পদবী নিয়ে আমাদের অনেকেরই শ্লাঘার শেষ নেই, আবার বিশেষ কিছু পদবীর প্রতি শ্লেষও কম নেই। কেউ কেউ মনে করেন যে পদবীর ইতিহাস সেই মান্ধাতার আমল থেকে আমাদের সঙ্গে জুড়ে আছে বুঝি। পদবীর উৎস জানতে গিয়ে ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যায় যে, পদবী আদৌ তত প্রাচীন নয় যতটা আমরা কল্পনা করি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে পদবীর বিভিন্ন অর্থের মধ্যে উল্লেখ করেছেন – উপাধি (title), বংশসূচক শব্দ (Surname), গুণ-বিদ্যাজন্য উপনাম ইত্যাদি। সাধারণভাবে, আমাদের সমাজে কোনও ব্যক্তির নামের দুটি অংশ – নাম ও উপনাম। এই উপনাম শব্দটিকেই পদবী (Surname) বলা হয়। এখন তাহলে পদবীর উৎপত্তি সন্ধানে জেনে নেওয়া যাক বর্ণানুক্রমিক ‘ধ’ এবং ‘ন’ বর্ণ অবধি পদবীগুলি কীভাবে প্রচলিত হল।
ধর – পুরাণ-ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে ধর মূলত কায়স্থদের পদবী। গুপ্তবংশীয় রাজাদের শাসনকালের আগে থেকেই পশ্চিম ভারত ছেড়ে কায়স্থরা বাংলায় আসা শুরু করে। নিজেদের পারদর্শিতা বা দক্ষতা অনুসারে তাঁরা বিভিন্ন উপাধি পেয়েছিলেন। বীর্যবত্তার জন্য খ্যাত এক গোষ্ঠীর উপাধি ছিল ধর। সেখান থেকেই এই পদবীর আবির্ভাব বলে অনুমান।
আর্য সমাজব্যবস্থায় বিচারবিভাগে একজন করে ধারক থাকতেন যাঁর কাজ ছিল মণ্ডলেশ্বরকে সাহায্য করা। এই ধারক শব্দের ভ্রংশ রূপ ধর/ধারা/ধাড়া বলে অনেকে মনে করেন।
ধীবর – পেশাভিত্তিক পদবী। আভিধানিক অর্থ মৎসজীবী। মাছ ধরা বা মাছ বিক্রি পেশা থেকেই এই পদবীটি এসেছে। সাধারণত তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষদের মধ্যে এই পদবী চোখে পড়ে।
নন্দী – এটি স্থানভিত্তিক পদবী বলে মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে প্রচলিত আছে আদিশূরের কথা। পুত্রেষ্টি যজ্ঞের জন্য বঙ্গদেশীয় রাজা আদিশূর কন্বকুব্জ বা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিল বেদগর্ভ। ঋষি বেদগর্ভের বারোজন সন্তান ছিল এবং এঁদের বসবাসের জন্য বারোটি গ্রাম দেওয়া হয়। তাঁদের নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয়। এই বারোজনের একজনের নাম বা গাঞি নাম ‘নন্দী’ থেকে এই পদবীটি এসেছে মনে করা হয়।
অন্য একটি মতে, এই পদবীর উৎস বৌদ্ধ নামের শেষাংশ থেকে। এক সময় ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের রমরমা ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ থেকে পরবর্তী এক হাজার বছর ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। এ-সময়ে অধিকাংশ ব্রাহ্মণও বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বা বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলেও গৌরবান্বিত পূর্বপুরুষের নামের শেষাংশকে পুরুষানুক্রমে ধরে রাখার প্রবণতা থেকে যায়। এই প্রবণতা থেকে বাংলায় বহু পদবীর সৃষ্টি হয়েছে। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এই অন্তনাম থেকে গড়ে ওঠা পদবীগুলোর মধ্যে – দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দী, বর্মন, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নস্কর – এই পদবীর উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। একটি মত অনুযায়ী নিস্করভোগী সামন্ত রাজাদের উপাধি নস্কর থেকে এই পদবীটি এসেছে। আবার ভিন্নমতে, লস্কর থেকেও নস্কর এসে থাকতে পারে। সৈন্য, ফৌজ বা জাহাজের খালাসীদের লস্কর বলা হয়, যা এ যুগে আর্মির হাবিলদার বা সারজেন্টের সমতুল্য।
নাগ – মনে করা হয় উপাস্য দেবতার নামানুসারে এই পদবীর উদ্ভব। আদিবাসী সমাজে গোত্র (CLAN) প্রচলিত, যা কি না মূলত আসে জীবজন্তু, গাছপালা বা জড় পদার্থের নাম থেকে। এই গোত্রের নাম আবার পদবী হিসেবে ব্যবহারের প্ৰচলন আছে। এইভাবেই সর্প উপাসক বা সর্প গোত্রের থেকে নাগ পদবী এসেছে বলে মনে করা হয়।
অন্য একটি মতে এই পদবীর উৎস বৌদ্ধ নামের শেষাংশ থেকে। এক সময় ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের রমরমা ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ থেকে পরবর্তী এক হাজার বছর ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। এ-সময়ে অধিকাংশ ব্রাহ্মণও বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বা বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলেও গৌরবান্বিত পূর্বপুরুষের নামের শেষাংশকে পুরুষানুক্রমে ধরে রাখার প্রবণতা থেকে যায়। এই প্রবণতা থেকে বাংলায় বহু পদবীর সৃষ্টি হয়েছে। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এই অন্তনাম থেকে গড়ে ওঠা পদবীগুলোর মধ্যে – নাগ, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দী, বর্মন, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নাথ – এই পদবীর উৎপত্তির মূলেও রয়েছে সেই ধর্মাচার্যদের নাম। এক সময় ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের রমরমা ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ থেকে পরবর্তী এক হাজার বছর ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। এ-সময়ে অধিকাংশ ব্রাহ্মণও বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বা বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলেও গৌরবান্বিত পূর্বপুরুষের নামের শেষাংশকে পুরুষানুক্রমে ধরে রাখার প্রবণতা থেকে যায়। এই প্রবণতা থেকে বাংলায় বহু পদবীর সৃষ্টি হয়েছে। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এই অন্তনাম থেকে গড়ে ওঠা পদবীগুলোর মধ্যে – নাথ, নাগ, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দী, বর্মন, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তবে উল্লেখযোগ্য এই যে নাথ পদবীর উৎপত্তিতে জৈন ধর্মের প্রভাব খানিক বেশি। জৈন ধর্মগুরু তীর্থঙ্করদের নামের শেষে নাথ যুক্ত থাকতে দেখা যায়। নাথ পদবীর উৎপত্তির পেছনে সেটাও একটা কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এ ছাড়াও নাথ যোগীদের প্রভাব এই পদবীকে কতটা প্রভাবিত করেছিল তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
নট/নাটুয়া – পেশাগত পদবী। অভিনয় ছিল পেশা আর সেখান থেকেই পরিচিতি নট বা নাটুয়া হিসেবে। এঁদের অন্য পদবী নিশ্চয়ই ছিল কিন্তু তার জায়গায় প্রাধান্য পায় পেশা। একসময় সেটাই পদবী হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী প্রজন্ম সেই পেশায় না থেকেও পদবী হিসেবে নট বা নাটুয়া ব্যবহার করে চলছেন।
নাহার/নাহা – নাহার বা নাহা বাংলার নিজস্ব পদবী নয়, এসেছে গুজরাট ও রাজস্থান থেকে। মনে করা হয় এই পদবীর মানুষজন যাঁরা বাংলায় এসে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করেন, তাঁরা তাঁদের পদবী অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। অন্য একটি মতে, ছোট খাল বা নদীকে নাহা বা নাহার বলার চল আছে। সেই খাল/নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাসভূমির থেকে এই পদবী এসে থাকতে পারে। যদিও এই মতটি তেমন জনপ্রিয় নয়।
নায়েব – পেশাগত পদবী। আরবি শব্দ নায়িব থেকে এসেছে। জমিদারি পরিচালনার জন্য এক শ্রেণীর কর্মচারী নায়েব নামে পরিচিত ছিলেন। এই পেশাটি ক্রমে এই পদবীর জন্ম দেয়। পরের প্রজন্ম সেই পেশার সাথে যুক্ত না থেকেও নায়েব পদবীটি ব্যবহার করতে থাকেন।
নায়ক/নায়েক – নায়ক কথাটি নেতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। জানা যায় যে, প্রতি পঁচিশ জন সেনার নেতৃত্বদানকারী সেনাধ্যক্ষকে নায়ক বলা হতো। এই পদ থেকেই নায়ক/নায়েক পদবীর উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। ভিন্নমতে, এই পদবীর উৎস উড়িষ্যা। সেখানে থেকেই বাংলায় এসেছে। আবার নায়ক কথাটা শুনলে আমাদের চলচ্চিত্রের নায়কের কথা মনে হয়। তবে পদবীর উৎপত্তির পিছনে অভিনয় পেশার ভূমিকা আছে কি না তাই নিয়ে সংশয় আছে।
নিয়োগী – পেশাগত পদবী। নিয়োগী বলতে নিয়োগকর্তাকে বোঝায়। জমিদারির কাজে সাহায্য করা ও নিয়োগ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করা ছিল নিয়োগীদের কাজ। এই পেশা থেকেই পদবীটি এসেছে বলে মনে করা হয়। অন্ধ্র ব্রাহ্মণদের একটি শাখা নিয়োগী। কাজেই বাংলার সাথে সাথে দাক্ষিণাত্যেও এই পদবী প্রচলিত।
তথ্যসূত্র
- বঙ্গীয় শব্দকোষ - হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- আমাদের পদবীর ইতিহাস - লোকেশ্বর বসু
- পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস - শ্রীখগেন্দ্রনাথ ভৌমিক
- বাংলার পদবি কথা - দেবাশিস ভৌমিক