যতীন্দ্র নাথ দাস

যতীন্দ্রনাথ দাস

যতীন্দ্রনাথ দাস (Jatindranath Das) একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তিনি জীবনের শেষ দিন অবধি লড়াই করে গিয়েছিলেন। ইউরোপীয় কারাবন্দীদের তুলনায় ভারতীয় কারাবন্দীদের সাথে যে অসম ব্যবহার করা হত তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি টানা তেষট্টি দিন অনশন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি কাকোরি কান্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

১৯০৪ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার সিকদার বাগানে মামাবাড়িতে যতীন্দ্রনাথ দাসের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম বঙ্কিমবিহারী দাস এবং তাঁর মায়ের নাম সুহাসিনী দেবী। তিনি তাঁর বাবা মায়ের প্রথম সন্তান ছিলেন। তাঁর একটি ভাই ছিল তাঁর নাম কিরণ দাস। মাত্র নয় বছর বয়সেই তিনি তাঁর মাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব ভাল ছাত্র ছিলেন এবং ১৯২১ সালে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে (first division) ম্যাট্রিকুলেশন (matriculation) এবং পরে ইন্টারমিডিয়েট (intermediate) পরীক্ষা পাশ করেছেন। তিনি বঙ্গবাসী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার পাশাপাশি তিনি শরীর চর্চা করতেন- নিয়মিত কুস্তির আখড়ায় যাওয়া, ফুটবল খেলা এবং ব্যায়াম করা তাঁর রোজকার কাজ ছিল। এছাড়াও তিনি ছোট থেকেই খুব ভোজন রসিক ছিলেন।

খুব ছোট থেকেই তিনি তাঁর বাবার কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানান গল্প শুনে বড় হয়েছেন এবং তখন থেকেই তাঁর মনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করা হয়ে গেছিল। এরপরে বাঘাযতীনের সম্পর্কে জেনে তিনি আরো উদ্বুদ্ধ হন। খুব অল্প বয়সেই তিনি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী দল অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। এরপর ১৯২১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর বাবা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত হওয়াকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি কিন্তু যতীন্দ্রনাথ সব বাধা উপেক্ষা করে নানান মিটিং ও মিছিলে যোগদান করেন এবং বহুবার এই কারণে ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা গ্রেপ্তারও হন। বাবার সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। এরপর গান্ধীজী যখন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন তখন তিনি গান্ধীজীর প্রতি আস্থা হারিয়ে আবার বাড়ি ফিরে যান। ব্রিটিশদের দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য যতীন্দ্রনাথ চরম পন্থাই বেছে নিয়েছিলেন, গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলন তাঁর পছন্দ হয়নি।

বিদ্যালয় পড়াকালীন দেশে যখন কলেরা, বসন্ত এবং আরও নানান মহামারী দেখা দিল তখন যতীন্দ্রনাথ দুস্থ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সেবা করেছেন। দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি বস্তিতে বস্তিতে নৈশ স্কুলের স্থাপন করেন। সমাজ সেবার কাজে তাঁকে কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি, সব সময় তিনি পুরো উদ্যমের সঙ্গে মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এটাই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর পরিচয় হয় রাসবিহারী বসুর শিষ্য ও সহকারি শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সঙ্গে। শচীন্দ্রনাথের তৈরি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে (Hindusthan Republican Association) এরপর তিনি যোগদান করেন। খুব তাড়াতাড়িই তিনি এই সংস্থার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। যতীন্দ্রনাথ সেই সময় থেকেই বোমা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি সেই দলের সদস্যদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। এছাড়াও প্রয়োজনমতো দলের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন।

একটা সময় যতীন্দ্রনাথের সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস কমিটির সহ সম্পাদক হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়। সেই সময় উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য যে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাজী তৈরি করেছিলেন তার অন্যতম সদস্য ছিলেন যতীন্দ্রনাথ। সেই বছর ২৪ অক্টোবরে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স (Bengal Ordinance) জারী করা হয় নির্বিচারে সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের জন্যে। এইসময় যতীন্দ্রনাথের দল কাকোরি স্টেশনের কাছে ট্রেন ডাকাতি করে এবং প্রচুর ধন সম্পদ লুট করে। এই ডাকাতির জন্য যতীন্দ্রনাথই অস্ত্র সরবরাহ করেন। ব্রিটিশ পুলিশের তৎপরতায় তাঁর দলের অনেকেই ধরা পড়েন। তার মধ্যে কারোর ফাঁসি হয় আবার কারোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এরপর তাঁকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং মেদিনীপুর জেলে রাখে। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে আলিপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর তাঁকে আবার ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয়। সেখানে জেল কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি এবং তাঁর সহ বন্দি পান্নালাল মুখার্জি ২২ দিন ধরে অনশন করেছিলেন। পরে গোয়েন্দা বিভাগের ডি আই জি (D.I.G) লেম্যানের হস্তক্ষেপে তাঁরা অনশন ভঙ্গ করেন। এরপর তাঁকে নানা জেলে স্থানান্তরিত করা হয় যার মধ্যে ছিল পাঞ্জাবের সিয়ানওয়ালী জেল, চট্টগ্রামের জেল ইত্যাদি। ১৯২৮ সালের অক্টোবরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। লাহোর থেকে ভগৎ সিং কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি ভগৎ সিংকে সাহায্য করতে রাজি হন এবং তাঁর সাথে আগ্রায় যান অন্যদের বোমা তৈরি করা শেখাতে। সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে থাকা অনেক তরুণ আগ্রায় গেছিলেন তাঁর কাছ থেকে বোমা তৈরি করা শিখতে। তাঁর কাছ থেকেই বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন শুকদেব এবং শিব বর্মা।

১৯২৯ সালে দিল্লিতে ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালীন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত বোমা ছোঁড়েন এবং গুলি চালান। পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে ও সেই সূত্র ধরে বিভিন্ন বন্দির স্বীকারোক্তি আদায় করে বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথও গ্রেপ্তার হন। সেই বছরের ১৪ জুন হাজরা রোড থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁকে লাহোরে পাঠানো হয় এবং সেখানকার বোস্টাল জেলে তাঁকে অন্যান্যদের সাথে আটকে রাখা হয়। সেই সময় ভারতীয় কারাবন্দীদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করা হত এবং ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে প্রসাধনী দ্রব্য, খবরের কাগজ কিংবা বই কিছুই তাঁদের দেওয়া হতো না। কিন্তু ইউরোপীয় কারাবন্দীদের সাথে এর থেকে অনেক ভাল ব্যবহার করা হত এবং তারা নানান সুযোগ সুবিধা উপভোগ করত। এর প্রতিবাদে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত অনশন শুরু করে। অন্যান্য জেলবন্দিরাও তাঁদের সাথে যোগ দেওয়ার কথা ভাবলেও যতীন্দ্রনাথ এর বিরোধিতা করেন। তিনি এর আগে অনশন করেছিলেন এবং এও জানতেন যে নির্মম ব্রিটিশ সরকার তাঁদের অনশনের কোনো গুরুত্বই দেবেনা তাই তিনি অন্যান্যদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্যরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি এবং অনশন শুরু করেন। তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে অন্যদের সাথে অনশনে যোগ দিতে হয় এবং তিনি এও ঘোষণা করেন যে তিনি আমৃত্যু অনশন করবেন। তাঁদের দাবি পূরণ না হলে তিনি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন।

সেই সময়ে সারাদেশে মনোযোগ কেড়েছিল লাহোরের সেই অনশন। তাঁর সেই নির্ভীকতা ও দৃঢ়চেতা মনোভাবকে অনেকেই খুব প্রশংসা করেছিলেন। অনেকের অনুরোধ সত্বেও তিনি তাঁর অনশন ভাঙ্গেনি। তেষট্টি দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর অনশন চালিয়ে গেছেন। অবশেষে যতীন্দ্রনাথ দাসের ১৯২৯ সালে ১৩ জুলাই মৃত্যু হয়।

তাঁর মৃত্যুতে সারাদেশ শোকে উত্তাল হয়ে ওঠে। সবাই তাঁকে বীর শহীদের আখ্যা দেয়। তাঁর নশ্বর দেহ ফুলে ফুলে সাজিয়ে তার সহ বন্দিরা জেলের গেট অব্দি নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তাঁর দেহ কাঁধে তুলে নিয়েছিল পাঞ্জাবের জনতা। সেদিন সবাই চোখের জলে তাঁকে বিদায় জানিয়েছে। বলা হয় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ সেদিন তাঁর শেষ যাত্রায় পা মিলিয়ে ছিলেন। তাঁর মরদেহ ট্রেনে করে লাহোর থেকে দিল্লি এবং তারপর কানপুরে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে পন্ডিত জওয়াহারলাল নেহেরু তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তারপর তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। শোনা যায় তাঁর মৃত্যুর শোকে কলকাতার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল এবং তাঁকে সম্মান জানাতে সেইদিন দক্ষিণ কলকাতার সব দোকান পাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্ররা কালো পতাকা হাতে মিছিল করেছিল কলকাতার রাজপথে। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমস্ত কাজ বাতিল করে কলকাতায় চলে এসেছিলেন এবং ১৫ই সেপ্টেম্বর যতীন্দ্রনাথ দাসের শোক সভার আয়োজন করেছিলেন।

যতীন্দ্রনাথ দাসের অবদান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি মাইলফলক হয়ে থেকে গেছেন। তাঁর মতো মানুষেরা দেশের জন্য সংগ্রাম করে গেছিলেন বলেই আজ ভারতবাসী একটি স্বাধীন দেশে বাস করতে পারছে।

তথ্যসূত্র


  1. হে অতীত কথা কওঃ মাখনলাল রায় চৌধুরীঃ অধ্যায়- যতীন্দ্র নাথ দাসঃ পৃষ্ঠা- ১৫৭ - ১৭৫
  2. https://thewire.in/
  3. https://www.indiatoday.in/education-today/gk-current-affairs/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. https://www.tribuneindia.com/

3 comments

আপনার মতামত জানান