এডগার অ্যালান পো

এডগার অ্যালান পো

বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডার যাঁদের অতুলনীয় লেখনীস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আমেরিকান সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো (Edgar Allan Poe)। উনিশ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ আন্দোলনের একজন প্রধান অগ্রদূত ছিলেন পো। কবিতা এবং কথাসাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিবরণ। স্বপ্ন এবং কল্পনার অভ্যন্তরীণ জগত সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে অন্যদের তুলনায় স্বতন্ত্র করে তুলেছিল। রোমান্টিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তি পো-কে ডার্ক রোমান্টিসিজমের ধারায় অনেকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। তাঁর গল্পের অন্ধকার, বিভৎসতা এবং নৃশংসতার দিকগুলির জন্যই এমন শ্রেণীকরণ। এসব ছাড়াও গোয়েন্দা, কল্পকাহিনির ধারার উদ্ভাবক হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয় তাঁকে, তেমনই উদীয়মান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির ধারায় তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার কাজও যেমন করেছিলেন তিনি আবার সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে আজও রহস্য রয়ে গেছে অনেক (পড়ুন এডগার অ্যালান পো মৃত্যু রহস্য)।

১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে এডগার অ্যালান পো -এর জন্ম হয়। তাঁর বাবা-মা দুজনেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পো-এর বাবার নাম ডেভিড পো জুনিয়র এবং মা এলিজাবেথ আর্নল্ড হপকিন্স পো। ডেভিড এবং এলিজাবেথের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন পো। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম ছিল উইলিয়াম এবং রোজালি নামে একটি ছোট বোনও ছিল তাঁর। পো-এর সঙ্গে তাঁর বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার কোনো অবকাশই তৈরি হয়নি। ১৮১০ সালে পো-এর বাবা পরিবার পরিত্যাগ করে চলে যান। অন্যদিকে যখন পো-এর তিনবছর বয়স তখন তাঁর মা যক্ষ্মা রোগে মারা যান। এরপর উইলিয়াম এবং রোজালির থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে এক সফল ব্যবসায়ী জন এবং তাঁর স্ত্রী ফ্রান্সেস অ্যালানের সঙ্গে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় পো-কে। জন কাপড়, গম, সমাধির পাথর, তামাক, এবং ক্রীতদাসের ব্যবসা করতেন। সেই পরিবার থেকেই এই এডগার অ্যালান পো নামটি তিনি পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। যদিও জনের পরিবারের সঙ্গেও খুব একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাঁর। জন নানারকমভাবে ব্যবহার করতেন পো-কে, কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতেন তাঁকে। আনুষ্ঠানিকভাবে কিন্তু পো-কে তাঁরা দত্তক নেননি। ১৮১২ সালে অ্যালান পরিবার এপিস্কোপাল চার্চ থেকে পো-এর ব্যাপটিজম সম্পন্ন করিয়েছিল।

পো-এর যখন ছয় বছর বয়স অর্থাৎ ১৮১৫ সালে জন সপরিবারে স্বল্প সময়ের জন্য চলে যান ইংল্যান্ডে। পো সেখানে স্কটল্যান্ডের আইরশায়ারের ইরভাইনে একটি গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনো করেন এবং ১৮১৬ সালে লন্ডনে পুনরায় পরিবারের সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে চেলসিতে একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়াশুনা করেন তিনি ১৮১৭ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডন থেকে ৪ মাইল উত্তরে একটি উপশহর স্টোক নিউইংটনের রেভারেন্ড জন ব্রান্সবির ম্যানর হাউস স্কুলে ভর্তি হন। ১৮২০ সালে পো তাঁর পরিবারের সঙ্গে ফিরে আসেন রিচমন্ডে। প্রাচীন এবং আধুনিক ভাষা অধ্যয়নের জন্য ১৮২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পো।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এখানে উল্লেখ্য যে, মাত্র তেরো বছর বয়সেই পো-এর মধ্যে কবি প্রতিভার জাগরণ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর পালক পিতা জন সেই ব্যাপারে উৎসাহ দানের বদলে বরং তাঁকে নিরুৎসাহ করেছিলেন এবং পারিবারিক ব্যবসার দিকেই চালনা করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়িক হিসেবনিকেশের তুলনায় কবিতাই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রাণের সম্পদ। জনের কিছু ব্যবসায়িক কাগজপত্রের পিছনে পো কবিতা লিখেছিলেন বলেও জানা যায়। এহেন জনের সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভালো না থাকায় ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচও জন তাঁকে যোগাননি। সেকারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানোর জন্য জুয়া খেলার দিকে পর্যন্ত ঝুঁকেছিলেন পো যদিও পরে সেটিকে ঘৃণার চোখেই দেখতে শুরু করেন। ঋণের বোঝা জমে যাওয়ায় তিনি একবছর পর বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন কিন্তু রিচমন্ডে আর ফেরত যাননি। ১৮২৭ সালের এপ্রিল মাসে বোস্টন ভ্রমণ করেন তিনি। সম্ভবত মিসেস অ্যালানের থেকে কিছু অর্থ পেয়েছিলেন তিনি। সেসময় কেরানির কাজ, সংবাদ লেখকের কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করেছিলেন পো। সেই সময় পো হেনরি লে রেনেট ছদ্মনাম ব্যবহার করে লেখালিখি করতেন।

১৮২৭ সালের ২৭ মে প্রাইভেট হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর তালিকাভুক্ত হন এডগার। তিনি দাবি করেন সেসময় তাঁর বয়স ছিল বাইশ, কিন্তু আদতে ছিল আঠারো। সেবছরেই পো তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘টেমেরলেন অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ প্রকাশিত হয়। চল্লিশ পৃষ্ঠার এই কবিতার বইয়ে লেখকের স্থানে লেখা ছিল ‘বাই আ বোস্টোনিয়ান’ (by a Bostonian)। মাত্র পঞ্চাশ কপি মুদ্রিত হওয়া এই প্রথম বইটি পাঠকের সমাদর লাভ করতে পারেনি। ১৮২৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মিস ফ্রান্সেস অ্যালানের মৃত্যু হয়। তাঁকে সমাধিস্থ করবার পরদিন পো সেখানে যান। অবশেষে ১৮২৯ সালের ১৫ এপ্রিল পো তাঁর সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। ১৮৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন পো এবং সেখানে তাঁর কবিতার তৃতীয় খন্ড ‘পোয়েমস’ নামে প্রকাশ করেন। সেই বছরই মার্চ মাসে পো ফিরে আসেন বাল্টিমোরে। সেখানে দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটতে থাকে তাঁর। এইসময়েই পো-এর সাহিত্যচর্চা গতি পায়।

বাল্টিমোরে চারবছর ছিলেন পো। এই সময়ে কবিতা থেকে ছোটগল্প রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৮৩৩ সালে সাপ্তাহিক ‘বাল্টিমোর স্যাটারডে ভিজিটর’ কাগজে একটি গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় পো জমা দিয়েছিলেন ‘এমএস. ফাউন্ড ইন আ বটল্’ গল্পটি। এই গল্পটির জন্য প্রথম পুরস্কার পান পো এবং গল্পটি ১৯ অক্টোবর ওই কাগজে প্রকাশিত হয়। এই গল্পটি পড়ে জন পি. কেনেডি নামে এক ব্যক্তি পো-এর সঙ্গে সাদার্ন লিটারারি মেসেঞ্জারের সম্পাদক টমাস ডব্লিউ হোয়াইটের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে এই সাময়িকীর সহকারী সম্পাদক হন পো। সেই পত্রিকা পো-এর অনেকগুলি ছোটগল্প প্রকাশ করেছিল। নিজের লেখার পাশাপাশি দক্ষ সমালোচকের মত অন্যের লেখার পর্যালোচনাও পো করেছিলেন এই পত্রিকার জন্য।
এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৩৬ সালে পো -এর সাথে ভার্জিনিয়া এলিজা ক্লেম নামের তেরো বছর বয়সী এক বালিকার বিবাহ হয়। এরপরের বছরেই পো সাদার্ন লিটারারি মেসেঞ্জারের চাকরিটি হারান। অনেকে বলে থাকেন পো তাঁর অতিরিক্ত মদ্যপানের অভ্যাসের জন্যই সাদার্ন মেসেঞ্জারের চাকরি হারিয়েছিলেন। চাকরি হারানোর পর নিজের স্ত্রী এবং শাশুড়ি মারিয়া ক্লেমকে নিয়ে ফিলাডেলফিয়ায় চলে যান পো। এইসময় তীক্ষ্ণ সমালোচনামূলক লেখার পাশাপাশি ‘দ্য ফল অফ দ্য হাউস অফ আশার’ এবং ‘দ্য টেল-টেল হার্ট’-এর মতো ভৌতিক ও অন্ধকার জগতের গল্প লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত পো-এর উপন্যাস ‘দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গর্ডন পিম অফ নানটাকেট’ ব্যাপক সাড়া জাগায় সমালোচক মহলে। ১৮৩৯ সালের গ্রীষ্মে পো ফিলাডেলফিয়ার ‘বার্টনস জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’ এর সম্পাদক হন। সেখানে অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প এবং রিভিউ প্রকাশ করেন। ১৮৪০ সালে পো-এর ভৌতিক ও অলৌকিক গল্পের সংকলন ‘টেলস অফ দ্য গ্রোটেস্ক অ্যান্ড অ্যারাবেস্ক’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়া এরই কাছাকাছি সময়ে পো রহস্য গল্প রচনাও শুরু করেন। ১৮৪১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত রহস্যগল্প ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’। 

এডগার অ্যালান পো-কে আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের জনক বলে থাকেন অনেকে। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প হল ‘দ্য গোল্ড-বাগ’, ‘মোরেলা’, ‘লস অব ব্রেথ’, ‘হপ-ফ্রগ’, ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’ ইত্যাদি। ১৮৪০ সালের জুন মাসের দিকে বার্টনস ম্যাগাজিন থেকে পদত্যাগ করেন পো। সেই জুন মাসেই পো ‘দ্য স্টাইলাস’ নামে তাঁর নিজস্ব ম্যাগাজিন শুরু করার ইচ্ছে প্রকাশ করে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। ‘স্যাটারডে ইভিনিং পোস্ট‘ – এর ৬ জুন সংখ্যার সেই বিজ্ঞাপনে অবশ্য ম্যাগাজিনটিকে ‘দ্য পেন’ বলে অভিহিত করেন তিনি। অবশ্য পো-এর মৃত্যুর আগে এই জার্নালটি তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

১৮৪১ সালে মাসিক গ্রাহামস ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন পো। ১৮৪২ সালের এক সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রী ভার্জিনিয়া যখন গান গাইছিলেন তখন তাঁর গলার রক্তনালী ছিঁড়ে রক্ত উঠে আসে যা আসলে যক্ষ্মারই পূর্ব ইঙ্গিত। স্ত্রী-এর অসুস্থতার চাপে আরও বেশি মদ্যপান শুরু করেন পো এবং গ্রাহামস ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দায়িত্বও ত্যাগ করেন। নিউইয়র্কে ফিরে এসে ‘ইভনিং মিরর’ – এ কিছুদিন কাজ করবার পর ‘ব্রডওয়ে জার্নাল’ -এর সম্পাদক হন। সেখানে হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলোকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে একঘরে হন তিনি। এসময় ১৮৪৫ সালে পো-এর কবিতা ‘দ্য রেভেন’ প্রকাশিত হয়। ১৮৪৭ সালের ৩০ জানুয়ারি পো-এর স্ত্রী ভার্জিনিয়ার মৃত্যু হয়। স্ত্রীয়ের মৃত্যুর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে পো-এর ওপর। রিচমন্ডে ফিরে আসেন পো এবং বাল্যপ্রেমিকা সারাহ এলমিরা রয়স্টারের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্কস্থাপন শুরু করেন।

১৮৪৯ সালের ৩ অক্টোবর পো-কে বাল্টিমোরের রায়ানস ট্যাভার্নে ময়লা পোশাকে নর্দমায় প্রলাপ বকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল এক ঝমঝমে বৃষ্টির রাতে। তৎক্ষণাৎ ওয়াশিংটন মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং চারদিন পর ৭ অক্টোবর পো-এর মৃত্যু হয়। পো-এর মৃত্যু নিয়ে ক্রমে রহস্য ঘনীভূত হয়ে ওঠে। কেউ বলেন অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মৃত্যু, কেউ আবার কুপিং গ্যাং-এর অত্যাচারের কথা বলেন। এছাড়াও জলাতঙ্ক, মৃগীরোগ, পরোক্ষ খুন, সিফিলিস, ব্রেন টিউমার ইত্যাদি নানারকম তত্ত্ব গড়ে উঠেছে পো-এর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। বাল্টিমোরের ওয়েস্টমিনস্টার প্রেসবিটারিয়ান কবরস্থানে একটি অচিহ্নিত কবরে সমাহিত করা হয়েছিল এডগার অ্যালান পো-এর মৃতদেহ। পরে অবশ্য তা স্থানান্তরিত করা হয়।

2 comments

আপনার মতামত জানান