লেভ ইয়াসিন

লেভ ইয়াসিন

ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হিসেবে বিখ্যাত পেশাদার সোভিয়েত ফুটবল খেলোয়াড় লেভ ইয়াসিন (Lev Yashin)। খেলার জগতে মূলত তিনি ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ কিংবা ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর শারীরিক সক্ষমতা। সাহসিকতা, পজিশন নেওয়ার দক্ষতা, অ্যাক্রোব্যাটিক প্রতিবর্ত ঝাঁপ ইত্যাদির কারণেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফুটবল ফেডারেশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদেও আসীন ছিলেন তিনি। ফুটবল দলের সামগ্রিক রক্ষণভাগে গোলরক্ষক হিসেবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সুবাদে তিনি যথেষ্ট মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। গোলপোস্টে দাঁড়িয়েও দলের ডিফেণ্ডারদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন লেভ। যেখানে বেশিরভাগ গোলরক্ষকেরা তাঁদের নির্দিষ্ট অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকেই উপযুক্ত সময়ে গোল বাঁচানোর অপেক্ষা করেন, লেভ ইয়াসিন তার বদলে আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের আসার মুখে সামনে এগিয়ে গিয়ে বল ধরতে ভালোবাসতেন। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে তাঁর দক্ষতার প্রদর্শন বিশ্ব জুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের মন কেড়েছিল। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২০০২ সালের ফিফা বিশ্বকাপের ড্রিম টিমের জন্যও নির্বাচিত হন লেভ। ফিফার পরিসংখ্যান অনুযায়ী লেভ ইয়াসিন বিশ্বকাপে ১৫০টিরও বেশি পেনাল্টি কিক রক্ষা করেছেন। তাছাড়া ১৯৫৬ সালের অলিম্পিক ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং ১৯৬০ সালের ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জয় করেছেন তিনি। ১৯৬৩ সালে তিনিই একমাত্র গোলরক্ষক ছিলেন যিনি ব্যালন ডি’অর পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৩ সালে রাশিয়ান ফুটবল ইউনিয়ন বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবথেকে অসামান্য খেলোয়ার হিসেবে লেভ ইয়াসিনকে রাশিয়ার ‘গোল্ডেন প্লেয়ার’ নির্বাচিত করে।

১৯২৯ সালের ২২ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে এক শিল্পকারখানার শ্রমিক পরিবারে লেভ ইয়াসিনের জন্ম হয়। তাঁর মাত্র বারো বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাধ্য হয়ে একটি কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু মাত্র আঠারো বছর বয়সের আগেই একটি স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন লেভ ইয়াসিন । ফলে এরপরে মস্কোতে একটি মিলিটারি ফ্যাক্টরিতে কাজে পাঠানো হয় লেভ ইয়াসিনকে। ঠিক এই সময়েই ফ্যাক্টরির দলে খেলার সময় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েন তিনি এবং তার ফলে মস্কোর ‘ডায়নামো মস্কো’ দলে খেলার জন্য আহ্বান পান লেভ। পরবর্তীকালে ভ্যালেন্টিনা টিমোফেয়েভনা নামের এক মহিলাকে বিবাহ করেন লেভ ইয়াসিন এবং তাঁদের দুই কন্যার নাম যথাক্রমে ইরিনা ও এলিনা। তাঁর নাতি ভাসিলি ফ্রোলভ বর্তমানে ডায়নামো মস্কোর ইয়ুথ দলে গোলরক্ষক হিসেবে খেলেন এবং তাঁর আরেক নাতি ২০০২ সালে একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। এছাড়া তাঁর এক নাতনিও এখন জীবিত আছেন।

১৯৫০ সালের একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচের মধ্য দিয়ে ‘ডায়নামো মস্কো’ দলের হয়ে তাঁর ফুটবল খেলা শুরু হয়। কিন্তু এই শুরুর ম্যাচটি তাঁর জন্য সুখকর ছিল না। প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের পায়ের শট বাঁচাতে না পারায় গোল স্বীকার করতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেই বছর আরো দুটি লিগ খেলেন। তাঁর দক্ষতার অনুপাতে ১৯৫৩ সালে সিনিয়র খেলোয়াড়দের দলে খেলার সুযোগ পাননি লেভ ইয়াসিন । কিন্তু ভবিষ্যতে আরো ভালো পজিশনে খেলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। অন্য আরো সুযোগের অপেক্ষায় ডায়নামো দলে রিজার্ভ ওয়েটিং-এ রয়ে যান লেভ। সিনিয়র স্কোয়াডে খেলার জন্য তিনি ডায়নামো আইস হকি দলের হয়ে গোলরক্ষকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ইউএসএসআর আইস হকি কাপ জেতেন লেভ ইয়াসিন এবং গোলরক্ষক হিসেবে ঐ ম্যাচে তিনি তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ডায়নামো মস্কো দলের সঙ্গেই লেভ ইয়াসিন পেশাদার ফুটবলের গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন তিনি। সেই সময় পাঁচবার ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন এবং তিনবার সোভিয়েত কাপ জয় করেন তিনি। এই ক্লাবে তাঁর সতীর্থ, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পরামর্শদাতা ছিলেন অ্যালেক্সি টাইগার খোমিচ। এই খোমিচ ডায়নামো মস্কো দলের ব্রিটিশ সফরে গোলরক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও ১৯৫৩ সালে ভালটার সানায়া নামে আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধেও খেলেছিলেন লেভ ইয়াসিন। ১৯৫৪ সালে লেভ ইয়াসিনকে সোভিয়েত জাতীয় দলে খেলার জন্য আহ্বান করা হয়, এই জাতীয় দলের সঙ্গেই লেভ ১৯৫৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, প্রথম ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান নেশনস কাপ জয় করতে সক্ষম হন। ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৬৬ সালে পরপর তিনটি বিশ্বকাপে যোগ দেন তিনি। বিশ্বকাপের ফাইনালে মোট ১২টি ম্যাচের মধ্যে ৪টি ম্যাচে পরাজিত হন লেভ ইয়াসিন। ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে লেভ ইয়াসিন ব্যালন ডি’অর পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে টুর্নামেন্ট চলাকালীন আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত দলকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি, কিন্তু ফাইনালে চিলির দলের কাছে পরাজিত হন লেভ। এই ম্যাচে তাঁর স্বভাবের বাইরে গিয়ে কিছু ভুল করেন লেভ। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলায় লেভ ডেভিড ম্যাকরোলের কাছে একটি কর্নার কিকে গোল খান। যদিও সেই ম্যাচে ৪-৪ গোলে একটি টাই হয় দুই দলের মধ্যে। চিলির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে একটি দারুণ গোল বাঁচান লেভ ইয়াসিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২-১ গোলে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাতিল হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬২ সালে বিশ্বকাপে পরাজয় সত্ত্বেও ১৯৬৩ সালে ব্যালন ডি’অর পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি। ঐ বছরই ইংল্যাণ্ড বনাম রেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডের ম্যাচে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শট রক্ষা করেন লেভ ইয়াসিন। তিনি সব সময় একটি পৃথক কালো পোশাক পরতেন বলে দর্শক-অনুরাগীদের কাছে তিনি ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ নামে পরিচিত হন। দর্শকরা মনে করতেন মাকড়সার মতো আটটি হাতে তিনি সব গোল বাঁচিয়ে দিতেন। পোড়া ইঁট রঙের একটি টুপি পরে সবসময় খেলতে নামতেন লেভ ইয়াসিন। ১৯৬৬ সালে ইংল্যাণ্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে লেভের অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শনে সোভিয়েত ইউনিয়ন দল চতুর্থ স্থান অর্জন করে। ১৯৭০ সালে চতুর্থবার লেভ মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে যোগ দেন এবং তৃতীয় পছন্দের ব্যাক-আপ ও একজন সহকারী প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় সোভিয়েত দল কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ১৯৭১ সালে মস্কোতে শেষবারের জন্য তিনি ডায়নামো মস্কো দলের হয়ে খেলেন। লেভ ইয়াসিনের প্রশংসামূলক ফিফা ম্যাচটিতে প্রায় এক লক্ষ দর্শক-অনুরাগী উপস্থিত ছিলেন এবং পেলে, ফ্রাঞ্জ বোকেনবাওয়ার সহ আরো অনেক ফুটবল তারকারাও উপস্থিত ছিলেন।

খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পরে ডায়নামো মস্কো দলে বিভিন প্রশাসনিক পদে বহাল ছিলেন প্রায় ২০ বছর। পরবর্তীকালে মস্কোর ডায়নামো স্টেডিয়ামে লেভ ইয়াসিনের একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে বুদাপেস্টে থাকাকালীন থ্রম্বোফ্লেবিটিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর একটি পা অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে ‘সোভিয়েত সম্মানিত মাস্টার অফ স্পোর্টস’ হিসেবে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

১৯৫৩ সালে আইস হকিতে একজন গোলরক্ষক হিসেবে খেলে লেভ সোভিয়েত কাপ অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালেই ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করার জন্য তিনি আইস হকি ছেড়ে দেন।

ফুটবলের ইতিহাসে লেভ ইয়াসিন কে সর্বশ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক মানা হয়। তাঁর অধিক উচ্চতার কারণে গোলপোস্টের মধ্যে গোল বাঁচানোর ক্ষেত্রে তিনি একটু বাড়তি সুবিধে পেতেন বলে অনেকেই মনে করেন। তাঁর সমগ্র ক্রীড়া জীবনে মোট ১৫১টি পেনাল্টি কিক থামিয়েছেন যা ইতিহাসে আর কোনো গোলরক্ষক করতে পারেননি। দেশের প্রতি দায়িত্বপালন ও সেবাকর্মের জন্য ১৯৬৭ সালে তাঁকে ইউএসএসআর-এর সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘অর্ডার অফ লেনিন’ সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৯৪ সালে ফিফা তাঁর নামে শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হিসেবে ‘লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড’ চালু করে। ‘ওয়ার্ল্ড সকার’ পত্রিকার সমীক্ষায় বিশ শতকের সেরা ১০০ খেলোয়াড়ের মধ্যে লেভ ইয়াসিন ছিলেন অন্যতম। তাঁর জীবনী অবলম্বনে ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর ওলেগ কাপানেৎজ-এর পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ‘লেভ ইয়াসিন : গোলি অফ মাই ড্রিমস’ নামে।  

১৯৯০ সালের ২০ মার্চ পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লেভ ইয়াসিনের মৃত্যু হয়।   

আপনার মতামত জানান