ইলা মিত্র (Ila Mitra) একজন বাঙালি সংগ্রামী কৃষক নেত্রী ও কমিউনিস্ট যিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। একজন অসাধারণ আ্যথলিট হিসেবে তিনি ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত রাজ্য জুনিয়র আ্যথলেটিক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বস্তুতপক্ষে তিনিই প্ৰথম বাঙালি মহিলা যিনি ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকে ভারতীয় আ্যথলিট হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হওয়ায় তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ হারান।
১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় ইলা মিত্রের জন্ম হয়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীনে বাংলার আ্যকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল। মূলত তাঁর উৎসাহেই ইলা পড়াশোনা এবং খেলাধূলোয় নিজেকে প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর মায়ের নাম মনোরমা সেন। উনিশ বছর বয়সে ইলার বিয়ে হয় মালদার নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুরহাটের জমিদার মহিমচন্দ্রের ছেলে কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্রের সাথে।
ইলার পড়াশোনা শুরু হয় বেথুন স্কুলে। স্কুল জীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ১৯৪৪ সালে বেথুন কলেজ থেকেই স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পরে ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি খেলাধূলাতেও তুখোড় ছিলেন। সাঁতার, বাস্কেটবল, ব্যান্ডমিন্টনে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্য জুনিয়র আ্যথলেটিক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বস্তুতপক্ষে তিনিই প্ৰথম বাঙালি মহিলা যিনি ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকে ভারতীয় আ্যথলিট হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হওয়ায় তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ হারান।
বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীনই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন ইলা মিত্র। কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্যা ইলার ১৯৪৩ সালে নারী আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতিতে পর্দাপণ ঘটে। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে মহিলাদের দ্বারা শুরু হওয়া আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই সময়ে ইলা সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি সহ অনেক প্রচার আন্দোলন করেন তিনি।আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
এই কাজের মাধ্যমেই মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইলা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই সময়ে তিনিই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।
বিয়ের পর তিনি মালদহের নবাবগঞ্জ থানার এলাকায় অবস্থিত কৃষ্ণগোবিন্দপুর গ্রামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল স্হাপন করেন। ইলার ঐকান্তিক চেষ্টায় স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা তিনমাসে তিন থেকে পঞ্চাশে পৌঁছায়। ঐ সময়ই তিনি তাঁর স্বামীর অণুপ্রেরণায় কৃষকদের অধিকার রক্ষার জন্য তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। এইভাবেই জমিদার বাড়ীর অন্দররমহল থেকে গরীবের “রাণী মা” হয়ে ওঠেন ইলা।
বৃটিশ ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে চাষীদের জমির অধিকার চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির উর্বরতা ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী বৃটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে উৎপন্ন ফসলের কোন সম্পর্ক ছিল না। এই সময়ে জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে এক নতুন শ্রেণীর জন্ম হয় যারা জমিদারদের থেকে জমি ইজারায় নিয়ে কৃষকদের চাষ করার জন্য দিত। এরা চাষ তদারকি করত ও খাজনা আদায় করত। কৃষকেরা জমির ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ বহন করেও উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক জোতদারদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হত। কারণ তাদের জমির সম্পূর্ণ মালিকানা ছিল না। এই ব্যবস্থাকে বলা হত ‘আধিয়ারী ব্যবস্হা’। এই আধিয়ারী ব্যবস্থার ফলে কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের প্রতি অধিকার কমতে থাকে এবং তাদের ওপর জোতদারদের শোষণ বাড়তে থাকে। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভের আঁচ বাড়তে থাকে। একটা সময়ে এই অত্যাচারের মাত্রা চরমে ওঠে যখন কৃষকদের বাধ্য করা হয় তাদের উৎপাদিত ফসলের পরিবর্তে অর্থের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করতে। এর ফলে কৃষকদের বিক্ষোভ প্রকাশ্যে আসে। ১৯৩৬ সালে সর্বভারতীয় কৃষক সমিতি গঠন হয়। এই সমিতি জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও কৃষকদের সরকারি প্রজা করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুই ভাগ কৃষকদের জন্য বরাদ্দের দাবিতে আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। এই আন্দোলনকে সেই সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কৃষকদের উপর অত্যাচার চরমে ওঠে। উৎপাদিত তিনভাগ ফসলের দুইভাগের দাবীতে কৃষকরা সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাসে এই কৃষক আন্দোলনই “তেভাগা আন্দোলন” নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালে রাজশাহীর নবাবগঞ্জে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি তৈরী করা হয়। এই কমিটি জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষীদের উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দুইভাগ প্রদান করে মালিকানা প্রদান করার সুপারিশ পেশ করে। এই আন্দোলনকে সামনে থেকে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইলা মিত্র।
১৯৪৬ সালে কমরেড হাজী দানেশের নেতৃত্বে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাথে ইলার স্বামী রমেন্দ্র মিত্র সরাসরি যুক্ত হন। এইসময় রমেন্দ্র মিত্রকে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে পার্টির কাজে নাচোলে পাঠানো হয়। সেই সময় ইলাও স্বামীর সাথে কৃষক সংগঠনের কাজে যুক্ত হন। নাচোলের চন্ডীপুর এলাকা ছিল মিত্র পরিবারের জমিদারীর অংশ। এখানেই ছিল প্রথম সাঁওতাল কমিউনিস্ট নেতা মাতলা মাঝির বাড়ী। ইলা ও রমেন্দ্র এই মাতলা মাঝির বাড়ি থেকেই কৃষক আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলাদেশে মুসলীম লীগ ক্ষমতায় এলে আন্দোলনকে স্তিমিত করতে নানান দমননীতি গ্রহণ করে । সেই সময় শক্ত হাতে হাল ধরেন ইলা ও রমেন্দ্র। তাঁদের নেতৃত্বে নাচোলে হাজার হাজার অত্যাচারিত ভূমিহীন কৃষক ও সাঁওতালরা এক শক্তিশালী তীরন্দাজ বাহিনী সংগঠিত করে। এইভাবেই জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলন বাস্তব রূপ নেয়। এই আন্দোলনের ফলে জোতদার ও মহাজনেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয় ফসলের এক তৃতীয়াংশ গ্রহণ করতে। অপমানিত পরাজিত মহাজনেরা প্রশাসনের কাছে কৃষকদের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়। শুরু হয় কৃষকদের উপর অত্যাচার।
১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশের একটি বাহিনী নাচোলে এলে বিক্ষোভকারী জনতা ওই পুলিশ বাহিনীকে ঘিরে ধরে হত্যা করে। এই ঘটনার পরে কৃষকদের উপর পুলিশের অত্যাচার চরমে ওঠে। আন্দোলনের নেতাদের খোঁজে বারোশো গ্রামে পুলিশ নির্মমভাবে অত্যাচার চালায়। গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কনষ্টেবল হত্যার মামলা করা হয়। মামলা রাজশাহী কোর্টে উঠলে রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝি নিরুদ্দেশ হন। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি ইলা সাঁওতালি মেয়ের ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে রেলওয়ে ষ্টেশনে গ্রেফতার হন।
প্রত্যক্ষদর্শীর অভাবে ও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তিনজন আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এর মধ্যে ইলাকেই গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাঁকে জেলে আনা হয়। তাঁর উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। মারধোর, পায়ের গোড়ালি দিয়ে পেরেক ঢুকিয়ে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলে। কিন্তু এত অত্যাচার সহ্য করেও তিনি বাকী দুই সঙ্গীর ঠিকানা বলেননি। ১৯৫৩ সালে তাঁকে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে স্হানান্তর করা হয়। সেখানে পুলিশের অত্যাচারে ইলা প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়। ইলার মুক্তির দাবীতে ঢাকায় গণ দাবি ওঠে। তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ার কারণে ও জনতার দাবির সামনে বাধ্য হয়ে ইলাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। দীর্ঘ আটমাস তিনি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সুস্থ হয়ে তিনি সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ সাল অবধি পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি চারবার মানিকতলা কেন্দ্র থেকে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের জাতীয় পরিষদের সদস্য, পশ্চিমবঙ্গের মহিলা সমিতির সহ সভানেত্রী এবং ভারত ও সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির সহ সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ থাকে ২০০২ অবধি তিনি শিক্ষক প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
ইলা মিত্র বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন যার মধ্যে “জেলখানার চিঠি”, “হিরোশিমার মেয়ে” “মনে- প্রাণে”, “লেলিনের জীবনী” ও “রাশিয়ার ছোট গল্প” উল্লেখযোগ্য।
ভারত সরকার ইলা মিত্রকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে তাম্রপত্র পদকে ভূষিত করেছে।”হিরোশিমার মেয়ে” বইটির জন্য তিনি “সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু” সম্মান পান।
২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় ইলা মিত্রের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- "Otiter Jed" or Times of Revolution: Ila Mitra, the Santals and Tebhaga Movement:KAVITA PANJABI:
Economic and Political Weekly, Vol. 45, No. 33 (AUGUST 14-20, 2010), pp. 53-59
- https://www.thedailystar.net/
- https://www.observerbd.com/
- https://bangalnama.wordpress.com/
- http://www.bethunecollege.ac.in/
One comment