আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস

৯ আগস্ট।। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস

প্রতিবছর প্রতিমাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে কিছু দিবস পালিত হয়। নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বে পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ (International Day of the World’s Indigenous People)।

সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হয় আদিবাসীদের অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে সর্বপ্রথম আদিবাসী জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত, এই এক দশকে বিশ্বে প্রথম বার আদিবাসী দিবস পালন করা হবে একটি বিশেষ দিনে। পরবর্তীকালে, সাধারণ পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, এই দশকেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হবে। এই দ্বিতীয় দশকের জন্য ‘থিম’ বা ‘বিষয়’ ছিল ‘কার্য এবং মর্যাদার জন্য দশক’ (A decade for Action and Dignity)। বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মানুষদের এই দিবসটি পালন করতে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়াও পরবর্তী প্রজন্মকে আদিবাসীদের সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান এবং ক্রিয়াকলাপের  মাধ্যমে  উৎসাহিত করা হয়ে থাকে।

১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর, রেজোলিউশন ৪৯/২১৪ (Resolution 49/214) অনুযায়ী রাষ্ট্রপুঞ্জ সিদ্ধান্ত নেয় যে, আন্তর্জাতিক আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে পালিত দশকগুলিতে প্রত্যেক বছর ৯ আগস্ট এই বিশেষ দিনটি পালন করা হবে। ১৯৮২ সালে, এই দিনেই রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি কার্যনির্বাহী সমিতি দ্বারা আয়োজিত সভায় আদিবাসীদের উন্নয়ন এবং অধিকারের বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের অবদান এবং এ ব্যাপারে তাদের সাফল্য চিহ্নিতকরণের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬৮০টি আদিবাসী ভাষা এই মুহূর্তে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই ভাষাগুলিকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে এবং এই সমস্ত আদিবাসী ভাষার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০১৯ সালকে সারাবিশ্বে ‘আদিবাসী ভাষার বছর’ (International Year of Indigenous Languages,) হিসেবে চিহ্নিত করে।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, একটি রাষ্ট্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে আদিবাসীরা প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ৭০টি দেশে ৩০ কোটি আদিবাসী বাস করে। এই আদিবাসীদের অধিকাংশই নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্রে বঞ্চিত। অনেক দেশে আদিবাসীরা স্বীকৃতিই পায়নি। কোনো দেশে আবার আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বা কোন ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৯৩ সালকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রথমবার `আদিবাসী বর্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের চাকমা সম্প্রদায়ের রেবাং দেওয়ানের আঁকা ছবিটি নির্বাচিত হয় ‘ইউএন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইন্ডিজেনাস ইস্যুজ’-এর (UN Permanent Forum on Indigenous Issues) ভিসুয়াল আইডেন্টিফায়ার (Visual Identifier) হিসেবে। তাঁর আঁকা ছবিটিই বর্তমানে এই দিবসটির সরকারী স্বীকৃত লোগো।

সারা বিশ্বে এই দিনটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়। আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষায় এবং তাদের উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন, নানা আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

২০২০ সালে সারা বিশ্ব যখন করোনা নামক ভাইরাসের মোকাবিলা করতে ব্যস্ত তখন আদিবাসীরাও নিজেদের মতো করে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এভাবেই তারা পরিবেশ ও প্রকৃতির নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে।আদিবাসীরা এই মহামারীর ক্ষেত্রে নিজস্ব সমাধান অনুসন্ধান করছে। তারা এর জন্য নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান এবং তার সঠিক প্রয়োগ, স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, এবং তাদের অঞ্চলগুলো সিল করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

প্রত্যেক বছরই এই দিনটি বিশ্বজুড়ে একটি নির্দিষ্ট থিম বা প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – আদিবাসী ভাষা (Indigenous Languages)।২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – কোভিড -১৯ এবং আদিবাসীদের লড়াই (COVID-19 and indigenous peoples’ resilience)।  ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – কাউকে আর পেছনে রেখে নয়ঃ আদিবাসী মানুষ এবং নতুন সামাজিক চুক্তির আহ্বান (Leaving no one behind: Indigenous peoples and the call for a new social contract)।২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের সংরক্ষণ এবং তার প্রচারের ক্ষেত্রে আদিবাসী মহিলাদের ভূমিকা  (The Role of Indigenous Women in the Preservation and Transmission of Traditional Knowledge)।  ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য – আদিবাসী আত্ম সংকল্পের বার্তাবাহক   (Indigenous Youth as Agents of Change for Self-determination)।  

  

One comment

আপনার মতামত জানান