পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হুগলী জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল কোন্নগর (konnagar)। এই জনপদটি শ্রীরামপুর সাবডিভিশনের অন্তর্গত উত্তরপাড়া থানা এবং কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে রয়েছে।
ভৌগোলিক দিক থেকে কোন্নগর ২২.৭০০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩১০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। হুগলী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই জনপদ রিষড়া ও হিন্দমোটরের মাঝে অবস্থিত।
পঞ্চদশ শতকে ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ কাব্যে এবং বিপ্রদাস পিপলাইয়ের লেখা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের পুঁথিতে প্রথম কোন্নগরের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের কাব্যটি ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যেও কোন্নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু কীভাবে এই জনপদের নাম এলো তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন কোনারগড় থেকে কোন্নগর নামের উৎপত্তি, আবার কেউ বলেন কুমার গড় থেকে প্রথমে অপভ্রংশে কোনারগড় এবং পরে কোন্নগর নামের উৎপত্তি ঘটে। কোন্নগরের প্রাচীন অধিবাসীরা মনে করেন এই জনপদে আগে পর্তুগিজদের একটি জাহাজঘাঁটি ছিল। এই অঞ্চলে পর্তুগিজ গভর্নর নান দ্য কুনাহ্-র শাসনের কথা জানা যায়। তাঁর নামানুসারেই এই অঞ্চল প্রথমে কুনারগড় এবং পরে কোন্নগর বলে পরিচিত হয়। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের বণিক খণ্ডে দেখা যায় ধনপতি সদাগর কোন্নগর কোতরং পেরিয়ে যাবার সময় নদীতীরে দেখতে পান ‘কুচিনান’ বলে একটি জনপদ। এই কুচিনানই সম্ভবত পর্তুগিজ গভর্নর নান দ্য কুনাহ্ যিনি চন্দনগর ও হুগলির কাছাকাছি অঞ্চলে থাকতেন ১৫৬০ থেকে ১৫৭০ সাল নাগাদ।
কোন্নগরের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং তা কয়েকটি খণ্ড খণ্ড উপাদানের সমাহারে গড়ে উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে শিবচন্দ্র দেবের হাতে এই অঞ্চলের পুনর্নির্মাণ ঘটে। এই জনপদেই জন্ম হয় শিবচন্দ্র দেবের এবং পরে হিন্দু কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিওর ‘নব্যবঙ্গ’ দলের সদস্য হন তিনি। আজকের কোন্নগরের উন্নতির পিছনে অনেকাংশেই তাঁর অবদান রয়েছে। শিবচন্দ্র দেবের হাত ধরেই এখানে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় গড়ে ওঠে ১৮৫৪ সালে। প্রাচীন নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণদের মধ্যে সে নিয়ে অনেক বিক্ষোভ দেখা দিলেও শিবচন্দ্রের কাজে কোনো বাধা পড়েনি। শিবচন্দ্রের স্কুল তৈরির আগে এই জনপদে মহামহোপাধ্যায় শ্রীদীনবন্ধু ন্যায়রত্ন মহাশয়ের টোলই ছিল একমাত্র শিক্ষাঙ্গন। আধুনিক কোন্নগরের রূপকার বলা হয় শিবচন্দ্র দেবকে। ১৮৫৮ সালে তিনি এখানে একটি বাংলা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। তাছাড়া কোন্নগরে আগে কোনো রেলস্টেশন ছিল না। শিবচন্দ্র দেবের উদ্যোগেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রথম রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। শিবচন্দ্র দেবের উদ্যোগেই এখানে প্রথম ডাকঘরও স্থাপিত হয় ১৮৫৮ সালে। তিনি কোন্নগরে একটি ‘হিতৈষিণী সভা’ স্থাপন করেছিলেন। একবার ভয়ানক ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে এবং কলকাতাতেও। ১৮৮৩ সালের সেই দুঃসময়ে শিবচন্দ্র নিজে হোমিওপ্যাথি ডিসপেন্সারি খুলে গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা শুরু করেন। এর পাশাপাশি শিবচন্দ্র দেব এখানে প্রথম সঙ্গীত বিদ্যালয়, নৈশ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মসমাজ তৈরি করেছিলেন। ১৯৩১ সালে বিখ্যাত জুতো ব্যবসায়ী টমাস বাটা কোন্নগরেই প্রথম জুতোর কারখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ১৯৩১ সালের মে মাস নাগাদ টমাস বাটা তাঁর ভাই জান আন্তোনিন বাটার কাছে এই ব্যবসায়িক পরিকল্পনাটি বিক্রি করেন এবং সেই পরিকল্পনা অনুসারে বাটানগরে বাটার জুতো কারখানা তৈরি হয় প্রথম। পূর্ণচন্দ্র বসুর উদ্যোগে কোন্নগরে প্রথম স্বদেশি দেশলাই কারখানা তৈরি হয়।
কোন্নগরের আলিনগর শিবমন্দির, রাজরাজেশ্বরীতলা দ্বাদশ মন্দির, রামমিত্রদের জয়কালীমাতার মন্দির, শকুন্তলা মায়ের মন্দির প্রভৃতি এই জনপদের সুপ্রাচীন ইতিহাসের পরিচয় বহন করে আর ছিল পঞ্চু দত্তের ঘাট ও শ্মশানঘাট। অধুনা কোন্নগরের বাঘের খাল ও হাতির কুলের মাঝে প্রায় পঞ্চাশ বিঘে জমি প্রাচীনকালে আলিনগর নামে পরিচিত ছিল। নবাবী আমলে নাকি এই অঞ্চলে নবাবেরা হাতি চরাতেন এবং নবাবদের হাতিশালাগুলি ছিল সব এই অঞ্চলেই। হাতি পরিচর্যা করার কারণে এই অঞ্চলের নাম ছিল হাতিরকুল আর এখানেই ছিল একটি শিবমন্দির। যদিও এখন আর সে মন্দির পাওয়া যায় না। হাতিরকুল অঞ্চলের ভট্টাচার্য বংশের মানুষেরা হাটখোলার দত্ত পরিবারের লোকেদের সুবিধের জন্য ১৭৪২ শকাব্দে এই কোন্নগরেই নির্মাণ করেছিলেন দ্বাদশ শিবমন্দিরের ঘাট। ক্রীড়া-সংস্কৃতির ইতিহাসে হুগলির প্রথম মহিলা ভলিবল ক্লাব গড়ে উঠেছিল এই কোন্নগরেই। অচিরা গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রেয়সী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজলী চট্টোপাধ্যায় এই ক্লাবের পক্ষ থেকে একসময় জাতীয় ভলিবল দলে খেলেছিলেন বলে জানা যায়। কোন্নগরের ফ্রেণ্ডস ইউনিয়ন এবং কোন্নগর অলিম্পিক ক্লাবদুটি আজও স্থানীয় ক্রীড়া-সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
পরবর্তীকালে রাজা দিগম্বর মিত্র, ডা. ত্রৈলোক্যনাথ মিত্র প্রমুখ বিখ্যাত সব ব্যক্তির জন্ম হয়েছে কোন্নগরে। মহান জাতীয়তাবাদী নেতা এবং যুগান্তর দলের অন্যতম সদস্য অরবিন্দ ঘোষের জন্মও এই জনপদে। বিশিষ্ট পদার্থবিদ শিশিরকুমার মিত্র এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ শফিউর রহমানও কোন্নগরেরই মানুষ ছিলেন। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম শিষ্য তথা ভক্ত নবাইচৈতন্য মিত্র এবং শ্রী মনমোহন মিত্রের জন্মও এই জনপদের মাটিতেই। অনেক মহান মানুষের পদধূলি পড়েছে এই জনপদে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে করা হয় অনেক ছোটোবেলায় কলকাতায় ডেঙ্গুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে তাঁর পরিবার এই কোন্নগরে এসে উঠেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি কোন্নগরের ব্রাহ্মসমাজ ঘাট পরিদর্শন করতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। অধুনা কোন্নগর হাই স্কুলের কাছে জি.টি.রোডের ধারেই একসময় শিবরাম চক্রবর্তীর বাল্য ও শৈশবের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে। এখানকার কোন্নগর হাই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলে বিখ্যাত বাঙালি ভৌগোলিক শশিভূষণ চট্টোপাধ্যায় যিনি বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
কোন্নগরে প্রাচীনকালে সংস্কৃত শিক্ষার চল ছিল। শিবচন্দ্র দেবের হাত ধরেই এখানে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার স্কুল চালু হয়, সেই সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি বজায় রাখতে একটি বাংলা স্কুলও চালু করেন তিনি। তবে তাঁর বহু আগে এখানে শ্রী শম্ভুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুত্রদের আর্থিক সাহায্যে একটি টোল তথা চতুষ্পাঠী গড়ে উঠেছিল মহাপণ্ডিত যজ্ঞেশ্বর চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে। যজ্ঞেশ্বর চক্রবর্তী এই চতুষ্পাঠীতে কাব্য, ব্যাকরণ, সাংখ্য, বেদান্ত, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয় পড়াতেন। শিবচন্দ্র দেব যে ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন তা পরে ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়লে তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় তার সংস্কার করে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারাপ্রসন্নের উদ্যোগেই এখানে ১৯৪০ সালে গড়ে ওঠে কোন্নগর আভাবতী বালিকা বিদ্যালয়। এছাড়া কোন্নগরের প্রাচীন বিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল রাজেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়। কোন্নগরের বিখ্যাত বিদ্যালয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কোন্নগর হিন্দু গার্লস হাই স্কুল এবং কোন্নগর বয়েজ হাই স্কুল। এছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য নিকটবর্তী নবগ্রামে ১৯৫৭ সালে স্থাপিত হয়েছে নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজ।
কোন্নগরের ভট্টাচার্য বাড়ির ৩০০ বছরের বেশি প্রাচীন দুর্গাপুজো এখানকার ঐতিহ্যের এক বিশেষ অংশ। প্রথমে ত্রিপুরায় হতো এই পুজো, পরে তা চলে আসে নবগ্রামে। জানা যায় এখানে নাকি দেবী দুর্গাকে পান্তাভাত ভোগ দেওয়া হয়। এখানকার সাধুর ঘাটে বহু প্রাচীনকাল থেকে আঠারো হাত বিশিষ্ট দুর্গার পুজো হয়ে আসছে। আজ থেকে ৯৪ বছর আগে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রথম তান্ত্রিক সূর্য নারায়ণ সরস্বতী মহারাজ কালীমাতার আশ্রমে এই পূজা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়া প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এখানকার শকুন্তলা মাঠে বইমেলা এবং শিল্পমেলা আয়োজিত হয়। নবগ্রাম হাই স্কুলের মাঠেও বসে বইমেলা এবং তিনদিনের জন্য খাদ্যমেলা বসে জাগৃতি সঙ্ঘের মাঠে।
কোন্নগরের তিলকূট মিষ্টি রসিকমহলে আজও বেশ সমাদৃত হয়।
কোন্নগরের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের পৈতৃক বাড়ি, কোন্নগর ব্রাহ্মসমাজ, কোন্নগর দ্বাদশ শিবমন্দির, পঞ্চু দত্ত ঘাটের জোড়া শিব মন্দির, শকুন্তলা কালী মন্দির, রাজরাজেশ্বরীতলার মন্দির, জয়কালী মন্দির, পরিত্যক্ত বাটার কারখানা ও দিনেমারদের বন্দর, বিশালাক্ষী তলার মন্দির এবং শঙ্করাচার্যের মঠ ইত্যাদি।
ইতিহাস লুপ্ত হয়ে যায় দৃশ্যত। কিন্তু থেকে যায় ইতিহাসের ছায়া। সেই ছায়াতেই বেড়ে উঠেছে কোন্নগর। স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার অভাবে মুছে গেছে বহু স্মৃতিচিহ্ন। হুগলি পাড়ের এই জনপদ ক্রমবর্ধিষ্ণু। মনসামঙ্গল বা চণ্ডীমঙ্গলের সময় থেকে দীর্ঘ যাত্রায় একটা বিরাট ইতিহাসকে বুকে নিয়ে চলেছে কোন্নগর, সে যাত্রা চলছে আজও।
One comment