আমেরিকা স্বাধীনতা দিবস

৪ জুলাই ।। স্বাধীনতা দিবস (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র)

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের স্বাধীনতা দিবস (Independence Day of United States of America)।

প্রতি বছর ৪ জুলাই প্রভূত গুরুত্ব সহকারে সমগ্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে এই স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। এই বিশেষ দিনেই ব্রিটেনের উপনিবেশ থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মোট ১৩টি কলোনিকে মহাদেশীয় কংগ্রেস স্বাধীন ও মুক্ত বলে ঘোষণা করে। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের অধীনতা থেকে মুক্তি পায় আমেরিকা। যে কোনও দেশের পক্ষেই তাদের স্বাধীনতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর তাই স্বাধীনতালাভের মুহূর্তকে অক্ষয় করে রাখতে এবং স্বাধীনতালাভের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ইতিহাসকে জনমানসে ছড়িয়ে দিতে এই স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপিত হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় পালনীয় দিবসের অন্যতম এই স্বাধীনতা দিবস।

আমেরিকার বিপ্লবের সময় ১৭৭৬ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে ১৩টি কলোনিকে আইনিভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। সেদিনটি ছিল ২ জুলাই। ঐ বছরই জুন মাসে দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ভার্জিনিয়ার রিচার্ড হেনরি লি গ্রেট ব্রিটেনের অধীনতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে মতামত নেওয়ার পরে মহাদেশীয় কংগ্রেস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। থমাস জেফারসনের নেতৃত্বে গড়ে তোলা একতি পাঁচ সদস্যের কমিটির পক্ষ থেকে এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হয়। সকলের মত নিয়ে ৪ জুলাই দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্থির করা হয়। থমাস জেফারসনই এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়াটি লিখেছিলেন। এখানে স্মর্তব্য যে, ব্রিটেনের থেকে আমেরিকার কলোনিগুলি মুক্ত হয়েছিল ২ জুলাই, কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে ৪ জুলাই দিনটিতেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় বলে এই দিনটিই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই দিনটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পরে থমাস জেফারসন, জন অ্যাডামস এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একযোগে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা সকলেই এই দিনেই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, থমাস জেফারসন এবং জন অ্যাডামস উভয়েই পরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন এবং তাঁরা দুজনেই কাকতালীয়ভাবে একই দিনে মারা যান, ১৮২৬ সালের সেই ৪ জুলাই। আমেরিকার স্বাধীনতালাভের ৫০তম বর্ষপূর্তি ছিল সে বছর। আরেক রাষ্ট্রপতি জেমস মনরোও ১৮৩১ সালের ৪ জুলাই মারা যান যার ফলে স্বাধীনতা দিবসে মৃত তৃতীয় রাষ্ট্রপতির মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ঐতিহাসিকরা বলছেন আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র রাষ্ট্রপতি ছিলেন কেভিন কুলিজ যিনি ১৮৭২ সালের ৪ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা দিবস জনসাধারণের মধ্যে প্রথমদিকে অতটাও তাৎপর্যবাহী ছিল না। প্রথম ১৫-২০ বছর সেভাবে এই দিবসটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকায় তখন নতুন নতুন সব কিছু গড়ে উঠছে, দেশের তরুণরা স্বাধীনতার আর এই নতুনত্বের আস্বাদ নিতেই ব্যস্ত। ১৭৯০ সাল নাগাদ, দলীয় দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়ে উঠলে এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান্স দল থমাস জেফারসন এবং ঘোষণাপত্র উভয়কেই সম্মান জানায়, কিন্তু ফেডেরালিস্ট দলটি মনে করে এই ঘোষণাপত্র অত্যন্ত ফরাসি-ঘেঁষা এবং তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধী। ১৮১৭ সালে জন অ্যাডামস একটি চিঠিতে অভিযোগ জানান যে আমেরিকা তার ইতিহাস নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয়, কিন্তু এই অবস্থা চিরকাল থাকবে না। ১৮১২ সালের যুদ্ধের পরে ফেডেরালিস্ট দলের প্রভাব কমতে শুরু করে এবং সমস্ত নতুন দলগুলি নিজেদের থমাস জেফারসনের উত্তরসূরি হিসেবে ভেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সম্মান জানায়। তাছাড়া এই ৪ জুলাই তারিখেই থমাস জেফারসন এবং জন অ্যাডামসের মৃত্যু এই দিনটির তাৎপর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৮৭০ সালে স্বাধীনতার প্রায় ১০০ বছর পরে কংগ্রেস এই দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে।

স্বাধীনতালাভের ঠিক পরের বছর ১৭৭৭ সালের ৪ জুলাই রোড আইল্যান্ডের ব্রিস্টলে একবার সকালে এবং পরে সন্ধ্যে নামার আগে মোট ১৩ বার শূন্যে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। এই ‘গান স্যালুট’-এর পাশাপাশি প্যারেড, প্রার্থনা, আতশবাজি প্রজ্জ্বলন ইত্যাদি নানাভাবেই এই স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করা শুরু হয় সেই সময় থেকেই। ১৭৭৮ সালে জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর রস হলের সদর দপ্তর থেকে দেশের সেনাদের জন্য মদ্যের যোগান দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে। ১৭৮১ সালের ৪ জুলাই ম্যাসাচুসেটস সাধারণ আদালত রাষ্ট্রীয় উদ্‌যাপন হিসেবে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম রাজ্য আইনসভার মর্যাদা পায়। ১৮৭০ সালে মার্কিন কংগ্রেস স্বাধীনতা দিবসকে ফেডারেল কর্মীদের জন্য একটি অবৈতনিক ছুটিতে পরিণত করে এবং ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস এটিকে পরিবর্তন করে এই দিনটিতেও বেতন দেওয়ার রীতি ধার্য করে।

৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ফেডারেল ছুটি হিসেবে ডাক পরিষেবা এবং ফেডারেল আদালত বন্ধ থাকে। সেই তারিখটি রবিবার পড়লে ফেডারেল কর্মীরা তার বদলে শুক্রবার বা সোমবার ছুটি নিতে পারেন। এই দিন উপলক্ষ্যে বেশিরভাগ মার্কিন পরিবার বনভোজনের আয়োজন করে। সপ্তাহান্তে আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমেরিকার জাতীয় পতাকার মত লাল, সাদা ও নীল রঙে সাজানো হয় চারদিক। সকালে বিভিন্ন জায়গায় প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পার্কে, মেলা প্রাঙ্গণে কিংবা টাউন স্কোয়ারে রাত্রে আতশবাজি পোড়ানো হয়। ৪ জুলাইয়ের আগের রাতটি বিশাল সমারোহে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। নিউ ইংল্যান্ডে ব্যারেল ও পিপে দিয়ে বিশাল বিশাল উঁচু পিরামিড বানানোর প্রতিযোগিতা চলে যা রাত্রে জ্বালানো হয়। মোটামুটিভাবে উনিশ ও বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই রীতিটি প্রচলিত হয়ে আসছে। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র আমেরিকা জুড়েই আতশবাজি পোড়ানো শুরু হয়। এছাড়াও বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গানও গাওয়া হয়ে থাকে যা মানুষকে ১৮১২ সালের যুদ্ধ কিংবা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা স্মরণ করায়। তবে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে এই আতশবাজি পোড়ানো একটি আজও একটি বিশেষ রীতি হিসেবেই প্রচলিত যা কিনা প্রথম শুরু হয়েছিল আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া থেকে।        

One comment

আপনার মতামত জানান