ভুয়ো কাগজ দেখিয়ে জমি-জায়গা, বিষয়-সম্পত্তি আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে জীবিত মানুষকে মৃত বানানোর ঘটনাও ঘটেছে ভারতে। এমন জালিয়াতির ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিল লালবিহারী মৃতাক মামলা (Lal Bihari Mritak Case)। দেশের জমি-জায়গা বিক্রি করতে গিয়ে লালবিহারী নামের এক ব্যক্তি জানতে পারেন যে তিনি বহুদিন আগেই তাঁর গ্রাম পঞ্চায়েতের খাতায় মৃত, ফলে তাঁর কোনও অধিকারই নেই জমি বিক্রি করার। নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার তাগিদে কম চেষ্টা করেননি তিনি। অবশেষে ১৮ বছর পরে সুবিচার পান লালবিহারী মৃতাক। ভারতের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
১৯৭৭ সালে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতে লালবিহারী মৃতাক এই মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৪ সালে দীর্ঘ ১৮ বছর পরে এই মামলার সুবিচার পান লালবিহারী মৃতাক।
১৯৫৫ সালে উত্তরপ্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম আজমগড়ে জন্মেছিলেন এই মামলার প্রধান বিবাদী পক্ষ কৃষক লালবিহারী। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তিনি। মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁকে একটি শাড়ির কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কাজ করে অর্থ উপার্জনের জন্য। ২২ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালে তিনি যখন নিজের একটি কাপড়ের কারখানা খুলতে চাইলেন, সেই সময় প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে লালবিহারীর। ব্যাঙ্কে ঋণ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করলে ঋণের বিনিময়ে ব্যাঙ্ক তাঁর থেকে কিছু জামানত চাইছিল। এই সময় বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমির দলিল সংগ্রহের জন্য নিজের গ্রাম আজমগড়ের খলিলাবাদে চলে আসেন এবং খলিলাবাদের সরকারি কর অফিসে যোগাযোগ করেন। এখান থেকেই তিনি প্রথম জানতে পারেন যে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য ও নথি প্রমাণে তিনি মৃত। নিজে সশরীরে উপস্থিত থেকেও তিনি প্রমাণ করতে পারেননি যে সেই সব তথ্য-প্রমাণ আসলে ভুয়ো। এর ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর সমস্ত জমি-জায়গা চলে যায় তাঁর কাকার অধিকারে। কারখানা খুলতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন লালবিহারী মৃতাক। এরপরেই শুরু হয় দীর্ঘ ১৮ বছরের আইনি লড়াই। কিছুদিনের মধ্যে তিনি জানতেও পারেন যে তাঁর কাকাই সরকারি কর্মচারীদের প্রচুর ঘুষ দিয়ে জাল নথি তৈরী করেছে এবং পুরো গ্রামে তাঁর মারা যাবার ঘটনাকে সত্য বলে প্রচার করেছে। এর জন্য লালবিহারীর নামে থাকা ১ একর জমির এক-পঞ্চমাংশ ভাগ তাঁর কাকা দিয়েছিলেন সেই নথি-সংরক্ষক ব্যক্তিকে। লালবিহারী এই মামলা চলার সময়েই সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর বাকি জীবনটা এই রকম খাতায়-কলমে মৃত অথচ জীবিত অসহায় বঞ্চিত মানুষদের সহায়তায় উৎসর্গ করবেন এবং সেই কারণেই তিনি নিজের নামের শেষে ‘মৃতাক’ পদবী গ্রহণ করেন এবং গড়ে তোলেন ‘মৃতাক সঙ্ঘ’ বা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর লিভিং ডেড’ (The Association for the Living Dead)। ১৯৭৭ সালে ‘টাইম’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জীবিত মৃতের দুর্দশা’ (Plight of the Living Dead) শিরোনামের একটি সংবাদের প্রেক্ষিতেই এই মামলার সূচনা হয়। এই ঘটনার প্রতিকারের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছেন লালবিহারী। তাঁর কাকা বাবুরাম যিনি সরকারি কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিলেন, তার ছেলেকে অপহরণ করান লালবিহারী। একজন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেহেতু অপহরণের মামলা করা যায় না, তাই পুলিশ এবং বাবুরামের পরিবার কেউই এ ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়নি। কিছুদিন পরে বাধ্য হয়ে তাঁর ভাইপোকে ছেড়ে দেন লালবিহারী। এরপরে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তাঁর নামে দাঙ্গা বাধানোর মিথ্যা মামলা রুজু করার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ অফিসার তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অভিযোগ দায়ের করতে অস্বীকার করেন এবং ঘুষের টাকাও ফিরিয়ে দেন। কিছুদিন পরে তাঁর জীবিত স্ত্রীর জন্য বিধবা ভাতার আবেদন করেন লালবিহারী। তিনি ভেবেছিলেন স্ত্রীর বিধবা ভাতার আবেদনের সময় স্বামী হিসেবে লালবিহারীকে জীবিত চোখের সামনে দেখে দপ্তরের কর্মীরা এই আবেদন গ্রহণ করবেন না আর সেটাই হবে লালবিহারী মৃতাক মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। কিন্তু এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হল। সরকারি কর্মীরা অন্যান্য আরও কিছু কারণে তাঁর বিধবা ভাতার আবেদন বাতিল করে দেন। তাঁর এই সব ব্যতিক্রমী কাজের জন্য সমাজের চোখে তিনি কিছুটা পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং সংসদের এক সদস্য তাঁকে মৃত ঘোষণা করার বিষয়টি সংসদে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এরপরে সংসদের প্রবেশের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে লালবিহারী সেখানে স্লোগান তোলেন ‘মুঝে জিন্দা করো’ আর এভাবেই তিনি বহু মানুষের নজরে আসেন। পরে যদিও নিরাপত্তা-রক্ষীরা তাঁকে তুলে বাইরে নিয়ে চলে যায়। ১৯৮৮ এবং ১৯৮৯ সালে পরপর দুবার তিনি লোকসভা নির্বাচনে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং এবং পরবর্তী মন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। প্রথম নির্বাচনে ১৬০০ ভোট পেয়েছিলেন লালবিহারী এবং তারপরই দেশের সংবাদমাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি, তাঁর বহু সাক্ষাৎকার নেওয়া হতে থাকে।
দীর্ঘ ১৮ বছরের লড়াইয়ের পর ১৯৯৪ সালে লালবিহারী মৃতাক মামলা সমাপ্ত হয়। মামলা চলাকালীন মানবাধিকার সুরক্ষা আইন, ১৯৯৩-এর ১৪ এবং ৩৬ নং ধারা এবং ভারতীয় সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুযায়ী আদালতের বিচারপর্ব চলে। এলাহাবাদ উচ্চ আদালত লালবিহারীকে জীবিত বলে ঘোষণা করে। মামলার গুরুত্ব অনুধাবন করে আদালত মামলার প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং মামলা চলাকালীন সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সহ এটিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে হস্তান্তরিত করে।
এই মামলার পাশাপাশি ভারতে সেই সময় লালবিহারীর মত আরও কয়েকজন বঞ্চিত মানুষ ছিলেন যারা জীবিত থেকেও খাতায়-কলমে মৃত ছিলেন। তাদের হয়ে কথা বলার জন্য, তাদের সুবিচার দেওয়ার জন্য ২০০৮ সালে লালবিহারী একটি আরটিআই অভিযোগপত্র দায়ের করেন যা থেকে জানতে পারা যায় যে, সমগ্র উত্তরপ্রদেশে আগে থেকে মৃত ঘোষিত ৩৩৫ জন জীবিত ব্যক্তি ছিলেন সেই সময়। লালবিহারীর গড়ে তোলা ‘মৃতাক সঙ্ঘ’ এই দাবিতে প্রভূত উদ্যোগী হয়েছিল। সমগ্র ভারতে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই সঙ্ঘের সদস্য হয়েছেন। এই সঙ্ঘের প্রচেষ্টার ফলেই সঙ্ঘের ৪ সদস্যকে আইনিভাবে জীবিত ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন লালবিহারী। তাঁর জীবন ও বঞ্চনার অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে ২০২১ সালে বিখ্যাত বলিউড অভিনেতা সলমন খানের প্রযোজনায় এবং সতীশ কৌশিকের পরিচালনায় একটি ছবি মুক্তি পায় ‘কাগজ’ নামে যেখানে লালবিহারী মৃতাকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী।