হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়

হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়

হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় (Haricharan Bandopadhayaya) ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, পন্ডিত এবং অভিধান-প্রণেতা যিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ৫ খন্ডে প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনা করে। বাংলা ভাষায় সাহিত্য এবং বিভিন্ন অভিধান রচনার ক্ষেত্রে এই শব্দকোষের ভূমিকা অপরিসীম।

হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ১৮৬৭ সালের ২৩ জুন চব্বিশ পরগনা জেলার রামনারায়ণপুর গ্রামে মামার বাড়িতে জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বসিরহাটের মশাইকাটি গ্রামে। তাঁর বাবা নিবারণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় এক জমিদারের কাছারিতে কাজ করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল জগৎমোহিনী দেবী।হরিচরণের প্রাথমিক শিক্ষা মশাইকাটি‌ গ্রামের বিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউট’-এ ভর্তি হন যা পরে ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রবেশিকা ও এফএ পরীক্ষায় পাস করার পর বৃত্তি নিয়ে ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে’ (পরবর্তীকালে যা ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’ নামে পরিচিত) বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন এই কলেজের সভাপতি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে বৃত্তি পান সেজন্য চিকিৎসক চন্দ্রমোহন ঘোষ এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুপারিশপত্র লিখেছিলেন। ফলে বৃত্তি পেতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। কিন্তু যখন তিনি বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, সেই সময় তাঁর বাবার  মৃত্যু হলে অর্থাভাবে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯০১ সালে কলকাতা টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্কুলের প্রধান পন্ডিত নিযুক্ত হন। এরপর স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে পরের বছর তিনি রবীন্দ্রনাথের জমিদারির অন্তর্গত পতিসরের কাছারিতে সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। পতিসরে জমিদারি পরিদর্শনে এসে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণের জ্ঞানচর্চায় আগ্রহ লক্ষ্য করে তাঁকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯০২ সাল থেকে তিরিশ বছর তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ রচনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এই কাজ শেষ হবার আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর এক গুরুদায়িত্বের ভার দিলেন তাঁকে। তাঁর শিক্ষাকতায় নিষ্ঠা এবং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিধান রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর অভিপ্রায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন বিখ্যাত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।

কিন্তু এই রচনা কার্য ছিল অত্যন্ত দুরূহ। পাঁচ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে শব্দ সংগ্রহ করেছেন। তারপর তিনি রচনা শুরু করেন। এই সময় শান্তিনিকেতনে প্রচন্ড অর্থাভাব দেখা দেয়। তাই ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে তিনি কলকাতায় সেন্ট্রাল কলেজের সংস্কৃত পড়ানোর দায়িত্ব নেন। কিন্তু শিক্ষকতা এবং অভিধান রচনার কাজ একইসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের সহায়তায় বিদ্যানুরাগী ও দানশীল রাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী মাসে ৫০ টাকা বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে প্রথম নয় বছর ৫০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর ৬০ টাকা করে বৃত্তি পেতেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯২৩ সালে অভিধান রচনার প্রাথমিক পর্যায় শেষ হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৪০ বছরের সাধনার ফসল ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচিত হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কিন্তু শব্দকোষ রচিত হলেও, টাকার অভাবে বই ছাপা সম্ভব হল না। রবীন্দ্রনাথ চেয়ে ছিলেন বিশ্বভারতী থেকে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হোক। এজন্য তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু এই বিপুল আকৃতির শব্দকোষ ছাপার জন্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা প্রয়োজন। নানাভাবে চেষ্টা করেও অর্থ জোগাড় করা গেল না। ফলে রচিত হবার পর প্রায় দশ বছর পাণ্ডুলিপি পড়ে রইল অপ্রকাশিত অবস্থায়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার পুরো অভিধানটি সংশোধন করে রাখেন। অবশেষে বহু কষ্টে প্রকাশক  পাওয়া গেল। ‘বিশ্বকোষ’-এর নগেন্দ্রনাথ বসু। কিন্তু তিনি একটি শর্তে বইটি প্রকাশ করতে রাজী হলেন; কাগজের দাম আগাম দিতে হবে, ছাপার খরচ পরে দিলেও চলবে। হরিচরণ এই শর্তে রাজি হলেন। নিজের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে বই প্রকাশ করলেন তারপর ১৩ বছর ধরে মোট একশো পাঁচটি খন্ড প্রকাশিত হলো। বিশ্বভারতী কোনরকম কমিশন ছাড়াই অভিধান বিক্রির ব্যবস্থা করল। এই কাজে অর্থ সাহায্য করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাড়াজোলার মহারাজা, আশ্রমিক সংঘ এবং বিশ্বভারতী সংসদ কর্তৃপক্ষ। শব্দকোষ প্রকাশিত হবার পর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাজ সর্বস্তরে প্রশংসিত হতে থাকে। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ‘হরিজন’ পত্রিকায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারের সঙ্গে তাঁর তুলনা করেন। নিজের রচিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুদক্ষিণা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে অর্পণ করেছিলেন।

বাংলা অভিধানের গুরুত্ব বিবেচনায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান দুটিই সর্বাপেক্ষা পরিচিত। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান শব্দার্থের গভীর ও ব্যাপকতর অর্থ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ছাড়াও এ অভিধানে আছে ইংরেজি, পর্তুগিজ, হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শব্দ। তিনি শব্দার্থ স্পষ্ট করতে বাংলা সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন; আবার একটি শব্দের পূর্ণ পরিচিতির জন্য সংস্কৃত থেকেও আবশ্যকীয় উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর রচিত এই শব্দকোষ বাংলা ভাষার এক অতুলনীয় সম্পদ।

তাঁর মৃত্যুর পর (১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে) সাহিত্য একাডেমী থেকে দুই খণ্ডে অভিধানটি প্রকাশ করা হয়। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ছাড়াও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’, ‘সংস্কৃত-প্রবেশ'(৩ খন্ড), ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’, ‘Hints on Sanskrit Composition & Translation’, ‘পালিপ্রবেশ’, ‘শব্দানুশাসন’, ‘কবির কথা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। ইংরেজ কবি ম্যাথু আর্নল্ডের কিছু কবিতার অনুবাদও করেছিলেন তিনি।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক’, ১৯৫৪ সালে ‘শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ (ডিলিট) উপাধিতে ভূষিত করেন।
‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ -এর মত একটি দুরূহ কার্যের দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব নেওয়ার ফলে, শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। যদিও সে নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিল না বরং তিনি বলতেন, ‘গুরুদেবের কাজে চোখদুটো উৎসর্গ করতে পেরেছি এটাই আমার পরম সান্ত্বনা’। মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা হওয়ার পর থেকে আমৃত্যু তিনি শান্তিনিকেতনেই শিক্ষকতা করেছেন।

১৯৫৯ সালের ১৩ জানুয়ারি হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

5 comments

আপনার মতামত জানান