বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ যে সমস্ত দিকপাল সঙ্গীতসাধকের সুরসাধনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শ্যামল মিত্র (Shyamal Mitra) তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। তিনি কেবলমাত্র একজন সুকন্ঠী গায়কই ছিলেন না, একাধারে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যেমন তাঁর পরিচিতি, তেমনি চলচ্চিত্র প্রযোজনার কাজও করেছিলেন তিনি৷ কেবল বাংলা নয়, বহু হিন্দি চলচ্চিত্রেও তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ লক্ষ্য করা যায়। শ্যামল মিত্রের ব্যারিটোন কন্ঠস্বরে আবেগের মূর্ছনা আজও আপামর বাঙালির হৃদয় আন্দোলিত করে তোলে। ‘আইপিটিএ’র (IPTA) একজন একজন সক্রিয় কর্মী এবং সঙ্গীতশিল্পী সলিল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। এমনকি আইপিটিএ-র হয়ে পথযাত্রায় গানও গেয়েছিলেন। প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালক এবং গায়ক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেই সময়ের আরও দুই দিকপাল গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে-র প্রতিভার দীপ্তিতে হারিয়ে যাননি শ্যামল, বরং নিজের অনবদ্য সঙ্গীত নির্মাণ এবং গায়কীর মাধ্যমে এক স্বতন্ত্র আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন। মহানায়ক উত্তমকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ছবির জন্য সঙ্গীত নির্মাণ করেছিলেন তিনি। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। উত্তমকুমার অভিনীত ‘দেয়া নেয়া’ চলচ্চিত্রে তাঁর অনবদ্য সঙ্গীত পরিচালনা আজও বাঙালিকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। তাছাড়াও বাঙালির প্রাণের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তেও গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। কেবলমাত্র আধুনিক বাংলা গানই নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী গানেও তিনি সমানভাবে শ্রোতার হৃদয় জয় করেছিলেন।
১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি কলকাতার নিকটবর্তী নৈহাটিতে এক শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে শ্যামল মিত্রের জন্ম হয়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল শিয়াখালার নিকটবর্তী পাটুলে। শ্যামল মিত্রের বাবা সাধনকুমার মিত্র (Sadhan Kumar Mitra) ছিলেন নৈহাটির একজন নামকরা চিকিৎসক। ফলত তাঁর বাবা চেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পেশায় একজন ডাক্তার হয়ে উঠুক। কিন্তু শ্যামল ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে তাঁর মা এবং স্থানীয় গায়ক মৃণালকান্তি ঘোষ তাঁকে প্রভূত অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শ্যামল মিত্রদের বাড়ির কাছেই নৈহাটি স্টেশনের অপর পাড়ে তখন থাকতেন সাহিত্যিক সমরেশ বসু। যদিও একজন সাহিত্যিক পরিচয়ে নয়, নিতান্ত পাড়ার আত্মীয়ের মতো তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল শ্যামলের। পরবর্তীকালে শ্যামল মিত্র চেয়েছিলেন সমরেশের ‘বিবর’ উপন্যাসটি নিয়ে উত্তমকুমারকে নায়কের ভূমিকায় নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে। কিন্তু অশ্লীলতার দায়ে ‘বিবর’ উপন্যাসকে আদালত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তখন। পরবর্তীকালে সেই নিষিদ্ধ তকমা উঠে গেলেও আর ছবি তৈরির দিকে যাননি শ্যামল। তাছাড়া উত্তমকুমারও ততদিনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। শ্যামল মিত্রের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি কেটেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিগর্ভ দিনগুলিতে। বাড়িতে সেসময় আইপিটিএ-র (IPTA) সদস্যদের আনাগোনা লেগেই থাকত। বাড়িতে কোনও কোনও রাতে পঁচিশ-তিরিশজন লোক হঠাৎ এসে পড়তেন। রাতে একসঙ্গে ঘুমোতেনও তাঁরা। এমনই একটি পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন শ্যামল। আইপিটিএ-র একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য বিখ্যাত গায়ক এবং সুরকার সলিল চৌধুরীও সেই সময় তাঁদের বাড়িতে আসতেন এবং শ্যামলের সঙ্গে সলিলের এক হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন শ্যামল ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। পরবর্তীকালে সলিল চৌধুরীর হাত ধরেই বম্বে গিয়েছিলেন তিনি। যাই হোক, পরবর্তীকালে শ্যামল নিজেও আইপিটিএ-র সদস্য হন। আইপিটিএ-র হয়ে শ্যামল এবং তাঁর ছোট বোন রেবা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গান গাইতেন। শ্যামল মিত্রদের নৈহাটির বাড়িতে ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ও এসেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে প্রতিমা মিত্রের বিবাহ হয়। তাঁদের দুই পুত্র শৈবাল মিত্র এবং সৈকত মিত্র এবং এক কন্যা মনোবীণা। সৈকত মিত্র পরবর্তীকালে তাঁর বাবা শ্যামল মিত্রের গান গেয়েই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করবার পর হুগলি মহসিন কলেজে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। মহসিন কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই কলেজ জীবন তাঁর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহসিন কলেজেই তখন তিনি পরিচিত হয়েছিলেন আধুনিক সঙ্গীত জগতের আরেক দিকপাল সঙ্গীতসাধক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কলেজে পড়াকালীন সতীনাথ তাঁকে কলেজের এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য জোর করেছিলেন। সম্ভবত সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ই তাঁকে বলেছিলেন যে নৈহাটিতে পড়ে থাকলে তাঁর আর গানের জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হবে না এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতায় যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। সতীনাথের সেই পরামর্শ শিরোধার্য করে শ্যামল মিত্র কলেজের পড়াশোনা শেষ করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চলে এসেছিলেন কলকাতার চক্রবেড়িয়ায় নিজের পিসির বাড়ি। উল্লেখ্য যে, কলকাতার সেই ঠিকানার খুব কাছেই, উল্টোদিকে গিরিশ মুখার্জি রোডে তখন থাকতেন উত্তমকুমার। মূলত উত্তম তখন নাটকে অভিনয় করছেন এবং চলচ্চিত্রে অভিনয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অতএব খুব সহজেই উত্তমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় শ্যামলের।
কলকাতায় শ্যামল মিত্রের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল ঘটেছিল যখন তিনি বিখ্যাত গায়ক সুধীরলাল চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুধীরলালের গান শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন শ্যামল যে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন তিনি এবং সংকল্প করেছিলেন সুধীরলালের কাছ থেকেই সঙ্গীতশিক্ষা গ্রহণ করবেন। এই উদ্দেশ্যেই ১৯৪৬ সালে চক্রবেড়িয়া থেকে শ্যামল সোজা গিয়ে উঠেছিলেন লেক মার্কেটের মেসে এবং সেখান থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুধীরলালের বাড়ি পাঁচ নম্বর জনক রোডে।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে শ্যামল মিত্র ১৯৪৯ সালে প্রথম প্লে-ব্যাক করার সুযোগ পেয়েছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে। এছাড়াও সুধীরলাল চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে এইচএমভি থেকে শ্যামল মিত্র তাঁর প্রথম মৌলিক গান রেকর্ড করেছিলেন। সুধীরলালের দুঃখজনক মৃত্যুর পর শ্যামল মিত্র ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ গানটি রেকর্ড করেন। এরপর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমে ক্রমে বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীতকারদের মধ্যে অন্যতম একজন হয়ে ওঠেন শ্যামল মিত্র।
পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক জুড়ে নানা স্বাদের চলচ্চিত্রের জন্য গান করেছেন এবং সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সাধন সরকার পরিচালিত এবং ছবি বিশ্বাস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত হাস্যরসের ছবি ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। এছাড়াও ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ বা ‘ভ্রান্তিবিলাসে’র মত জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সঙ্গীত নির্মাণেও অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তবে কেবলমাত্র সঙ্গীত পরিচালনাই নয়, পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ অবধি বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক গায়ক হিসবেও কাজ করেছিলেন শ্যামল। ‘অন্তরাল’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘কেরী সাহেবের মুন্সি’, ‘লালপাথর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘শশীবাবুর সংসার’-এর মতো চলচ্চিত্রে তাঁর কন্ঠ এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল।
তবে ১৯৬৩ সালে উত্তমকুমার ও তনুজা অভিনীত ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে শ্যামল মিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা বাংলা ছায়াছবির জগতে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এই চলচ্চিত্রের কাজকেই তাঁর সঙ্গীত জীবনের সর্বোত্তম কাজ বললেও অত্যুক্তি হয় না। উত্তমকুমারের অতুলনীয় লিপ-সিং এবং শ্যামল মিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীতময়তাকে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। এরপর ‘রাজকন্যা’, ‘খেয়া’, ‘আমি সে ও সখা’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’র মত ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন শ্যামল মিত্র। কেবলমাত্র সুরকার, গায়ক বা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি, কিন্তু শ্যামল মিত্র চলচ্চিত্র প্রযোজনার কাজও করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অজিত লাহিড়ী পরিচালিত এবং উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ অভিনীত ‘গড় নসিমপুর’ চলচ্চিত্রের পরিবেশক এবং প্রযোজক ছিলেন তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রেই কেবল তাঁর কাজ আবদ্ধ থাকেনি। পঞ্চাশের দশকের গোড়াতে তিনি সঙ্গীতশিল্পী সলিল চৌধুরীর সঙ্গে গিয়েছিলেন বম্বেতে। পরিচালক বিমল রায় যখন সলিল চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত বাংলা ছায়াছবি ‘রিকশাওয়ালা’র রিমেক ‘দো বিঘা জমিন’-এর সঙ্গীতের জন্য সলিল চৌধুরীকে আহ্বান জানান তখন তাঁর সঙ্গেই বম্বেতে গিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। সেখানে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে একটি দ্বৈতভাবে গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। বম্বেতে ‘মুসাফির’, ‘বিরাজ বৌ’ এবং ‘নকরি’ এই তিনটি ছবিতে সঙ্গীতের কাজ করেছিলেন শ্যামল। পরবর্তীকালে আরেকবার ১৯৭৩ সালে বম্বে পাড়ি দিয়েছিলেন শ্যামল। সেবার শক্তি সামন্তের ছবি ‘অমানুষ’ (১৯৭৫) এবং ‘আনন্দ আশ্রম’-এ (১৯৭৭) কাজ করেছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য যে উপরিউক্ত দুটি ছবিরই একটি করে বাংলা সংস্করণ ছিল এবং উভয় ছবিতেই উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও সেবার বম্বেতে গিয়ে এফ. সি মেহেরার ছবি ‘বন্দী’ এবং বাসু চ্যাটার্জীর চলচ্চিত্র ‘সফেদ ঝুট’ ও ‘মমতা’তে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন শ্যামল মিত্র।
সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি যেসব বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বসু, সুপ্রীতি ঘোষ, তালাত মাহমুদ, কিশোর কুমার প্রমুখ। বিখ্যাত বাংলা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে জুটি বেঁধে করা শ্যামল মিত্রের কাজগুলি অমর হয়ে থাকবে। তাঁদের তৈরি করা ‘ঝিরি বাতাস কাঁদে’ কিংবা ‘তোমার ওই ধূপছায়া রং শাড়ির পাড়ে’র মত গান আজও বাঙালি আবেগভরে উপভোগ করে।
শ্যামল মিত্রের কন্ঠে জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে রয়েছে ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’, ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’, ‘নাম রেখেছি বনলতা’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ প্রভৃতি।
উত্তমকুমারের সঙ্গে শ্যামল মিত্রের বন্ধুতা এবং হৃদ্যতা বাঙালির জন্য এক বড় পাওনা ছিল নিঃসন্দেহে। শ্যামল-উত্তম জুটি যে সমস্ত গানের এবং দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে তার সঙ্গে তুলনীয় আর কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘দেয়া নেয়া’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘ধনরাজ তামাং’-এর মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র তাঁদের দুজনের যৌথ প্রতিভার দীপ্তিতে আজও ভাস্বর হয়ে রয়েছে। উত্তমকুমারের সঙ্গেই সবচেয়ে অধিক এবং সফলতম কাজগুলি করেছিলেন শ্যামল মিত্র।
চলচ্চিত্রের বাইরে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল শ্যামল মিত্রের। বাঙালির প্রাণের অনুষ্ঠান বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ, বাণীকুমারের রচনা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীতে সমৃদ্ধ ‘মহিষাসুরমর্দিনী‘ বা ‘মহালয়া’তেও আরতি মুখোপাধ্যায় এবং অসীমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামল মিত্র গেয়েছিলেন ‘শুভ্র শঙ্খ রবে’ গানটি।
আধুনিক বাংলা গান ছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদের গান এমনকি ছোটোদের গানের মত বিভিন্ন ঘরানার গান গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। বাংলা এবং হিন্দি ছাড়াও অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষাতেও গান গেয়েছিলেন তিনি। এমনকি সঙ্গীত নির্মাতা হিসেবে ‘বিবি আনন্দময়ী’ নামে একটি যাত্রাপালতেও কাজ করেছিলেন শ্যামল মিত্র। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এবং ‘শাপমোচন’ ছবিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি।
১৯৬৯ সালের ২১ মে বুধবার রাত তিনটে বেজে কুড়ি মিনিটে একটি কনসার্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন শ্যামল মিত্র। দুর্ঘটনার পর শিশুমঙ্গল হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল, তবে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার পর ১৯৬৯ সালে ‘পান্না হীরে চুনী’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছিলেন শ্যামল মিত্র। সেই ছবির সবকটি গানই প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
গানবাজনা ছাড়া খেলাধুলাতেও দক্ষ ছিলেন শ্যামল মিত্র। অনবদ্য ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতেন। ফুটবলও খেলতেন ভালো, এমনকি নিয়মিত খেলাধুলার খোঁজখবর রাখতেন। ভীষণ মজা করতে পছন্দ করতেন তিনি। মদ্যপানেরও অভ্যাস ছিল তাঁর। কখনও স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতেও যেতেন মদ্যপান করে। তবে শেষদিকে বিশেষত উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর মদ্যপানের পরিমাণ অত্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর ৫৮ বছর বয়সে শ্যামল মিত্রের মৃত্যু হয়।