ঊনবিংশ শতাব্দীর কল্পকাহিনী রচনার অগ্রদূত ছিলেন জগদানন্দ রায় (Jagadananda Roy)। একাধারে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য রচয়িতা জগদানন্দ রায়ের লেখা ‘শুক্র ভ্রমণ’ বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের এক অন্যতম নিদর্শন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের সময়ে যে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল তারই ফসল ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনী যাঁর জনক জগদীশচন্দ্র বসু হলেও কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ ছিলেন জগদানন্দ রায়। বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং অক্ষয়কুমার দত্তের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের অনেক আগেই বাংলা কল্পবিজ্ঞানে ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়েছিলেন জগদানন্দ রায়। ‘বাংলার পাখী’, ‘প্রকৃতি পরিচয়’, ‘পোকামাকড়’ ইত্যাদি বিখ্যাত সব বই লিখে বাঙালির বিজ্ঞানচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
১৮৬৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে এক অভিজাত জমিদার পরিবারে জগদানন্দ রায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা অভয়ানন্দ রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের জমিদার। জগদানন্দের মায়ের নাম ছিল বসন্তসুন্দরী দেবী। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয়। ছোটবেলা থেকেই জগদানন্দ ছিলেন রুগ্ন ও ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী।
স্হানীয় বিদ্যালয় থেকে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। স্কুলজীবন থেকেই জগদানন্দের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর ধারণা ছিল খুবই প্রাঞ্জল। সেই সময় থেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক মজার কাহিনী লিখতে শুরু করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন তিনি এবং সেখান থেকেই ১৮৯০ সালে এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন জগদানন্দ রায়। ১৮৯২ সালে স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত কলেজে পড়াকালীনই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। জমিদারবাড়ির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও প্রবলভাবে সেইসময় আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি।
ফলে পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়ার দরুন তাঁকে খুব অল্প বয়সেই উর্পাজনের জন্য গোয়ারি মিশনারী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নিতে হয় আর এইভাবেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপরে কৃষ্ণনগর সেন্ট জর্জ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন জগদানন্দ রায়। একটা সময় আসে যখন তাঁর আর্থিক অবস্হার চূড়ান্ত অবনতি হয়। এই সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখা পাঠাতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেইসময় ‘সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদক। জগদানন্দ নিয়মিত ‘সাধনা’ পত্রিকায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতেন খুব সহজ ভাষায় যা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিল। সেই সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। জগদানন্দের আর্থিক অবস্থার কথা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শিলাইদহের জমিদারিতে সেরেস্তায় কাজের ভার দেন এবং রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্বও ন্যস্ত হয় তাঁরই উপর। যদিও গুরুদেব অনুভব করেছিলেন এতে তাঁর প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। সেই কারণে তিনি শান্তিনিকতনে ১৯০১ সালে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয় স্হাপন করলে জগদানন্দকে সেখানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। জগদানন্দ শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে অঙ্ক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন একজন কড়া গণিতের শিক্ষক। ছাত্ররা তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতো। কিন্তু তিনি ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। আশ্রমে প্রত্যেক ছাত্রের পড়াশোনার পাশাপাশি আহারাদি ও অন্যান্য অসুবিধার কারণগুলি নজরে রাখতেন জগদানন্দ। কোনো ছাত্র অসুস্থ হলে রাত জেগে সেবা করতেন তিনি। সকালবেলায় আশ্রমের পড়ানো শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় ছাত্রদের নিয়ে তিনি অন্ধকারে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র চেনাতেন। আবার শোনা যায় সেই ছাত্রদের নিয়েই ভূতের গল্প শোনাতে বসতেন জগদানন্দ। তাঁর গল্পের ছলে বিজ্ঞান পড়ানোর প্রশংসা করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। রাশভারী অঙ্কের শিক্ষক হয়েও বেহালা ও এসরাজ বাজানোয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন জগদানন্দ রায়। আবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতেও তিনি অভিনয় করতেন। তিনি ছাত্রদের কেবল শিক্ষা প্রদানই করেননি, একইসঙ্গে তাদের চরিত্র গঠনেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন, ‘‘আমার প্রয়োজন ছিলো এমন সব লোক, যাঁরা সেবাধর্ম গ্রহণ করে এই কাজে নামতে পারবেন, ছাত্রদের আত্মীয়জ্ঞানে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দান দিতে পারবেন। বলাবাহুল্য, এ রকম মানুষ সহজে মেলে না। জগদানন্দ ছিলেন সেই শ্রেণীর লোক।’’ ঠাকুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে নিয়ে একটি মজার ছড়া লিখেছিলেন – ‘জগদানন্দ বিলান জ্ঞান / গিলান পুঁথি ঘর-জোড়া।/ কাঁঠালগুলান কিলিয়ে পাকান, / গাধা পিটিয়ে করেন ঘোড়া’।
১৯১০ সালে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়’-এর সর্বাধ্যক্ষ নিয়োজিত হন জগদানন্দ রায়। এই প্রতিষ্ঠানটিতে শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবেই নিযুক্ত ছিলেন না তিনি, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক উপদেষ্টা রূপেও কাজ করতেন জগদানন্দ। ১৯২১ সালে ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠিত হলে তিনি সেখানকার সচিব পদ অলঙ্কৃত করেছেন। শেষজীবনে বোলপুর ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য এবং বোলপুর ইউনিয়ন বেঞ্চকোর্টের তদারকি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি। কলেজ জীবন থেকেই জগদানন্দ বিভিন্ন বিজ্ঞানমূলক বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। বিজ্ঞানের নীরস তথ্য ও তত্ত্বের কাঠিন্যকে সহজ সরল ভাষায় লিখে প্রকাশ করতেন তিনি। ‘ভারতী’, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাধনা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। পরবর্তীকালে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এবং বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকেই জগদানন্দ উপলব্ধি করেন যে, যদি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাদান করা যায় তাহলে স্বল্প প্রয়াসেই ছাত্র-ছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত এবং রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর যোগ্য উত্তরসূরি। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষকে তিনি বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনাকে জাগ্রত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বইয়ের অপ্রতুলতার কারণে তিনি রচনা করেছেন অনেকগুলি বিজ্ঞানের বই। ছোটদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বই রচনা করেছেন ২৭৫টি। তাঁর সহজ সরল ভাষায় লেখা বিজ্ঞানের বইগুলি সাধারণ মানুষের কাছে বিপুলভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। তিনি মৌলিক বিজ্ঞানভিত্তিক ১৮টি গ্রন্থ এবং সতেরোটি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছেন। তাঁর লেখা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী ‘শুক্র ভ্রমণ’ জগদানন্দকে পাঠক মহলে পরিচিত করায়। এই কাহিনিতে তিনি শুক্র গ্রহে ভ্রমণ ও সেখানকার প্রাণীদের এক কাল্পনিক রূপের ব্যাখা দিয়েছেন। এই গল্পটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি ভিনগ্রহের প্রাণীদের যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন এবং তাদের অবয়ব কল্পনা করেছেন তাতে সেই ভিনগ্রহের প্রাণীদের অনেকটা মানুষেরই পূর্বপুরুষ বাঁদরের মতো মনে হয়। ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে ইউরেনাস গ্রহের প্রাণীদের যোগাযোগ এই গ্রন্থটিতে তিনি গল্পের আকারে বিবরণ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের কাছে একটি আর্কষণীয় গ্রন্থ হয়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায় তাঁর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘প্রোফেসর শঙ্কু’ সিরিজ লেখার প্রায় ছয় দশক আগে জগদানন্দ কল্পকাহিনী প্রকাশ করে কল্পবিজ্ঞান নির্ভর সাহিত্য রচনার পথ সুগম করে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে ‘প্রকৃতি পরিচয়’ (১৯১১), ‘বৈজ্ঞানিক’ (১৯১৩), ‘প্রাকৃতিক’ (১৯১৪), ‘গ্রহ নক্ষত্র’ (১৯১৫), ‘পোকামাকড়’ (১৯১৯), ‘বিজ্ঞানের গল্প’ (১৯২০), ‘গাছপালা’ (১৯২১), ‘পাখী’ (১৯২৪), ‘নক্ষত্র চেনা’ (১৯৩১), ‘বিচিত্র সন্দর্ভ’, ‘সাহিত্য সন্দর্ভ’, ‘চয়ন’, আদর্শ স্বাস্থ্যপাঠ’, ‘বিজ্ঞান পরিচয়’, ‘স্হিরবিদ্যুৎ’, ‘চলবিদ্যুৎ’, ‘চুম্বক’ ইত্যাদি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং জনপ্রিয়। এই বইগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি শিশুদের সঙ্গে খুব সহজে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পরিচয় করিয়েছেন। এই বইগুলি বাংলার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাজগতের ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এগুলি ছাড়াও তিনি কতগুলি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন যার মধ্যে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার’, ‘আলোক ও বর্ণবিজ্ঞান’, ‘গ্রহের বাষ্পমন্ডল’, ‘চুল পাকে কেন’ ইত্যাদি অন্যতম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি রক্ষণশীল মানসিকতা পোষণ করলেও সমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে একটুও দ্বিধান্বিত হননি জগদানন্দ রায়।
জগদানন্দ শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘শিশুসাথী’ পত্রিকার সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। শুধুমাত্র আশ্রমিকদের নয়, তিনি বোলপুর সংলগ্ন ঐ অঞ্চলের মানুষের নানান সমস্যায় সুপরামর্শ প্রদান করতেন। গল্প লিখে তিনি ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ১৯২৫ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি প্রদান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন যা বাংলার ইতিহাসে একটি বিরল সম্মাননা। নৈহাটিতে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর সভায় সভাপতিত্ব করেন জগদানন্দ রায়।
১৯৩৩ সালের ২৫ জুন শান্তিনেকেতনে থাকাকালীনই মাত্র ৬৪ বছর বয়সে জগদানন্দ রায়ের মৃত্যু হয়।
One comment