মহাশ্বেতা দেবী

মহাশ্বেতা দেবী

ভারতের কিংবদন্তি লেখিকাদের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবী (Mahasweta Devi) একজন অগ্রগণ্য প্রবাদপ্রতিম লেখিকা। ভারতের শবর উপজাতির নিপীড়িত মানুষের হয়ে লড়াই করা এবং তাদের জীবনকে অসামান্য নিপুণতায় তাঁর লেখায় স্থান দেওয়ার জন্য তিনি ‘শবর-জননী’ নামেও খ্যাত।

১৯২৬ সালে ১৪ই জানুয়ারি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় মহাশ্বেতা দেবীর। তাঁর বাবা  কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও উপন্যাসিক  মনীশ ঘটক। মা ধরিত্রীদেবীও ছিলেন একজন লেখিকা ও সামাজিক কর্মী। তাঁর ছোট কাকা হলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক

মহাশ্বেতা দেবী তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা ঢাকাতেই শুরু করেন। ভারত ভাগ হয়ে যাবার পর তাঁর পরিবার পশ্চিমবঙ্গে এসে বসবাস শুরু করে। এখানে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য বিভাগে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে অধ্যাপিকা হিসাবে কাজ শুরু করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই কলেজে কাজ করার সময়ই তিনি একজন সাংবাদিক ও লেখিকা হিসাবেও কাজ করতেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ সহ বিহার, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এই রাজ্যগুলির আদিবাসী বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। লোধা, শবর উপজাতির নিপীড়িত মানুষের উপর তিনি অনেক পড়াশোনা করেছেন এবং তাঁদের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস রচনা ও তাঁদের অধিকারের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন। ১৯৫৬ সালে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ-এর জীবনী অবলম্বনে তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাসের নাম ‘ঝাঁসির রানি’। এটি লেখার আগে দীর্ঘ দিন ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে সেখানে আদিবাসীদের উপর অনেক গবেষণা করেন তিনি। বিরসা মুণ্ডার জীবনকাহিনী অবলম্বনে রচিত তাঁর  একটি বিখ্যাত উপন্যাস হল ‘অরণ্যের অধিকার’। ‘অরণ্যের অধিকার’ রচনার জন্য সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৭৯ সালে সাহিত্য একাডেমি পান।  তিনি প্রায়  একশোটির উপর উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’। আদিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে রচিত তাঁর অন্যতম উপন্যাস  ‘চোট্টিমুণ্ডা ও তার তীর’, ‘তিতুমীর’  ইত্যাদি।

অনগ্রসর জাতির অধিকারের জন্য তাঁর লড়াই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বহুবার উপজাতিদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষকদের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তিনি পথে নেমে আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে সমাজের প্রথম সারির লেখক, বুদ্ধিজীবি, শিল্পী ও নাট্যকর্মীরাও এই আন্দোলনে যোগ দান করেন। তিনি শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে পড়াশোনা করলেও শান্তিনিকেতনের বাণিজ্যকরণের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। তাঁর লেখা গল্প অবলম্বনে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – সংঘর্ষ(১৯৬৮), হাজার চুরাশির মা (১৯৯৮), মাটি মা(২০০৬), গাঙোর (২০১০) ইত্যাদি ।

মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে আরেক ঔপন্যাসিক ও গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মহাশ্বেতা দেবীর বাছাইকরা অনেকগুলি ছোট গল্প সহ উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনটি গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সারা জীবনে অজস্র পুরস্কারে সম্মানিত হন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, রামন ম্যাগসাইসাই, পদ্মবিভূষণ, বঙ্গবিভূষণ  ইত্যাদি।

ব্যক্তিগত জীবনে গণনাট্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা  বিজন ভট্টাচার্যের  সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিণ্তু পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাঁদের পুত্র  নবারুণ ভট্টাচার্যও একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক।

২০১৬ সালের ২৮শে জুলাই ৯০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যু হয়।

তাঁর জীবনী ভিডিও আকারে দেখুন এখানে

3 comments

আপনার মতামত জানান