সববাংলায়

কীর্মির রাক্ষস

মহাভারতের বনপর্বের একাদশ অধ্যায়ে ভীমের হাতে কীর্মির নামক রাক্ষসের মৃত্যুর কথা বর্ণিত আছে। পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পান্ডবরা দেবী দ্রৌপদী ও পুরোহিত ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসে চলে যান। তাঁরা প্রথমে বসবাস করতে শুরু করেন কাম্যক নামে এক বনে।সেখানে একদিন বিদূর পান্ডবদের কাছে আসেন। বিদূরকে দেখে যুধিষ্ঠিরের ভয় হয়েছিল, বুঝি আবার পাশাখেলার ডাক আসে। কিন্তু বিদূর সেজন্য আসেননি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন পান্ডবদের ফিরিয়ে আনার কথা, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র রেগে গিয়ে বিদূরকে চলে যেতে বলায় অভিমান করে বিদূর পান্ডবদের কাছে চলে আসেন। 

এদিকে বিদূর চলে যাওয়াতে ধৃতরাষ্ট্রের ভয় হল যে বিদূরের মতো ধার্মিক ও বিচক্ষণ ব্যক্তি যদি পান্ডবদের পক্ষে যোগদান করেন, তবে তাঁদের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে। সুতরাং তিনি সঞ্জয়কে ডেকে বিদূরকে ফিরিয়ে আনতে বললেন। সঞ্জয় কাম্যক বনে গিয়ে অনেক সন্ধান করে বিদূরকে ফিরিয়ে আনলেন। 

বিদূর ফিরে আসার পর একদিন মহর্ষি ব্যাসদেব ও মহামুনি মৈত্রেয় ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য হস্তিনাপুরে আসেন। তাঁরা দুজনেই ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেন পান্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করে তাঁদের সম্পদ ও রাজ্য তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাঁদের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করার জন্য। অন্যথায় মহা সর্বনাশ হবে। ঋষি মৈত্রেয় দুর্যোধনকে বললেন পান্ডবদের অনিষ্টচিন্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন পান্ডবদের উপর দেবতাদের অনুগ্রহ আছে এবং পান্ডবরা বক, হিড়িম্ব, কীর্মির প্রভৃতি অনেক দেবশত্রু শক্তিশালী রাক্ষসদের বধ করেছেন। দুর্যোধন পান্ডবদের বিরোধিতা করলে তাঁরা কিন্তু দুর্যোধনকে ছেড়ে দেবেন না। এই সকল উপদেশ দুর্যোধনের মনে ধরল না। তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে নিজের ঊরুতে আঘাত করতে লাগলেন এবং পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগলেন। নিজের উপদেশবাক্যের প্রতি এহেন উপেক্ষা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন ঋষি মৈত্রেয়। দুর্যোধনকে অভিশাপ দিলেন, তেরো বছর পর মহা সংগ্রামে মহাবলশালী ভীম গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরু ভঙ্গ করবেন।

আরও পড়ুন:  দুর্গাপূজা

এই অভিশাপ শুনে ভীত হলেও কীর্মির রাক্ষস বধের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন ধৃতরাষ্ট্র। বক ও হিড়িম্ব রাক্ষসের কাহিনী জানা থাকায় ঋষি মৈত্রেয়কে কীর্মির রাক্ষসের কাহিনী বলার অনুরোধ করলেও তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে চলে গেলেন এবং বিদূরের কাছে এই কাহিনী জেনে নিতে বললেন। বিদূরকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, পাশাখেলায় পরাজিত পান্ডবরা তিন দিন ধরে ক্রমাগত পথ হেঁটে কাম্যক বনে পৌঁছালেন। এই বনটি বড় ভয়ানক, এখানে অনেক ভয়ঙ্কর রাক্ষস বাস করে। রাক্ষসের ভয়ে সমস্ত লোকজন সেই স্থান থেকে পালিয়ে গেছেন। পান্ডবরা সেই বনে প্রবেশ করা মাত্রই দেখলেন এক বিশাল রাক্ষস তাঁদের পথ আটকে গর্জন করছে। তার চেহারা অতি বিশাল, চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, চুলগুলি অনেক লম্বা এবং পিঙ্গল বর্ণের এবং দাঁতগুলি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেই রাক্ষস বিরাট দুই হাত বাড়িয়ে পান্ডবদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অনেক মায়া সৃষ্টি করে তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ককরতে লাগলো। কিন্তু পুরোহিত ধৌম্য মন্ত্র পাঠ করে সমস্ত মায়া দূর করে দিলেন। দেবী দ্রৌপদী সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসকে দেখে ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন যুধিষ্ঠির রাক্ষসকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন।

রাক্ষস ঘোরতর শব্দ করে উত্তর দিলো যে তার নাম কীর্মির। সে মহাবীর রাক্ষস বকের ভাই এবং হিড়িম্ব নামক রাক্ষসের প্ৰিয় বন্ধু। এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির নিজের এবং সকল পান্ডবের পরিচয় দিলেন এবং পাশাখেলায় হেরে বনবাসে আসার কথাও জানালেন। কিন্তু ভীমের নাম শুনতেই রাগে জ্বলে উঠল কীর্মির। কারণ ভীমই তার ভাই বক ও বন্ধু হিড়িম্বকে বধ করেছিলেন। রাগে উন্মত্তপ্রায় রাক্ষস ভীমকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করল। ভীম কিছুমাত্র ভয় পেলেন না। তিনি একটা গাছ উপড়ে তুলে নিয়ে কীর্মিরকে আক্রমণ করলেন। কীর্মিরও একটা গাছ তুলে নিয়ে ভীমের দিকে তেড়ে এলো। দুই জনে শুরু হল ভীষণ যুদ্ধ। রাক্ষস ছিল অনেক শক্তিশালী। ফলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে বীরবিক্রমে ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করল। গাছ ভেঙে গেলে প্রথমে পাথর এবং তারওপরে কুস্তি শুরু হল। কিন্তু আস্তে আস্তে কীর্মির নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকল।

আরও পড়ুন:  মহিষাদলের রথযাত্রা

শেষে ভীম তার হাত-পা মুচড়ে ধরে তাকে উপরে তুলে বন বন শব্দে ঘোরাতে শুরু করলে সে বিকট গর্জন করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর তার গলা টিপে ধরে তার শ্বাসরুদ্ধ করে ভীম কীর্মির রাক্ষসকে বধ করলেন। রাক্ষস বধের পর পান্ডবেরা সকলেই উচ্চ কণ্ঠে ভীমের প্রশংসা করতে করতে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

বিদূর আরো বললেন যে তিনি যখন পান্ডবদের সাথে দেখা করতে কাম্যক বনে গিয়েছিলেন তখন তিনি স্বচক্ষে সেই রাক্ষসের মৃতদেহ দেখেছেন এবং সেখানে উপস্থিত ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে এই কাহিনী শুনেছেন। ভীমের এই প্রবল ক্ষমতার কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র নিজের পুত্রদের ভবিষ্যত চিন্তা করে অত্যন্ত ভীত হলেন এবং বিদূরকে বিদায় দিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবে গেলেন।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, বনপর্ব, অধ্যায় ৮-১১, পৃষ্ঠা ৪০৮-৪১৪
  2. ‘উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র’,উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ‘ছেলেদের মহাভারত’, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২২৬-২২৭9

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন

জয় মঙ্গলবার ব্রত নিয়ে দেখুন এই ভিডিওতে



ছবিতে ক্লিক করুন