কেশরীনাথ ত্রিপাঠী

কেশরীনাথ ত্রিপাঠী

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সেই তালিকায় নিঃসন্দেহে থাকবেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী (Keshari Nath Tripathi)। স্বাধীনতার আগে জন্ম হলেও রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন স্বাধীনতা লাভের পরে। একজন পেশাদার আইনজীবী থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদার্পণ এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তিনি তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’র সদস্য কেশরীনাথ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার সহ আরও দুই রাজ্যের রাজ্যপাল পদে বহাল ছিলেন। অবশ্য কেবলমাত্র রাজনীতির ঘেরাটোপেই আবদ্ধ থেকে জীবনের এতগুলি বছর অতিবাহিত করেননি তিনি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। এমনকি একজন রাজনীতিবিদের পাশাপাশি খুব নিভৃত সংবেদনশীল ভাবপ্রবণ এক কবিসত্ত্বাও তাঁর মধ্যে রয়েছে।

১৯৩৪ সালের ১০ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদে কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা হরিশচন্দ্র ত্রিপাঠীকে মানুষ ভালবেসে ‘হরি মহারাজ’ বলে ডাকতেন। অনবদ্য সততা এবং আন্তরিকতার জন্য হরিশচন্দ্র সুনাম অর্জন করেছিলেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিভিন্ন রকম কাজ করতেন তিনি। কেশরীনাথের মা শ্রীমতী শিবা দেবী ছিলেন নিতান্ত ঘরোয়া একজন মানুষ। চার বোন এবং তিন ভাইয়ের মধ্যে কেশরীনাথ ছিলেন সবচেয়ে ছোট, সেই কারণে বাড়িতে তিনি ‘ভাইয়া’ নামে পরিচিত। নৈতিক মূল্যবোধ, জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা, সামাজিক প্রতিশ্রুতি তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল মূলত বাবা-মা এবং বড় ভাই কাশীনাথ ত্রিপাঠীর প্রভাবেই। কেশরীনাথের স্ত্রী সুধা ত্রিপাঠী বারাণসীর সুপরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যনারায়ণ মিশ্রের কন্যা ছিলেন। সুধা ত্রিপাঠীও সাধারণ ঘরকন্নাতেই দিনযাপন করতেন। এই ত্রিপাঠী দম্পতির পুত্র নীরাজ ত্রিপাঠী এলাহাবাদ হাইকোর্টের একজন আইনজীবী হন এবং তাঁদের দুই কন্যা নমিতা ও নিধির মধ্যে নিধি সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা। 

এলাহাবাদের সরযু পারিন স্কুলে (পরবর্তীকালে সর্ভয়া ইন্টার কলেজ নামে পরিচিত) কেশরীনাথ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা করেন। পরবর্তীকালে আগারওয়াল ইন্টার কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন তিনি। তারপর ১৯৫৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৫৫ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। মীরাটের চৌধুরী চরণ সিং বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ডি.লিট উপাধি প্রদান করে এবং পরবর্তীকালে উত্তরপ্রদেশ রাজর্ষি ট্যান্ডন ওপেন ইউনিভার্সিটি তাঁকে এলএলডি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। 


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

১৯৫৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কেশরীনাথের নাম নথিভুক্ত হয় এবং সেখানেই আইনচর্চা শুরু করেন তিনি। প্রথমদিকে বেশ কিছু বছর কেশরীনাথ ত্রিপাঠী জগদীশ স্বরূপের জুনিয়র হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৬৫ সালে তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের গ্রন্থাগারের সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৮৭-৮৮ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে তিনি এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদে বহাল ছিলেন। ১৯৮০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব পান কেশরীনাথ ত্রিপাঠী যদিও এই সুবর্ণ সুযোগকে তিনি গ্রহণ করেননি। সেই প্রস্তাব তিনি নিজেই প্রত্যাখান করেন। ১৯৮৯ সালে কেশরীনাথ ত্রিপাঠী এলাহাবাদ হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে মনোনীত হন। কেশরীনাথকে নির্বাচনী আইনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য করা হতো। তিনি কেবল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বা চৌধুরী চরণ সিং-এর পক্ষেই নয়, শ্রী রাজনারায়ণ, শ্রী এইচ এন বহুগুণা, শ্রী মহাবীর প্রসাদ, শ্রী কল্যাণ সিং, শ্রী লক্ষ্মীকান্ত বাজপাই, শ্রী নিত্যানন্দ স্বামী প্রমুখ বিপুল সংখ্যক মন্ত্রী, লোকসভা ও ইউপি বিধানসভার সদস্যের হয়ে তিনি আইনি লড়াই করেছেন। 

১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। ১৯৫২ সালে জনসংঘের প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকেই তিনি তার সদস্য ছিলেন। জনসংঘের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে যে কাশ্মীর আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, কেশরীনাথ সেই আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই অংশগ্রহণের ফলে তিনি একজন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে নৈনীর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর বক্তৃতা তাঁকে এলাহাবাদের একজন জনপ্রিয় বক্তা এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। তিনি ভারতীয় জনসংঘের সিটি ইউনিটের সভাপতি এবং এর রাজ্য কার্যনির্বাহী ও জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি জনতা পার্টির টিকিটে ঝাঁসি বিধানসভা থেকে প্রথমবারের মতো বিধায়ক নির্বাচিত হন।শ্রী ত্রিপাঠী মোট ছয়বার অর্থাৎ ১৯৭৭, ১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯৩, ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে বিজেপির উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ ও বিক্রয়কর মন্ত্রী নিযুক্ত হন তিনি। কেশরীনাথ মোট তিনবার ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩, ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ এবং ২০০২ সালের মে থেকে ২০০৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়ে ইউপি বিধানসভার স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৪ সালে এখান থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ইউপি বিধানসভার স্পিকার থাকাকালীন তৎকালীন লোকসভার স্পিকার তাঁকে কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিষ্ঠার প্রথমদিন থেকেই কেশরীনাথ বিজেপির সদস্য ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি উত্তরপ্রদেশ ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি হন। দলের জাতীয় শৃঙ্খলা কমিটির এবং এই দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্যের পদেও বহাল ছিলেন কেশরীনাথ। তিনি প্রায় নয় বছর কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ইউপি শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব সামলেছিলেন। ২৪ জুলাই ২০১৪ সালে কেশরীনাথ ত্রিপাঠী পশ্চিমবঙ্গের ২০তম রাজ্যপাল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজ্যপালের পাশাপাশি তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিরও চ্যান্সেলার ছিলেন। কেশরীনাথ ত্রিপাঠী দুবার ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ২০১৭ সালের ২০ জুন ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত  বিহারের রাজ্যপাল হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ১৯ মে পর্যন্ত মেঘালয়ের রাজ্যপাল হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। আজিজ কুরেশির বরখাস্তের পরে ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৫ মে পর্যন্ত তিনি মিজোরামের রাজ্যপাল হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। 

কেশরীনাথ ত্রিপাঠী রাজনীতিবিদ হিসেবে যেমন ছিলেন দক্ষ মানুষ, তেমনি তার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন কুশলী লেখক। তিনি কেবল হিন্দিই নয়, ইংরেজিতেও অনেক বই লিখেছিলেন। চমৎকার কিছু কাব্যগ্রন্থ রচনা করে তিনি মুগ্ধ করেছেন তাঁর পাঠককে। কেশরীনাথের সাতটি কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতা সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, ‘মনোনুকৃতি’ (ইংরেজিতে ‘দ্য ইমেজেস’ নামে অনুদিত হয় পরে), ‘আয়ু পঙ্খ’, ‘উন্মুক্ত’, ‘সাইলেন্ট অউর জিরো’, ‘চিরন্তন’ ইত্যাদি। তাঁর সমস্ত কবিতা নিয়ে ড. প্রকাশ ত্রিপাঠীর সম্পাদনায় ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘সঞ্চয়িতা: কেশরীনাথ ত্রিপাঠী’। তাঁর বক্তৃতাগুলো নিয়ে একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ‘সময়-সে পার’ নামে। ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপল অ্যাক্ট, ১৯৫১’ নিয়ে কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আজও আইনজীবীদের কাছে জরুরি। ১৯৯৯ সালে লন্ডনে ষষ্ঠ হিন্দি কনফারেন্সে তিনি খুব জোরালোভাবে হিন্দি ভাষার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে সুরিনামে অনুষ্ঠিত বিশ্ব হিন্দি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। কেশরীনাথের ভ্রমণের নেশা প্রবল। তিনি সারা বিশ্বের প্রায় ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে তিনি সফর করেছেন। 

কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তাঁর কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে নানবিধ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। যে সমস্ত পুরস্কার তিনি লাভ করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভারত গৌরব সম্মান’, ‘বিশ্বভারতী সম্মান’, ‘উত্তরপ্রদেশ রত্ন সম্মান’, ‘হিন্দি গরিমা সম্মান’, ‘আচার্য মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদী পুরস্কার’, ‘সাহিত্য বাচস্পতি সম্মান’, ‘কাব্য কৌস্তভ সম্মান’ ইত্যাদি। 

২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান