মার্কিন চলচ্চিত্র দুনিয়ার সৌন্দর্যের রানি ছিলেন মেরিলিন মনরো (Marilyn Monroe)। একাধারে অভিনেত্রী, মডেল এবং গায়িকা মেরিলিন বহু যুগ ধরে বিশ্ববাসীর কাছে এক লাস্যময়ী ও আবেদনময়ী প্রতীকরূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। আমেরিকার পপ সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিভূ ছিলেন তিনি, মৃত্যুর বহু বছর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও। ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় হলিউডের স্বর্ণযুগে রূপোলি পর্দার কিংবদন্তীদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ধরা হয় মেরিলিন মনরোকে। গোটা এক দশক ধরে মার্কিন চলচ্চিত্র জগতে তিনিই ছিলেন সবথেকে বেশি সাম্মানিকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী। হাসির ঝলকানি, কণ্ঠের মায়াজাদু, তীক্ষ্ণ চাহনি আর অপার সৌন্দর্যের আবেদনে মেরিলিন মনরো হয়ে উঠেছিলেন সেকালের তরুণদের স্বপ্নমানসী। একদিকে অভিভাবকহীনতা, অসহায়তা আর অন্যদিকে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়ে উঠলেও পরবর্তীকালে সেই অসহায়তাই তাঁর প্রধান মানসিক জোর হয়ে ওঠে। প্রাথমিকপর্বে একটি কারখানার কাজ থেকে মডেলিং শুরু এবং তারপর একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন মেরিলিন। ১৯৫৫ সালে তাঁর অভিনয়জীবনের সবথেকে বড় বক্স অফিসে সফল ছবি ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ মুক্তি পায়। লি স্ট্রাসবার্গের কাছে মেথড অ্যাক্টিং শেখাও শুরু করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবনে মানসিক অবসাদ তাঁকে গ্রাস করে এবং শেষে অতিরক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন মেরিলিন মনরো। যদিও তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে আজও রহস্য দানা বেঁধে আছে।
১৯২৬ সালের ১ জুন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসের কাউন্টি হাসপাতালে মেরিলিন মনরোর জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম নোর্মা জিন মর্টেনসন। তাঁর মা গ্ল্যাডিস পার্ল বেকার ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মহিলা যিনি মধ্য-পশ্চিম আমেরিকা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে থাকতে শুরু করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর মা নয় বছরের বড়ো জন নিউটন বেকারকে বিবাহ করেন। রবার্ট ও বার্নিস নামের তাঁদের দুই সন্তান ছিল। কিন্তু এই বিবাহ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন পরে গ্ল্যাডিস পার্ল বেকার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান আইনি পদ্ধতিতে। কিন্তু এর কয়েকদিনের মধ্যে জন বেকার তাঁর সন্তানদের অপহরণ করে কেন্টাকিতে চলে যান। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত মেরিলিন জানতেনই না তাঁর একটি বোন ও এক ভাই আছে। ইতিমধ্যে গ্ল্যাডিস মানসিক ভারসাম্য হারান এবং ১৯২৪ সালে মার্টিন এডওয়ার্ড মর্টেনসনকে বিবাহ করেন তিনি। মেরিলিনের জন্ম হয় এই সময়, কিন্তু তাঁর জন্মের দুই বছরের মধ্যেই মার্টিন গ্ল্যাডিসের সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ ঘটান। এই অবস্থায় চূড়ান্ত মানসিক ভারসাম্যহীনতায় গ্ল্যাডিস তাঁর কন্যা মেরিলিনকে মেরে ফেলতেও চেয়েছিলেন, খুব সামান্য আয়ে নিজের এবং মেরিলিনের অন্নস্নগস্থান করা দুঃসাধ্য ছিল। ফলে মেরিলিনকে একটি অনাথ আশ্রমে রেখে আসা হয় এবং চিকিৎসার জন্য গ্ল্যাডিসকে ভর্তি করা হয় মানসিক হাসপাতালে। অনাথ আশ্রমে বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটতে কাটতে ১২ বছর বয়সে একজন পালক বাবা-মা তাঁকে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে যাবেন। এই পালক মা গ্রেস গোডার্ড আসলে তাঁর প্রকৃত মা গ্ল্যাডিসেরই বান্ধবী ছিলেন। অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের পরামর্শে গ্রেস মনরোর আইনি অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এই পরিবারে এসেও শান্তি পাননি মনরো। গ্রেসের স্বামী এরউইন ডক গোডার্ড মেরিলিনকে যৌন হেনস্থা করেন। এই বাড়ি ছেড়ে ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শটেলে গ্রেসের কাকিমা আনা লয়ারের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন মেরিলিন মনরো। ইতিমধ্যে ১৯৪২ সালের ১৯ জুন সেই বাড়ির কাছেই জেমস ডগার্থি নামের একজনের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন মেরিলিন মনরো।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
শটেলের নিকটবর্তী এমারসন জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন মনরো। এমনিতে খুবই সাধারণ মানের ছাত্রী হলেও লেখালিখির দিকে তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। স্কুলের পত্রিকায় এবং সংবাদপত্রে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো নিয়মিত। এরপরে মনরো ভর্তি হন ভ্যান ন্যুইস হাই স্কুলে।
জেমসের সাহায্যেই বিমানের যন্ত্রাংশ নির্মাণের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় মেরিলিন মনরোর। ইতিমধ্যে তাঁর অপরূপ শারীরিক সৌন্দর্যের কারণে সেই বিমান কোম্পানির বিজ্ঞাপনে শো-গার্ল হিসেবে মডেলিং করতে শুরু করেন তিনি। ডেভিড কনরোর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে একটি পত্রিকার জন্য মডেলিং করেন মেরিলিন যা সেই সময় তাঁকে প্রভূত জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পরপর পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর লাস্যময়ী ছবি ছাপা হতে থাকে। কিন্তু মডেলিং জগতের যে গ্ল্যামার তা তাঁদের সাংসারিক জীবনে বিপন্নতা তৈরি করে, জেমসের সঙ্গে এ বিষয়ে মতানৈক্যের পরে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এরপরেই চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পদার্পণ করেন মেরিলিন মনরো আর অভিনয় জগতে এসেই নিজের নাম পরিবর্তন করেন তিনি এবং নোর্মা জিন মর্টেনস্টাইন থেকে মেরিলিন মনরো হিসেবেই জগতের কাছে পরিচিত হন তিনি। ১৯৪৫ সালে ব্লু বুক মডেল এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন মেরিলিন মনরো। ১৯৪৬ সালের মধ্যেই ৩৩টি পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি ছাপা হয়ে যায় এবং একজন নামী মডেল হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি বেড়ে যায় প্রভূতভাবে। ১৯৪৭ সালে ‘ডেঞ্জারাস ইয়ারস’ ছবিতে প্রথম খুব সামান্য একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান মেরিলিন মনরো। এই সময় অ্যাক্টরস ল্যাবরেটরি থিয়েটারে কাজ করতে থাকেন তিনি এবং গ্রুপ থিয়েটারের নানা ধারণা, অভিনয় পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। লি স্ট্রাসবার্গের কাছে মেথড অ্যাক্টিং শেখাও শুরু করেছিলেন তিনি। তখন থেকেই চলচ্চিত্রে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হন মেরিলিন মনরো।
১৯৫০ সালে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিওর প্রযোজনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অল অ্যাবাউট ইভ’-এ অভিনয়ের পর থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়ে যায়। এরপরে ১৯৫১ সালে ‘রাইট ক্রস’, ‘হোম টাউন স্টোরি’, ১৯৫২তে ‘ক্ল্যাশ বাই নাইট’, ‘উই আর নট ম্যারেড’, ১৯৫৩ সালে ‘জেন্টলম্যান প্রেফার ব্লন্ডিস’, ‘হাও টু মেরি এ মিলিওনেয়ার’ ইত্যাদি ছবিতে পরপর অভিনয় করতে থাকেন মেরিলিন মনরো। সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চুলের রঙ বাদামী করে নেন তিনি। এই সব ছবিতে তাঁর যৌন আবেদন তরুণ-যুবক সহ সমস্ত পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তুলে দেয়। ‘হাউ টু ম্যারি আ মিলিওনেয়ার’ ছবিটি বক্স অফিসে আলোড়ন তোলে। এরপরে ‘প্লে-বয়’ পত্রিকার প্রচ্ছদে সম্পূর্ণ নগ্নভাবে তাঁর ছবি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন মুলুক জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ১৯৫৪ সালের ১৪ জানুয়ারি ডি মিয়েগোর সঙ্গে পুনর্বিবাহ করার পরে কোরিয়ায় চলে যান মেরিলিন মনরো এবং সেখানে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে গান গেয়ে গায়িকা হিসেবেও সুখ্যাতি তৈরি হয় তাঁর। ১৯৫৪ সালেই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ‘ফটোপ্লে অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হন তিনি। ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ সিনেমায় একটি উড়ন্ত স্কার্টের দৃশ্যে অভিনয় করার কারণে ডি মিয়েগোর সঙ্গে মতানৈক্য ও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায়। এই কারণে কিছুদিন যাবৎ কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি তিনি। ১৯৫৫ সালে তাঁর অভিনয়জীবনের সবথেকে বড় বক্স অফিসে সফল ছবি ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ মুক্তি পায়। ১৯৫৬ সালে তৃতীয়বারের মতো আর্থার মিলারের সঙ্গে বিবাহ করেন মেরিলিন এবং বিবাহের পর পুনরায় রূপোলি পর্দায় তাঁকে দেখতে পায় আপামর রসিক দর্শক। তাঁর অভিনীত ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য শো-গার্ল’ ছবিটি বাফটা পুরস্কারে ভূষিত হয়। সেই বছরে ইতালি ও ফ্রান্সেও দুটি পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ‘সাম লাইক ইট হট’ ছবিতে গায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে সমাদর লাভ করেন মনরো। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘দ্য মিসফিট’। এরপরে আবার মিলারের সঙ্গে মনরোর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন. এফ. কেনেডির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ঘিরেও জনরব উঠেছিল। কেনেডির জন্মদিনের একটি পার্টিতে ‘হ্যাপি বার্থডে মি. প্রেসিডেন্ট’ নামে একটি গান গেয়েছিলেন মনরো যা খুবই জনপ্রিয় হয়। এছাড়া গায়িকা হিসেবেও তাঁরা গাওয়া ‘মাই হার্ট বিলংস টু ড্যাডি’, ‘আই ওয়ানা বি লাভড বাই ইউ’, ‘ডায়মণ্ডস আর এ গার্লস বেস্ট ফ্রেণ্ডস’ ইত্যাদি গানগুলি দর্শক-শ্রোতার সমাদর লাভ করে।
একদিকে অত্যাধিক মাদকাসক্তি এবং অন্যদিকে তীব্র মানসিক অবসাদ ও ভারসাম্যহীনতায় ডুবে থাকতেন মনরো। চিবুকে কসমেটিক সার্জারিও করিয়েছিলেন তিনি অধিক সৌন্দর্যময়ী হয়ে ওঠার কারণে। কিন্তু একাকিত্ব আর হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছিল।
শেষে ১৯৬২ সালের ৪ আগস্ট অত্যধিক ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন মেরিলিন মনরো। যদিও তাঁর এই মৃত্যুকে ঘিরে আজও রহস্য দানা বেঁধে আছে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.imdb.com/
- https://www.britannica.com/
- https://emirateswoman.com/
