মীরা বাঈ

মীরা বাঈ

মীরা বাঈ (Meera bai) ভক্তিযুগের একজন কৃষ্ণ ভক্ত সাধিকা ও সঙ্গীত শিল্পী যিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর আকুল কৃষ্ণ প্রেমের জন্য। জীবদ্দশায় তিনি প্রায় বারোশো থেকে তেরশো ভজন রচনা করেছেন। ভক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত সাধিকা ছিলেন মীরা বাঈ। তাঁর জীবন ধারা অণুপ্রাণিত করে ভক্তদের। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর এই অসামান্য আত্মনিবেদন ও নিষ্ঠা তাঁকে করে তুলেছে মহীয়সী।

১৪৯৮ সালে রাজস্থানের অন্তর্গত নাগোর জেলার কুড়কি গ্রামে ক্ষত্রিয় রাঠোর বংশে মীরা বাঈয়ের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ‘মিহিরা’। তাঁর লেখা ভজনে তিনি নিজেই প্রথম এই নাম পাল্টে লেখেন ‘মীরা’। তাঁর বাবা ছিলেন রাঠোর বংশীয় যোদ্ধা রতন সিংহ রাঠোর যিনি মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। তাঁর দাদু ছিলেন যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা রাও যোধা। মীরার মায়ের নাম বীরকুমারী। মীরার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাঁর মা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান।ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে মীরা বড় হয়ে ওঠেন দাদু রাও যোধা ও জেঠু রাও ভীরাম দেবের অভিভাবকত্বে। দাদু রাও যোধা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তিনিই মীরা বাঈকে ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দান করেন। ক্রমাগত মহাভারত ও রামায়ণ পাঠ মীরার মনকে ক্রমশই ঈশ্বরের প্রতি চালিত করতে থাকে। ধর্ম চর্চার পাশাপাশি তিনি তালিম নেন গান ও শিল্পকলার। একজন রাজপুত রাজকন্যা হিসেবে ঘোড়ায় চড়া থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম সমস্ত শিক্ষাই তাঁর প্রাপ্ত হয়েছিল তাঁর দাদুর থেকে।

শৈশবে যখন মীরা বাঈয়ের তিনবছর বয়স তখন এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী এক রাত্রের জন্য আশ্রয় নেন মীরাটের রাজপ্রাসাদে। সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে ছিল তাঁর আরাধ্য দেবতা গিরিধারী গোপাল যাঁকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পুজো করতেন। মীরা বাঈ ওই কৃষ্ণ মূর্তি দেখে মূর্তির প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হন এবং ওই মুর্তি নিজের অধিকারে নেওয়ার জন্য বায়না জুড়ে দেন। তাঁর বাবা চিন্তিত ছিলেন ওই কৃষ্ণমুর্তির সঠিক পরিচর্যার বিষয়ে। কিন্তু মেয়ের বায়না কান্নাকাটিতে রূপান্তরিত হলে তিনি আর নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখতে পারলেন না। এদিকে সন্ন্যাসীও তাঁর আরাধ্য দেবতাকে ছাড়তে চান না। অবশেষে গিরিধারী গোপাল রাত্রে সন্ন্যাসীকে স্বপ্নাদেশেে মীরার কাছে থাকার অভিলাষ ব্যক্ত করলে পরদিন সন্ন্যাসী সজল চোখে কৃষ্ণমুর্তিটি মীরাকে অর্পণ করে চলে যান। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি ওই কৃষ্ণমুর্তিটি ছিল মীরার সর্বক্ষণের সঙ্গী। যতদিন ছোট ছিলেন তিনি কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর খেলার সাথী। ওই মুর্তির সাথে গল্প করতেন, খেলতেন।

একদিন বিকেলে মীরা বাঈ তাঁর মায়ের সাথে এক বিবাহের শোভাযাত্রা দেখছিলেন প্রাসাদের সামনে। তখন তিনি হঠাৎই তাঁর মাকে প্রশ্ন করে বসেন “আমার বর কে?” তাঁর মা এ হেন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি উত্তরে ওই কৃষ্ণমুর্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন “ইনিই তোমার স্বামী।” প্রথম যৌবনের রঙ লাগা মীরার মন স্বামী হিসাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মেনে নেয় এবং তাঁর এই বিশ্বাস আজীবন তাঁর সঙ্গী ছিল।

১৫১৬ সালে মীরা বাঈ- য়ের বয়স যখন আঠারো তখন তাঁর বিবাহ হয় মেবারের শিশোদিয়া বংশের রাজা রাণা সঙ্ঘের পুত্র রাজপুত যোদ্ধা ভোজরাজ সিংয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি মীরাট ছেড়ে চলে আসেন চিতোরে। শ্বশুরবাড়ীতে এসেও মীরা ভোগবিলাসের থেকে বেশী মন দিয়েছিলেন নিজের কর্তব্যকর্মের প্রতি। সাংসারিক কাজের থেকেও পূজার্চনা সাধুসঙ্গ তাঁর কাছে অনেক বেশী প্রিয় ছিল। তাঁর কৃষ্ণপ্রেম ও সাধন ভজন নিয়ে অচিরেই রাজপ্রাসাদের ভিতর অসন্তোষ জমা হতে শুরু করে। কিন্তু তাঁর কৃষ্ণপূজার কথা রাজপ্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়ে প্রচার হতে থাকে দুরদূরান্তে। অল্পদিনের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে দাস দাসী থেকে নগরবাসীর মধ্যে। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বহু অপমান আর অপবাদ তাঁকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অচল ছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে সর্বশক্তিমান, তিনিই যে জগতের অধীশ্বর এবং তাঁকেই যে মীরা স্বামীর স্হান দিয়েছেন এই বিশ্বাসেে তিনি স্হির থাকেন। মীরার শাশুড়ি তাঁকে তাঁদের কুলদেবী “ভীমা”-র আরাধনা করার জন্য নিমন্ত্রণ জানালে মীরা বাঈ জানান তাঁর পক্ষে তাঁর “গিরিধারী গোপাল” ভিন্ন অন্য কাউকে পূজা করা সম্ভব হয়। তাঁর এই কথায় রাজপ্রাসাদের ভিতরে মীরা বিদ্বেষী ক্ষোভ তীব্র হতে থাকে এবং তাঁর স্বামীও তাঁকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু মীরার কৃষ্ণের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস দেখে ভোজরাজের মনেও মীরার প্রতি এক প্রচ্ছন্ন স্নেহ শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয়। মীরার “গিরিধারী গোপাল” এর জন্য তিনি একটি মন্দির তৈরী করে দেন যা আজও বর্তমান।

মীরার কঠোর জীবন সংগ্রাম শুরু হয় তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরে। ১৫২১ সালে মোগল সম্রাট আকবরের সাথে যুদ্ধে মৃত্যু হয় রাণা ভোজরাজের। মীরার শ্বশুর মীরাকে নির্দেশ দেন স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে। কিন্তু মীরা দৃঢ়ভাবে তাঁর শ্বশুরকে জানিয়ে দেন যে তাঁর পক্ষে সহমরণে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ তাঁর প্রকৃত স্বামী হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাঁর কোন মৃত্যু হয় না। মীরার এই যুক্তি শুনে তাঁর শ্বশুর প্রবল অসন্তুষ্ট হলেও রাজপরিবারের সম্মানার্থে মীরাকে ত্যাগ করতে পারলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মীরার শ্বশুরও যুদ্ধে প্রাণ হারালে রাজা হন মীরার দেওর রাণা রতন সিংহ। এরপরই মীরার উপর অত্যাচার চরমে ওঠে। তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা হয় বারংবার। কখনও বিষভর্তি পাত্র দিয়ে আবার কখনও সাপের ঝুড়ি দিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই মীরা অদ্ভুতভাবে প্রাণে বেঁচে যান।

স্বামীর মুত্যুর পরে মীরা অনুভব করেন ইহজাগতিক স্নেহ মমতা ভালবাসা সবই এক মায়া যার স্হায়িত্ব ক্ষণিকের। এই উপলব্ধি মীরাকে কৃষ্ণের প্রতি আরও আকৃষ্ট করে তোলে। মীরা এরপর মেবারের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে আবার মীরাটে চলে আসেন। কিন্তু এখানেও তাঁর ঠাঁই হয় না। তাঁর কাকার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের কারণে মীরা মীরাট থেকে কৃষ্ণলীলাভূমি বৃন্দাবনে চলে আসেন। বৃন্দাবনে এসে মীরা তীব্রভাবে কৃষ্ণ প্রেমভক্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন ও শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভের জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠেন। তাঁর ভজন সঙ্গীতের মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।সমগ্র উত্তর ভারতে মীরার নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

১৫৩৯ সাল নাগাদ গৌড়ীয় বৈষ্ণবমন্ডলীর আচার্য শ্রীরূপ গোস্বামী বৃন্দাবনে থাকাকালীন মীরা তাঁর দর্শন প্রার্থনা করলে শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁকে দর্শন দিতে অস্বীকার করেন কেবল মীরা নারী বলে। তখন মীরা তাঁকে ভাগবতের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন “এই বৃন্দাবনের একমাত্র পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। আর সকলেই হল প্রকৃতি।” তাঁর এই যুক্তিতে আচার্য খুশি হন এবং মীরার সাথে তাত্ত্বিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

ভক্তিবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল নবম শতক থেকে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত উচ্চবর্ণের পুরুষদের থেকে পূজার অধিকার নিয়ে নিম্নবর্গের সকলের মধ্যে বন্টিত করা। সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্রপাঠের বদলে আঞ্চলিক ভাষায় গান ও কবিতা রচনা করে আরাধ্য দেবতার উপসনা করা ছিল পরিবর্তিত মাধ্যম। আর এই মাধ্যমেটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মীরা বাঈ। তাঁর লেখা ভজনগুলি ছিল রাজস্থানী আঞ্চলিক ভাষায় যেগুলি ছয় থেকে চব্বিশ পংক্তি অবধি বিস্তৃত ছিল। তাঁর অধিকাংশ ভজনেই রাগ সঙ্গীতের প্রাধান্য রয়েছে। পিলুর শুদ্ধ কোমল রাগ যেমন আছে, তেমনই আছে দেশ, সারং, ভৈরবী, ভীমপলশ্রী মিলিয়ে সত্তরের কাছাকাছি রাগ। মীরার ভজনগুলির মধ্যেই মীরার সঙ্গীত ও কাব্যের সুদৃঢ় দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই পংক্তি গুলি “মীরার ভজন” নামে সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। এই ভজনের মধ্যে দিয়েই মীরার ঈশ্বরের প্রতি নিজেকে নিবেদনের ভাব সুস্পষ্ট রূপে প্রাঞ্জল হয়ে আছে।

মীরাকে নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে। তাঁর জীবন থেকে অণুপ্রানিত হয়ে বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। ১৯৪৫ সালে এম. এস. সুবুলক্ষী তামিল চলচ্চিত্র “মীরা”তে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। হিন্দী ভাষায় গুলজারের সুরে ১৯৭৯ সালে “মীরা” চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এ ছাড়াও টেলিভিশনে মীরাকে নিয়ে বেশ কিছু ধারাবাহিক হয়েছে। মীরার ভজনগুলি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত। অনুপ জলোটা থেকে লতা মঙ্গেশকরের মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা মীরার ভজন গেয়েছেন।

মীরা বাঈয়ের ভক্তি ও ঈশ্বর প্রেমের কথা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। শ্রীকৃষ্ণকে মনের মধ্যে কল্পনা করে তাঁর প্রতি যে ভক্তি ও শ্রদ্ধাবোধ তিনি ব্যক্ত করে গেছেন, তা অবিস্মরণীয়। “মীরার ভজন” নামে খ্যাত তাঁর ভজন সঙ্গীতগুলি ছিল সহজ সরল ভাষায় রচিত যা সাধারণ মানুষের মনে গভীর উপস্থিতি রেখে যেতে সক্ষম ছিল। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই ভজনগুলি এক সম্প্রতির সৃষ্টি করেছিল যা সূচনা করেছিল ভক্তিবাদের।

আনুমানিক ১৫৪৬ সালে মীরা দ্বারকায় আসেন। জীবনের শেষ কটা দিন মীরা শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকায় “রণছোড়জী”র সেবায় দিন যাপন করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৫৪৭ সালে মেববারের রাণা উদয় সিং জানতে পারেন মীরা দ্বারকায় রয়েছেন। তিনি মীরাকে ফিরিয়ে আনার জন্য মেবার থেকে একদল ব্রাক্ষণকে বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেন। ব্রাক্ষণেরা মীরার কাছে রাণা উদয় সিংয়ের বার্তা নিয়ে পৌঁছালে মীরা তাঁদের একরাত দ্বারকায় বিশ্রাম নিতে অনুরোধ জানান। পরদিন সকালে দেখা যায় মীরার আারাধ্য শ্রীকৃষ্ণের মুর্তিটি “রণছোড়জী” র বিগ্রহের কাছে থাকলেও মীরার খোঁজ মেলে না কোথাও। জনশ্রুতি অনুযায়ী মীরা তাঁর “গিরিধারী গোপাল” এর মধ্যেই বিলীন হয়ে যান। এর সত্যাসত্যর প্রমাণ মেলে না। এমনকি মীরার মৃতদেহও পাওয়া যায়নি।

আপনার মতামত জানান