সববাংলায়

হিপনিক জার্ক

ঘুমের মধ্যে কখনো কি মনে হয়েছে  আপনি যেন নিচে পড়ে যাচ্ছেন? নিজেকে বাঁচাতে পড়ি মরি করে উঠে বসলেন আর তখনই খেয়াল হল আরে! আপনি তো আপনার বিছানাতেই আছেন! চিন্তার কিছু নেই, আপনাকে জানিয়ে রাখি আপনি পৃথিবীর ৬০-৭০% মানুষের মতোই স্বাভাবিক।আপনার দরকার শুধু দুশ্চিন্তা মুক্ত একটা ভাল ঘুমের। ঘুমের মধ্যে এই অস্থিরতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় হিপনিক জার্ক (hypnic jerk) বলা হয়। ল্যাটিন হিপনোসিস শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ হিপনোস থেকে,হিপনোস শব্দের অর্থ হল ঘুম।আসলে হিপনোস হলেন গ্রীসের ঘুম-দেবতা।তাঁর  নাম অনুসারেই এই নাম এসেছে।

ঘুমের হিপনোগোজিক স্টেট (hypnagogic state) অর্থাৎ, সচেতন ও ঘুমিয়ে থাকা অবস্থার মধ্যবর্তী অংশে এই ঘটনাটি ঘটে থাকে বলে একে ‘হিপনিক জার্ক’ বলা হয়। এটি এক ধরনের মায়োক্লোনাস (মায়ো শব্দের অর্থ হল পেশি, ক্লোনাস বলতে একধরণের প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে বোঝায় যা ঘুমের প্রথম দশায় ঘটে থাকে) ক্রিয়া। অর্থাৎ এটি ঘুমের মধ্যে মানুষের অনিচ্ছাতেই ঘটে থাকে কিন্ত এই ঝাঁকুনি হয় ঐচ্ছিক পেশিতে (সাধারণত পায়ে),অনৈচ্ছিক পেশিতে নয়। ক্ষেত্র বিশেষে এর প্রাবল্য বেশি বা কম হতে পারে। হিপনিক জার্কের সময় হৃদগতি এবং প্রশ্বাসের হার বাড়ে, ঘামও বেরোতে পারে।সাধারণত, পুরুষদের মধ্যে এই জার্ক বেশি হতে দেখা যায়। ইন্টারন্যাশনাল স্লিপ সোসাইটিস দ্বারা প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ স্লিপ ডিসঅর্ডার’ জার্নালে হিপনিক জার্ককে ঘুম সংক্রান্ত মুভমেন্ট ডিসঅর্ডারের তালিকাভুক্ত করেছে।

খুব স্পষ্ট কোনো কারণ এর পেছনে না থাকলেও নানা মুনির নানা মত এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এগুলির মধ্যে একটি মত অনুযায়ী এই ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে বিবর্তনের সঙ্গে। মানুষ তখন বৃক্ষবাসী ছিল। গাছে থাকার কারণে ঘুমন্ত অবস্থায় গাছ থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার একটা সম্ভবনা সব সময়ই থাকে। ঠিক এই কারণেই ঘুমের সময়েও মস্তিষ্কে সদা সতর্ক থাকতে হত। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে ঘুমের সময় মস্তিষ্ককে সজাগ রাখার এই প্রবণতা বিবর্তনের সাথে বিলুপ্ত হয়নি উপরন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হয়ে আসছে। অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনার জন্যে ঘুমের প্রথম দশায় এই পেশি সঞ্চালনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আরেকটি মত বলছে, অতিরিক্ত মানসিক ধকল বা ক্যাফেইন আসক্তি, মানসিক উত্তেজনা ইত্যাদি কারণে ঘুমের প্রথম দশায় আমাদের শরীরের পেশিগুলি উদ্দীপিত থাকে। যার ফলস্বরূপ যেকোনো ব্যক্তির এই ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিছু গবেষকের মতে ঘুমের সময় এই হিপনিক জার্ক আমাদের শরীরের জন্যে একটি সূচকের কাজ করে যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক সংকেত পায় আমাদের বাকি শরীর সম্পূর্ণভাবে বিশ্রাম পেয়েছে কিনা। 

আরও পড়ুন:  গোল্ডেন ব্লাড গ্রুপ

তবে হিপনিক জার্ক সংক্রান্ত যে তত্ত্বটি সর্বাধিক গ্রাহ্য সেটি হল: ঘুমের প্রথম দশা অর্থাৎ nREM (non rapid eye movement) এর N1 দশায় আমাদের শরীর সম্পূর্ণভাবে বিশ্রামে থাকলেও আমাদের মস্তিষ্ক  সক্রিয় থাকে। এই সময়েই সাধারণত মায়োক্লোনাস জাতীয় ঘটনা হয়ে থাকে। ঘুমের এই প্রারম্ভিক সময় পেশীগুলি ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করে অথচ মস্তিষ্ক, পেশির এই শিথিলতা সঠিক ভাবে ধরতে পারে না। ফলে অ্যামিগডালা নামের অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে যা মূলত আকস্মিক ভীতি বা আবেগ জনিত বার্তা প্রেরণ করে। এর ফলে কিছু ক্ষেত্রে স্নায়বিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় যা পেশীগুলিকে প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তির নিচে পড়ে যাওয়ার মত বিভ্রম তৈরি হয়। ঘুমের শুরুর দিকে মূলত এটি ঘটে থাকে, তাই প্রাবল্য বেশি হলে যেকোনো ব্যক্তি ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারেন এবং তড়াক্ করে উঠে বসেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাবল্য কম হওয়ার কারণে এটি বোঝা যায় না।

“ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি” (electroencephalography) বা EEG বা পলিসমনোগ্রাফির (polysomnography) সাহায্যে হিপনিক জার্ককে সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটি মূলত ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের মস্তিষ্ক তরঙ্গকে রেকর্ড করে। এই তরঙ্গকে বলা হয় ভার্টেক্স শার্প ওয়েভ (vertex sharp wave) যা দিয়ে হিপনিক জার্ককে গ্রাফের আকারে সূচিত করা যায়। আমেরিকান একাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন ( American Academy of Sleep Medicine) বা এএএসএম(AASM) এর মতে শিশু বা কিশোর অপেক্ষা তরুণ বা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই ঘটনা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কারণ হিসেবে তাঁরা দায়ী করেছেন ‘স্লিপিং সাইকল (sleeping cycle) এর পার্থক্যকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুমের গভীরতা কমতে শুরু করে,  স্নায়বিক উত্তেজনা বৃদ্ধি,টেনশন ইত্যাদির কারণে। হিপনিক জার্ক এর সময় একজন ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপ, আকস্মিকভাবে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘাম প্রভৃতি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এএএসএম- এর আরেকটি সমীক্ষা ৬৬ জন ব্যক্তির ওপর চালানো হয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী ৬০-৭০% ব্যক্তিরই কখনো না কখনো হিপনিক জার্কের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১০% এর ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন:  শম্ভুনাথ দে

হিপনিক জার্ক যদিও কোনো অসুস্থতা নয় তবুও বেশ কয়েকটি উপায়ে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। যেমন, শোয়ার সময় ঘর যথাসম্ভব অন্ধকার এবং শান্ত রাখা। অপ্রয়োজনীয় আলোর ব্যবহার না করা কারণ এটি মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে। ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুমাতে যাওয়ার সময় সুনির্ধারিত করা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় কিছু না খাওয়া। এছাড়াও মদ্যপান বা ধূমপানে নিয়ন্ত্রন রাখা। মেডিটেশন বা ধ্যানে বিশেষ উপকার পাওয়া যেতে পারে। কিন্ত শুতে যাওয়ার আগে কোনো রকম শারীরিক ব্যায়াম না করাই শ্রেয়।

হিপনিক জার্ক  কখনোই কোনো উদ্বেগের বিষয় নয়। কিন্ত এই ঘটনা অবশ্যই আপনাকে আপনার অনিয়মিত বিশ্রামহীন জীবন যাত্রার ব্যাপারে  সতর্ক করে। তবে খুব বেশি ঘুমের ব্যাঘাত হলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করাই বাঞ্ছনীয় কারণ হিপনিক জার্ক কখনো মস্তিষ্ক, সুষুম্নাকান্ড বা স্নায়ুর কাজের অস্বাভাবিকতা বা টিউমারের কারণেও হতে পারে।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন