরণের শক্তপোক্ত কাপড় বানানোর চেষ্টা করে আসছে কিন্তু পেরে উঠছে না কিছুতেই। ইতালীয় জিনকে নকল করতে গিয়ে কখন যে ফরাসি তাঁতিরা একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কাপড় বানিয়ে ফেলেছেন নিজেরাই সেটা খেয়াল করেননি।  খেয়াল করলেন যখন তখন দেখলেন তাঁদের এই কাপড় ইতালীয় জিনের মতোই শক্ত কিন্তু এর বুনন পদ্ধতিটি আলাদা। এটি টুইল বুনন পদ্ধতি ব্যবহার করে বোনা হয়ে থাকে যে কারণে কাপড় অনেক টেকসই ও মজবুত হয়।  শুধু তাই নয় এই কাপড় বোনার সময় লম্বালম্বি বোনা সুতোর অংশটিকে গাঢ় নীল রঙে রাঙানো হয়ে থাকে কিন্তু আড়াআড়িভাবে বোনা সুতোর অংশগুলিতে কোন রঙের প্রলেপ থাকে না। ফলত এই কাপড়ের সামনের অংশ নীল হয় কিন্তু কাপড়ের উল্টো অংশটি স্বাভাবিক সাদা রঙেরই থেকে যায়। ফ্রান্সের নাইমস বা নিমস শহরে এই কাপড়ের উৎপত্তি হওয়ার কারণে ফরাসিরা এই কাপড়কে  ‘সার্জ ডে নিমস’ (Serge de Nîmes) নামে সম্বোধন করত যার অর্থ ‘নিমস শহরের বুনন’। আঠারো  শতকের শেষ দিকে ফ্রান্সের তাঁতিদের তৈরি এই সার্জ ডে নিমস কাপড়টি এতই জনপ্রিয় হয় যে, ইংরেজ এবং ফরাসি বণিকরা ব্যবসার সুবিধার্থে নামটিকে ছোট করে ‘ডেনিম’ করে দেয়। 

ডেনিম জিন্স বলতে আমরা যে প্যান্ট / ট্রাউজারের কথা বুঝি তার জনক হিসেবে দুই জনের নাম করতেই হবে – জ্যাকব উইলিয়াম ডেভিস এবং লেভি স্ট্রস। আমেরিকার সান ফ্রান্সিস্কোতে লেভি স্ট্রসের বিভিন্ন ধরণের পণ্য বিক্রির দোকান ছিল। এই দোকানে ফ্রান্স থেকে আমদানি করা ডেনিম কাপড়ও পাওয়া যেত।  তাঁর দোকান থেকে এই ধরণের কাপড় কিনে জ্যাকব উইলিয়াম ডেভিস নামের একজন দর্জি মূলত খনি শ্রমিকদের জন্য খনিতে কাজের উপযোগী প্যান্ট বানাতেন। শ্রমিকরা কাপড়ের প্রশংসা করলেও আক্ষেপ করতেন প্যান্টের যে অংশগুলিতে টান পড়ে সেই অংশের কাপড় বহু ব্যবহারে ছিঁড়ে যেতে শুরু করে।  ডেভিস তখন চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করেন প্যান্টের যে অংশগুলিতে টান বেশি পড়ে সেই অংশগুলি তামার তৈরী বোতাম এবং বল্টু দিয়ে সেলাই করে দেখবেন এতেও প্যান্ট ছিঁড়ে যায় কিনা।  তাঁর এই সেলাই পদ্ধতিটি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে।  খনি শ্রমিকরা আনন্দ সহকারে জানিয়ে যান তাঁকে যে, প্যান্ট এখন সম্পূর্ণ টেকসই হয়ে উঠেছে।  তাঁর আবিষ্কৃত এই প্যান্ট শ্রমিক মহলে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গেলে জ্যাকব প্যান্টে এই ধাতব বোতাম লাগানোর পদ্ধতিটিকে পেটেন্ট করানোর কথা চিন্তা করেন। কিন্তু তা করতে গেলে একটি ব্যবসায়িক অংশীদারের প্রয়োজন ছিল তাঁর। এই সময়েই  তাঁর মাথায় আসে লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোং-এর কথা, যাদের কাছ থেকে প্যান্ট তৈরির কাপড় সংগ্রহ করেন তিনি। জ্যাকব এই প্রস্তাবটি লেভি স্ট্রসকে জানালে এর মধ্যে একটি দারুণ ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখতে পান লেভি এবং তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হন। অবশেষে ১৮৭৩ সালের ২০ মে, মার্কিন পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্ক অফিস থেকে জ্যাকব এবং লেভি স্ট্রস পেটেন্ট পেয়েছিলেন। সেই কারণে ১৮৭৩ সালের ২০ মে তারিখটিকে ডেনিম জিন্সের জন্মদিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এরপর ক্রমে ক্রমে এই ডেনিম জিন্সের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

১৯৩০-এর দশকে এটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যখন হলিউডে কাউবয় সিনেমা তৈরি করা শুরু হয় যেখানে অভিনেতারা জিন্স পরতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জিন্স উৎপাদন কমে গেলেও আমেরিকান সৈন্যরা যখন ছুটিতে থাকতেন তখন জিন্স পরতেন। পরবর্তীকালে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবেও জিন্স পরেছেন মানুষ। তবে জিন্সকে পৃথিবীব্যাপী স্টাইল ও ফ্যাশনের পোশাক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন হলিউড অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডো

One comment

আপনার মতামত জানান