সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরী (Salil Choudhury) একজন ভারতীয় বাঙালি গীতিকার তথা সুরকার এবং কবি যাঁর গোটা জীবনটাই কেটেছে সঙ্গীতের নিত্যনতুন রূপপ সৃষ্টির কাজে। আধুনিক বাংলা গানের জনক হিসেবে এবং গণসংগীতের অগ্রদূত হিসেবে সলিল চৌধুরী এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রায় চল্লিশটির বেশি বাংলা, পঁচাত্তরটি হিন্দি, প্রায় ছাব্বিশটি মালয়ালাম এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন  

১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার গাজীপুর গ্রামে সলিল চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরী এবং মায়ের নাম বিভাবতী চৌধুরী। পেশায় ডাক্তার ছিলেন সলিলের বাবা এবং সেই সুবাদে ছোটবেলার অনেকটাই আসামের বিভিন্ন চা বাগানে কেটে গেছে আট ভাইবোন সহ তাঁদের গোটা পরিবারের। সলিল চৌধুরী ছাড়াও সঙ্গীত নিয়ে ভবিষ্যতে নিজের পরিচয় তৈরি করেন তাঁর ছোটভাই সুভাষ চৌধুরী যিনি পরবর্তীকালে আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে শিল্পী জ্যোতি চৌধুরীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন সলিল চৌধুরী এবং তাঁদের তিনটি কন্যা সন্তান হয় – অলকা, তুলিকা এবং লিপিকা। পরবর্তীকালে গায়িকা সবিতা চৌধুরীর সাথে তাঁর বিবাহ হয় এবং তাঁদের দুই পুত্রসন্তানের নাম সুকান্ত ও সঞ্জয়, দুই কন্যাসন্তানের নাম অন্তরা ও সঞ্চারী। গায়িকা হিসেবে প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন তাঁর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর প্রচুর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ১০০টির বেশী চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে সাফল্যের সাথে কাজ করেছেন তাঁদের পুত্র সঞ্জয় চৌধুরী এবং শিশুশিল্পী হিসেবে ছোটদের গান গেয়ে দেশ জুড়ে খ্যাতি পাওয়া কন্যা অন্তরা তাঁর বাবার সঙ্গীতের ধারাকে আজও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সলিল চৌধুরীর কন্যা পরিচয় ছাড়াও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে বহু ভাষার গানে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।

হরিনাভি ডি ভি এ এস হাই স্কুল থেকে ১৪ বছর বয়সে মাধ্যমিক পাশ করার পরে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষাপর্ব সম্পূর্ণ করেন সলিল চৌধুরী। কিন্তু এই প্রথাগত শিক্ষার সাথে সমানতালে চলছিল আরেক প্রশিক্ষণপর্ব। বাবার শখের গ্রামোফোন রেকর্ডের হাত ধরে সেই শৈশব থেকেই পরিচয় বাখ, বিঠোফেন, মোৎজার্ট, চাইকভস্কি’র সৃষ্টির সাথে। রোজ সকালে ঘুম ভাঙত এক মায়াময় পরিবেশের মধ্যে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিষ্টি সুর ভেসে বেড়াতো আসামের জঙ্গল ঘেরা চা বাগানের আনাচে কানাচে। পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়ে দাদার সাথে সলিল এসে হাজির হলেন সুকিয়া স্ট্রীটে তাঁর জ্যাঠার বাড়িতে। সেখানে তখন “মিলন পরিষদ” নামে একটি অর্কেস্ট্রা শুরু করেছেন তাঁর জেঠতুতো দাদা নিখিল চৌধুরী। দাদার ঘরেই প্রথম পরিচয় পিয়ানো, বেহালা, বাঁশি’র মতো শব্দ যন্ত্রের সাথে। সে এক দারুণ আনন্দের সময়। মিলন পরিষদের মহড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া, পিয়ানোতে কাঁচা হাতে মোৎজার্টের সিম্ফনির কোনও অংশ বাজিয়ে দাদাদের তাক লাগিয়ে দেওয়া ছাড়াও, আরও একটা মজার ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকার সুযোগ এসে গেলো। বাড়ির কাছেই ছায়া সিনেমায় তখন দেখানো হত নির্বাক ছবি। পর্দার আড়াল থেকে সেই ছবির সাথে সুরসঙ্গত করার সুযোগ পেয়েছিল মিলন পরিষদ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে পরিচিত হওয়ার এমন সুযোগ অনেকের কপালেই জোটেনি। শৈশবের পরবর্তী পর্যায়ে বেশ কিছু বছর তাঁকে কাটাতে হল বারুইপুরের কাছে তাঁর মামার বাড়িতে। সে এক অন্য পৃথিবী। বিশাল বাড়ি, বাগানজোড়া আম, লিচু, কাঁঠালের স্বাদ, দাদু, দিদিমা, মামাদের বুকভরা ভালোবাসা, কিন্তু একটা ছোট্ট জিনিসের অভাব। সঙ্গীত। পরবর্তী ৫-৬ বছর সলিল চৌধুরীর সুরের সাথী বলতে গেলে একটা ছোট্ট বাঁশের বাঁশি। দীর্ঘদিন ধরে এই বাঁশিই ছিল সঙ্গীতের সাথে তাঁর একমাত্র যোগসূত্র। আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাইশে শ্রাবণ বিশ্বকবির মৃত্যুতে অশৌচ পালন করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একবারই খুব দূর থেকে দেখার সুযোগ পেলেও আরও অগণিত অনুরাগীর মতো স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করতে পেরেছিলেন সলিল চৌধুরী।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ছাত্রাবস্থার এই সময়ে ঘটে এক অদ্ভুত পালাবদল। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে থাকা এক সহপাঠীর সাথে আলাপ হয় হোস্টেলে থাকাকালীন। সেখান থেকেই শুরু হয় রাজনীতির চর্চা। এও এক অন্যতর পৃথিবীর হাতছানি। শিক্ষার শেষ পর্যায়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনের সাথে। তাঁর পরবর্তী কয়েকটি বছর কেটে যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং সুন্দরবন অঞ্চলে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে। সঙ্গীত নয় সংগ্রামই তখন তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা হয়ে উঠেছে। নিজের চোখে দেখেন চুয়াল্লিশের মন্বন্তর। মানুষেরই তৈরি এই দুর্ভিক্ষে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষকে কলকাতার পথেঘাটে মরে পরে থাকতে দেখেন উনিশ বছরের সলিল। এরই মধ্যে যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আই পি টি এ(Indian Peoples Theater Association) তে এবং সেই সাথে কম্যুনিস্ট পার্টিতে। দীর্ঘদিন পুলিশের চোখ বাঁচিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকার সময়, নিজের ভেতরেই গুনগুনিয়ে উঠেছে নানান সুর, গানের বিষয়, কথা। সেইগুলিই এক সময় কণ্ঠে উঠে আসে, যখন গায়ক এবং সুরকার হিসেবে নিজের প্রথম ছাপ রাখছেন আই পি টি এ’র ছোটবড় সম্মেলনে। ঘরে বসে বৈঠকি মেজাজে নয়, তাঁর প্রতিটি গানের আত্মপ্রকাশ হয়েছে বিশাল রাজনৈতিক জনসভার মঞ্চতে। সুর ও কথা হাত ধরাধরি করে চলেছে “আমার প্রতিবাদের ভাষা”, “বিচারপতি তোমার বিচার”, “ঢেউ উঠছে”, “হেই সামাল ধান হ”র মতো ইতিহাস সৃষ্টিকারী গণসংগীতগুলিতে। যে পথে একদিন বাঁশি হাতে একাই চলতে শুরু করেছিলেন, এক সময় ফিরে দেখলেন বেশ কিছু সহযাত্রী জুটে গেছে, যাঁরা মনে করছিলেন শুধু সংগ্রাম নয়, সঙ্গীতই তাঁর নিজের ক্ষেত্র, সেখানে তাঁর অনেককিছুই দেওয়ার আছে,পাওয়ার আছে। চল্লিশের দশকের শেষ ভাগে, স্বাধীন হওয়ার পরেপরেই যখন “কোনও এক গাঁয়ের বধু”, “রানার” রেকর্ড হয়ে বের হল, সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করছিল আই পি টি এর সহযোদ্ধাদের সাথে। সেই সময় শুধু গণসংগীত শিল্পী হিসেবেই নয়, উদীয়মান সুরকার হিসেবে তাঁর নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি হচ্ছিল বাংলা সঙ্গীত জগতে। ক্রমেই বাড়তে থাকা এই বিভেদের ফলে দলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হল তাঁকে।

১৯৪৯ সালে ‘পরিবর্তন’ ছবিতে সঙ্গীত নির্দেশক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এরপরের কয়েকটি বছরে বরযাত্রী, পাশের বাড়ি ছবির সাফল্য তাঁকে নতুন দিশা দেখায়। সংসারের দায়িত্ব তখন অনেকটাই তাঁর উপর। বেশকিছু বিজ্ঞাপনের গানও তৈরি করেছিলেন এই সময়। ডি জে কীমারের জন্য লিপটন চায়ের বিজ্ঞাপনে সুর দিতে গিয়ে আলাপ হল তরুণ, আর্ট ডিরেক্টর সত্যজিৎ রায়ের সাথে। তিনিও জানতে চান, এমন সম্ভাবনাময় সুরকার কেন এইসব কাজ করছেন। উত্তর একটাই, সংসার চালাতে হবে, বাবা মৃত্যুশয্যায়। সেই কাজের পারিশ্রমিক সেদিন বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সলিল। গর্বিত বাবা সেটি বালিশের নীচে রেখে দেন। পরেরদিনই বাবার মৃত্যু হলে, সেই অর্থেই বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল।

রাতারাতি জীবনের মানে পাল্টে যাচ্ছিল সলিলের কাছে। রিকশাওয়ালা নামে একটি গল্প লিখেছেন, কাঁচা হাতে স্ক্রিপ্টও তৈরি করেছেন। বন্ধু ঋষিকেশ মুখার্জির হাত ধরে পৌঁছে গেলেন বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের কাছে। সেই গল্পের হাত ধরেই ১৯৫৩ সালে বোম্বাইযাত্রা এবং ‘দো বিঘা জমিন’ নামের এক টুকরো ইতিহাসের সৃষ্টি।

বাংলা গানে হারমনির ছোঁয়া দিয়েছেন আই পি টি এর সময় থেকেই, কিন্তু বোম্বাইয়ে পা রেখে গায়কি, সুর, অবলীগ্যাটো বা কাউন্টার মেলোডির মতো চমকপ্রদ সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গোটা দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অপার ভাণ্ডারের সাথে আসামের চা বাগান, গ্রামবাংলার মেঠো সুর মিলিয়ে এক ঐশ্বরিক মিশ্রণ তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী যার স্বাদ তাঁকে কালজয়ী করে তুলছিল। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মুকেশ, মান্না দে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সহ সমসাময়িক সব শিল্পীই কণ্ঠ দিয়েছেন তাঁর গানে। সেই গানের দীর্ঘ তালিকা এবং এত বছর পরেও তাঁদের জনপ্রিয়তা তাঁর প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে। ‘মধুমতি’ ছবির ‘আজা রে পরদেসি’র স্রষ্টাই যে ‘হাফ টিকিট’ ছবির ‘চিল চিল চিল্লাকে কজরি সুনায়ে’র সুর দিতে পারেন তা না শুনলে আজও বিশ্বাস করা শক্ত।

সলিল চৌধুরী বিশ্বাস করতেন ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, আর সেই ভাষার জোরেই সমান প্রভাব রেখে যেতে পেরেছেন দক্ষিণ ভারতীয় ছবির সুরের মধ্যে। ১৯৬৪ সালে ‘চেম্মিন’ ছবির সুর মালায়ালাম ছবির জগতেও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রায় চল্লিশটির বেশি বাংলা, পঁচাত্তরটি হিন্দি, প্রায় ছাব্বিশটি মালয়ালাম এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া চলচ্চিত্রে সুর প্রযোজনা সহ মোট ১৩টি ভাষায় রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার ছাপ। এই দীর্ঘ সময় ধরে একইরকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন বাংলা বেসিক গানের জগতেও। এতদিন ধরে খ্যাতির শিখরে থাকার নজির গোটা পৃথিবীতে খুব বেশী নেই।

সলিল চৌধুরী রাষ্ট্রপতি পদক পান ১৯৬৫ সালে, ১৯৫৮ সালে মধুমতি ছবির জন্য পান ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, আলাউদ্দিন পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান ১৯৮৮ সালে এবং ২০১২ সালে পান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান ।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে, যে সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি আর পাঁচটা মাধ্যমের মতো ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছে সঙ্গীতের জগতকেও, সলিল চৌধুরী উঠে পরে লাগেন সেই ডিজিটাল মাধ্যমের নিজস্ব সাংগীতিক ভাষা তৈরির কাজে। এর অপার সম্ভাবনার বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিলনা তাঁর মনে। কলকাতায় ফিরে এসে নিজের স্টুডিয়ো তৈরি করে শুরু করেন কাজ। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “জীবনের শুরুতে সঙ্গীতকে দেখে মনে হত এক বিশাল মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আজ এসে মনে হচ্ছে, আমি মানুষটা একই আছি, মিনারের উচ্চতাও বিন্দুমাত্র কমেনি”।

সলিল চৌধুরীর ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান