রিচার্ড ফিলিপ্স ফাইনম্যান পদার্থবিদ্যার জগতে এক কিংবদন্তি নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার পরমাণু বোমা বানানোর গোপন কর্মকান্ড ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম প্রথমা স্ত্রী আর্লাইন গ্রিনবাম ছিলেন তাঁর ছোটবেলার প্রেমিকা। আর্লাইনের দূরারোগ্য যক্ষ্মা ধরা পড়লে ফাইনম্যান সিদ্ধান্ত নেন দুজনে বিয়ে করার। বাড়ির অমতেই তাঁরা অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে বিয়ে করেন। ক্রমেই আর্লাইনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। অবশেষে ১৬ জুন ১৯৪৫, পরমাণু বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ঠিক এক মাস আগে মারা গেলেন আর্লাইন। মৃত্যুর প্রায় দু’বছর বাদে মৃত স্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে একটি হৃদয়বিদারক চিঠি লেখেন ফাইনম্যান। রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখা সেই চিঠি টির ভাবানুবাদ নিচে দেওয়া হল –
অক্টোবর ১৭, ১৯৪৬
প্রিয় আর্লাইন,
আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, তোমার জন্য অনেকখানি আদর,
আমি জানি তুমি এই কথাটা শুনতে কতটা ভালবাসো – কেবল তুমি শুনতে ভালোবাসো বলেই আমি এটা লিখছি তা কিন্তু নয় – আমি লিখছি কারণ তোমাকে এই কথা কটা বলতে গিয়ে প্রত্যেকবার আমি বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক উষ্ণতা অনুভব করি।
শেষবার তোমায় চিঠি লিখেছিলাম – তাও প্রায় দু’বছর আগে। জানি আমায় ক্ষমা করে দেবে তুমি কারণ তুমি তো জানো, আমি মানুষটা ঠিক কেমন একগুঁয়ে, বাস্তববাদী। আসলে আমি ভেবেছিলাম তোমাকে চিঠি লেখার আদৌ কোন যৌক্তিকতা নেই।
কিন্তু আজ বুঝতে পেরেছি প্রিয়তমা যা করে উঠতে পারিনি এখনো, যা করতে দেরী করেছি তা এখনও করা যায় এবং এটা আমি আগেও বহুবার করেছি। আমি তোমায় বলতে চাই – আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই। আমি চিরকাল এভাবেই তোমাকে ভালবেসে যেতে চাই।
আমি নিজেকে অনেক কষ্টে বোঝাতে চেষ্টা করছি মৃত্যুর পরেও তোমাকে ভালবাসার অর্থ কী – কিন্তু বিশ্বাস কর আমি এখনও তোমার যত্ন নিতে চাই, তোমাকে দুদণ্ড শান্তি দিতে চাই। আমি প্রবল কোন সমস্যায় পড়তে চাই যা নিয়ে আমি তোমার সাথে আলোচনা করতে পারি- তোমার সাথে ছোট হলেও কোন একটা প্রকল্প প্রস্তুতিতে মেতে উঠতে চাই। আমি অবশ্য ভাবিনি কখনও আমরা এক সাথে আবার আগের মত কাজ শুরু করতে পারি। আচ্ছা একসাথে দু’জনে কি কাজ করা যায় বলো তো? আমরা তো একসাথে পোশাক তৈরি শিখতে পারি বা ধর একসাথে চাইনিজ শিখতে পারি কিংবা প্রজেক্টরে কোন সিনেমাও দেখতে পারি ! এখন কি আর নতুন করে কিছুই শুরু করতে পারি না বলো? না। পারিনা। বিশ্বাস করো তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ একা। তুমিই তো আমার সমস্ত ভাবনা চিন্তার উৎস। আমাদের সমস্ত রোমাঞ্চকর রোমহর্ষক কাজে তুমিই তো আমার এক এবং অবিচল অনুপ্রেরণাদাত্রী ছিলে !
তুমি যখন অসুস্থ ছিলে আমার মনে আছে তুমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলে এই ভেবে যে অনুপ্রেরণা তুমি আমাকে এতদিন দিয়ে আসতে তা এখন দিতে পারছো না। তোমার এই অহেতুক দুশ্চিন্তার কোন যৌক্তিকতাই আমি খুঁজে পাইনি কারণ তোমার আমার মধ্যে এক অনন্ত অকৃত্রিম প্রেম রয়েছে। আমি বিশ্বাস করে এসেছি চিরকাল তোমার প্রতি আমার অন্তরের অনুভূতি প্রকাশের অজস্র মাধ্যম রয়েছে। এই মুহূর্তে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে – তুমি আমায় এখন আর কিছুই দিতে পারবে না এটা জেনেও আমি তোমাকে ভালবেসে চলেছি যাতে আমি অন্য কারও প্রতি অনুরক্ত না হয়ে পড়ি। আমি তোমাকে ভালোবেসে চলেছি কারণ আমি চাই আমার মন বিপথগামী হওয়ার আগে তুমি সেই রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকো। তুমি নেই আজ, কিন্তু জীবনের চেয়েও বেশি প্রতিভাত হয়ে আমার বুকের গভীরে তুমি বিরাজ করছ আর্লাইন।
আমি জানি, আমি জানি তুমি আমাকে বোকা বলবে, বলবে তুমি চাও আমি যেন সুখী থাকি, বলবে তুমি আর আমার জীবন প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাও না। আমি বাজি রেখে বলতে পারি তোমার না থাকার দুই বছর বাদেও আমার কোন বান্ধবী (একমাত্র তুমি)নেই এই কথাটা তুমি বিশ্বাস করবে না। কি করব বল, এটা না তোমার হাতে আছে না আমার হাতে – আমি নিজেও জানিনা কেন আমি এখনও কাউকে ভালবেসে উঠতে পারলাম না। জীবনে অনেক নারীর সাথে আলাপ হয়েছে – প্রকৃত অর্থেই তারা অনন্যা আর এটাও সত্যি আমি জীবনে একাকী বাঁচতে চাইনা- কিন্তু দু’তিনটে সাক্ষাতেই তাদের প্রতি আমার সমস্ত উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে গেছে। রয়ে গেলে কেবল তুমি … আমার মন জুড়ে আমার হৃদয় জুড়ে আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে আদি ও অকৃত্রিমভাবে।
আমার আদরের স্ত্রী, তোমার জন্যে অনেক অনেক আদর রইল।
রিচ
বিঃদ্রঃ – এই চিঠিটা ডাকে পাঠালাম না বলে ক্ষমা করে দিও। আসলে আমি তোমার নতুন ঠিকানাটা জানিনা।