কাশীরাম দাস

কাশীরাম দাস

ষোড়শ শতকের বাংলার এক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং মহাভারতের অনুবাদক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন কাশীরাম দাস (Kashiram Das)। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’ কাব্যকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় প্রথম বার সম্পূর্ণরূপে অনুবাদ করে কাশীরাম সাধারণ মানুষের কাছে মহাকাব্য পাঠ করার এক সহজ পথের সন্ধান করে দিয়েছেন। কৃত্তিবাস ওঝা যেমন বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ অনুবাদ করে মহাকাব্যকে এক সহজ সরল রূপ দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই কাশীরাম দাস তাঁর অনূদিত মহাকাব্যকে সংস্কৃতের জটিলতা থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে পাঠযোগ্য করে তুলেছেন। তিনি তাঁর রচিত মহাভারতকে মহাকাব্যিক গাম্ভীর্যে না রেখে পাঁচালির মতো সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত মহাকাব্যটি ‘কাশীদাসী মহাভারত’ নামে পরিচিত।  মূল সংস্কৃত মহাভারতের অনুসরণ করলেও অনেকাংশেই কাহিনীতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেছেন তিনি। তবে কাশীদাসী মহাভারতের বিরাট পর্ব পর্যন্তই কেবল কাশীরাম দাসের নিজের লেখা বলে সাহিত্য-সমালোচক ও গবেষকেরা মনে করেন। কাশীরাম দাসের মহাভারত বাঙালির মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে তাঁকে লোককবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

কাশীরাম দাসের জন্মতারিখ নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তাঁরই লেখা থেকে জানা যায় তিনি ষোড়শ শতকে অধুনা বর্ধমান জেলার কাটোয়ার ইন্দ্রাণী পরগণার সিঙ্গি গ্রামে কায়স্থ বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম তাঁর রচনা থেকে জানা যায়

ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূৰ্ব্বাপর স্থিতি ।
দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী ।

কায়স্থ – কুলেতে জন্ম বাস সিদ্ধিগ্রাম ।
প্রিয়ঙ্কর দাসসুত সুধাকর নাম ।।
তৎপুত্র কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা ।
কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ।।
পাঁচালী প্রকাশি কহে কাশীরাম দাস ।
অলি হব কৃষ্ণপদে মনে অভিলাষ।।’

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কাশীরামের প্রপিতামহের নাম ছিল প্রিয়ঙ্কর এবং পিতামহের নাম ছিল সুধাকর। কাশীরামের বাবা কমলাকান্তের তিন সন্তানের মধ্যে কাশীরাম ছিলেন মধ্যম সন্তান। তাঁদের আদি পদবি ‘দেব’ হলেও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই কাশীরাম দাস নিজেকে ঈশ্বরের ‘দাস’ মনে করে নিজের পদবি পরিবর্তন করেন। তাঁরা তিন ভাই-ই ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে মেধাবী। কাশীরামের বড় ভাই কৃষ্ণবিজয় সন্ন্যাস নিয়ে চলে যান। তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ও ‘শ্রীভাগবতপুরাণ’ অনুবাদ করে ‘শ্রীকৃষ্ণবিলাস’ গ্রন্থখানি রচনা করেন আর ছোটো ভাই গদাধর জগন্নাথদেবের মহিমা বিষয়ে রচনা করেন ‘জগন্নাথমঙ্গল’ যা ‘জগৎমঙ্গল’ নামেও পরিচিত। কাশীরাম দাসের বাস্তুভিটে থেকে অনুমান করা যায় তাঁদের পরিবার যথেষ্ট সচ্ছল এবং মেধাবী ছিল।

কাশীরাম বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত আবাসগড়ের জমিদার বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা করতেন। জমিদার বাড়িতে বহু কথক ঠাকুরের আগমন ঘটত যাঁদের মুখে মুখে রামায়ণ ও মহাভারতের গান শুনে শুনে তাঁর মধ্যে বাংলায় মহাভারত রচনা করার আগ্রহ জন্মায়। তিনি আবাসগড়ের জমিদার বাড়িতে একটি সংস্কৃত সভায় বির্তকে অংশগ্রহণ করার পরে মহাভারত রচনায় হাত দেন। মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করা ছাড়াও সত্যনারায়ণের পুথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপ্যাখান রচনা করেছিলেন তিনি। স্বভাবের দিক থেকে কাশীরাম ছিলেন পরোপকারী। নিজের গ্রামের জলকষ্ট দূর করার জন্য তিনি একটি পুকুর নির্মাণ করেছিলেন যা আজও ‘কেশপুকুর’ নামে পরিচিত।

কাশীরাম দাসের আগে বাংলায় মহাভারত রচনা করার কাজ শুরু করেছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর, রঘুনাথ, রামচন্দ্র খাঁ, ঘনশ্যাম, দ্বিজ হরিদাস প্রমুখরা। তাঁরা কেউই মহাভারত পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করে উঠতে পারেননি। গবেষকদের মতে, কাশীরামের আগে আর কেউই মহাভারত বাংলায় সম্পূর্ণভাবে অনুবাদ করেননি। কাশীরাম রচিত মহাভারতের বাংলা অনুবাদটি বাঙালির ঘরে ঘরে সহজেই পৌঁছানোর আরও একটি কারণ ছিল ভক্তি ও ভাবধারায় সিক্ত সহজ সরল ভাষা। কাশীরাম মহাভারত অনুবাদ করার সময়ে তিনি মূল ঘটনাবলীকে এক রেখে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন যা বাঙালি পাঠকের মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে। মহাভারতের এক লক্ষ সংস্কৃত শ্লোককে তিনি বাংলায় অনুবাদ করার জন্য মহাভারত রচনার কাজ শুরু করেন। তিনি মহাকাব্যের দার্শনিক জটিল ব্যাখ্যাগুলিকে বাইরে রেখে এক সহজ ভাষায় মহাভারত রচনা শুরু করেছিলেন। কাশীরাম নিজের রচিত মহাভারতের নাম দেন ‘ভারত পাঁচালী’। তিনি ভারতবর্ষ নামকরণ ও ভরত রাজবংশের পিছনে থাকা কাহিনীকে পাঁচালির মতো করে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গবেষকদের অনুমান সমগ্র মহাভারত অনুবাদের কাজটি কাশীরাম একা সম্পন্ন করতে অপারগ ছিলেন। আদিপর্ব, বনপর্ব, সভাপর্ব ও বিরাটপর্ব রচনা করার পরে কাশীরামের অকাল মৃত্যু হয় এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা মহাভারতের বাকি পর্বগুলি অনুবাদ করেন। কাশীরাম বেদব্যাস রচিত মূল মহাভারতের ঘটনাক্রমগুলিকে নিজস্ব ভাষায় পরিবর্তন করে মৌলিকভাবে পরিবেশন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আদিপর্বে সমুদ্রমন্থনের কারণ হিসেবে বেদব্যাস অমৃতের সন্ধানকে প্রধান হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্ত কাশীরাম লক্ষ্মীদেবীকে উদ্ধার করে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনাটিকেই সমুদ্রমন্থনের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আবার কিছু কিছু ঘটনাবলী যা মূল মহাভারতে নেই, তা কাশীরামের কল্পনাপ্রসূত কাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেমন দ্রৌপদীর অহং প্রকাশের ঘটনা, হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদের ঘটনা, শ্রীবৎসচিন্তার কাহিনী বা অর্জুনের সুভদ্রা হরণের ঘটনাগুলি আদি মহাভারতে নেই। এই ঘটনাগুলিকে কাশীরাম নিজের কল্পনাপ্রসূত ঘটনা হিসেবে তাঁর রচিত মহাভারতে সংযোজন করেছেন। একজন পরম বৈষ্ণব হিসেবে মহাভারতের চরিত্রগুলির মহাকাব্যিক ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে তিনি ভক্তিভাবকেই আর্দশ করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। দেশ-কালের পটভূমিতে কাশীরাম তাঁর রচিত মহাকাব্যের চরিত্রগুলির উচ্চতাকে নামিয়ে এনে সাধারণ মানুষের মতো করে নির্মাণ করেছেন। কাশীরামের সৃষ্ট যুধিষ্ঠির চরিত্রটি ধর্মভীরু ও ভাবপ্রবণ বাঙালি পুরুষ চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী ভীমের মধ্যে তাঁর দৈহিক শক্তির চেয়েও ভক্তিভাবকেই তিনি বড় করে দেখিয়েছেন। মহাপ্রতাপশালী অর্জুনও কাশীরামের মহাভারতে প্রবল ভক্তিবাদে সিক্ত আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার পরিবর্তে তাঁকে কাশীরামের মহাভারতে পরিত্রাতার ভূমিকায় আমরা দেখতে পাই। দুর্যোধনের চরিত্রটিও মূল মহাভারতের থেকে  কাশীদাসী মহাভারতে খানিক পৃথক। দুর্যোধন পাণ্ডবকে জ্ঞাতি শক্র হিসেবে মনে করলেও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর ভক্তিভাব অটুট রয়েছে কাশীদাসী মহাভারতে। তাঁর সৃষ্ট মহাভারতের কাহিনী ও চরিত্রগুলি বাঙালির অতিপ্রিয় কাহিনী হয়ে উঠেছে। কাশীরামের মহাভারত চৈতন্য-উত্তর যুগে ভক্তিবাদের রসে সিক্ত এক আবেগপ্রবণ কাহিনী। মহাভারতের নীতিকথাগুলিকে তিনি গল্পের আকারে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাছে মহাভারতের সংসার জীবনের কথা, ন্যায়-নীতি, সত্যপরায়ণতা, বীরত্ব যা কিছু হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি, তাই তিনি উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব কাব্যিক আঙ্গিকে। অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থ যেমন বেদ বা গীতা থেকে কাহিনী সংযোজন করেছেন তিনি এবং তাকে সাধারণ মানুষের কাছে আর্কষণীয় করে তুলে ধরেছেন। কিন্তু মহাভারতের আদি, বন, বিরাট ও সভা পর্বের অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করার পরে কাশীরামের মৃত্যু হওয়ায় তাঁর ভাইপো নন্দরাম ও জামাতা বাকি অংশগুলি অনুবাদ করেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাশীরাম দাসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন ‘কাশীরাম দাস’ সনেটে। বেদব্যাসের রচিত ‘মহাভারত’ অনেকেই অনুবাদ করেছেন, কিন্তু কাশীরাম দাসের রচিত মহাভারত আজও বাঙালির কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং কালজয়ী। তাঁর এই বাংলা অনুবাদের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে আজও অনেক বাঙালিরই ধারণা মূল মহাভারত কাশীরাম দাসেরই রচনা। তাঁর জন্মভিটে কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রামে তাঁর নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় আছে। সম্প্রতি তাঁর জন্মভিটেতে কাশীরামের একটি আবক্ষ মূর্তি স্হাপন করা হয়েছে। উনিশ শতকে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপিত হলে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দ্বারা কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’টি সম্পাদিত আকারে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়।

আনুমানিক ১৬৫০ সালে কাশীরাম দাসের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান