মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলা

মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলা

ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে যুগান্তকারী যেসব মামলার হদিশ পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে অবশ্যই অন্যতম একটি হল মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলা টি। সংসদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতার পরিসর, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সংশোধন ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে এসেছিল এই মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলা টি থেকে। সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর ধারা ৪ এবং ৫৫কে আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিল এই মামলার দীর্ঘ শুনানি, সওয়াল জবাবের পর। এর প্রধান কারন ছিল সেই ধারাগুলি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মতবাদকে লঙ্ঘন করেছিল এবং সংসদকে সংবিধান সংশোধনের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান করেছিল। অনুচ্ছেদ ৩১সি-ও বাতিল করেছিল আদালত। এমনকি ৩৬৮ ধারার ৪ ও ৫ ধারাগুলিকেও মৌলিক কাঠামোর রক্ষার্থে বাতিলের খাতায় ফেলা হয়েছিল। সংসদের হাতে যে সংবিধানের এই মৌলিক কাঠামো সংশোধনের কোনো ক্ষমতা থাকবে না তা নিশ্চিত করে তুলে ধরেছিল এই মিনার্ভা মিলস মামলাটি। মূলত একটি টেক্সটাইল সংস্থার সঙ্গে ভারত সরকারের এক ঐতিহাসিক আইনি লড়াই ছিল এটি।

বেঙ্গালুরু শহরের নিকটে অবস্থিত মিনার্ভা মিলস হল আসলে একটি টেক্সটাইল মিল। সেসময় সরকার সমাজতন্ত্রের মডেলের দিকে মনোযোগী হয়েছিল এবং জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য ধুঁকতে থাকা কোম্পানীগুলিকে অধিগ্রহণ করছিল। ১৯৭০ সালে মিনার্ভা মিলের উৎপাদন ব্যপক হারে হ্রাস পাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার এর যথাযথ তদন্তের জন্য শিল্প উন্নয়ন আইন, ১৯৫১-এর (Industries Development Act, 1951) ধারা ১৫ অনুযায়ী একটি কমিটি গঠন করেছিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে সেই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারকে উৎপাদন সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেছিল। এই রিপোর্টের পরে, ১৯৫১ সালের আইনের ১৮এ ধারার অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশানাল টেক্সটাইল কর্পোরেশন লিমিটেডকে এই মিলের অধিগ্রহণ এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়ার অনুমোদন প্রদান করে। সিক টেক্সটাইল আন্ডারটেকিংস (জাতীয়করণ) আইন, ১৯৭৪-এর বিধানের অধীনেই কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা এই অধিগ্রহণটির জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭৪-এর আইন ব্যাপক জনস্বার্থের লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টেক্সটাইল কোম্পানির দুর্বল সম্পদের পুনর্গঠন এবং একটি সম্ভাব্য সমাধানের উন্নয়ন এই আইনের লক্ষ্য ছিল। এর লক্ষ্য ছিল যে পণ্যগুলি যুক্তিসঙ্গত মূল্যে পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করা যাতে সাধারণ জনগণের ক্ষতি না হয়। যদিও মিনার্ভা মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ বাজেয়াপ্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কয়েকজন। ৪২তম সংশোধনীর ধারা ৪-এ যেহেতু বলা ছিল, যে, সমস্ত সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা কার্যকর করার জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বিচারিক পর্যালোচনার বাইরে, সেই কারণে প্রথমে এই অধিগ্রহণকে তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। সেকারণে ৪২তম সংশোধনের এই ধারা ৪-কেই আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তাঁরা। ৩৯তম সংশোধনী আইনের সাংবিধানিকতার প্রতিও প্রশ্ন তুলেছিলেন।

এই মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলা র মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলি আদালতের সামনে এসেছিল, সেগুলি হল, সংবিধান (৪২তম সংশোধন) আইন, ১৯৭৬-এর ধারা ৪ এবং ৫৫ সাংবিধানিকভাবে বৈধ কিনা এবং ৩৬৮ অনুচ্ছেদের ধারা ৪ এবং ৫-এর বৈধতা কতখানি? আবেদনকারীদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিখ্যাত সাংবিধানিক আইনজীবী ননী পালকিওয়ালা। তাঁর যুক্তিগুলি ছিল, প্রথমত, সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রকৃতিগতভাবে সংসদের ক্ষমতা সীমিত এবং ৩৬৮ অনুচ্ছেদের অধীনেও সংবিধান সংশোধনের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন যক, অনুচ্ছেদ ৩৬৮ সেই সমস্ত সংশোধনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ যা আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে কোনরকম প্রভাবিত করে না। ননীবাবু বলেন, ‘ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপাল অব স্টেট পলিসি’ (DPSP) মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের মূল্যে অর্জন করা যায় না। সংবিধানের উভয় অংশের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আইনগত   প্রতিকার পাওয়ার অধিকার গনতন্ত্রের একটি মূল কথা। সংশোধনীর ধারা ৪ এই মৌলিক আইনগত অধিকারকে খর্ব করেছে, ফলে আমাদের গণতন্ত্র ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

আবার ৪২তম সংশোধনীর ধারা ৫৫ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংসদকে অবাধ ক্ষমতা প্রদান করে। এটি আমাদের সংবিধানের পক্ষে এবং দেশের পক্ষেও ক্ষতিকর হতে পারে। তাছাড়া ধারা ৫৫ অনুযায়ী যেহেতু সংসদে ভোটপ্রক্রিয়ার দ্বারা সংঘটিত সাংবিধানিক সংশোধনী পরীক্ষা করার এক্তিয়ার কোনো আদালতের নেই, ফলে বিচারবিভাগ এবং আইনসভার মধ্যে ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই মর্মে ৫৫ ধারাটিকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আবেদনকারীরা। ৩১সি অনুচ্ছেদ, রাষ্ট্রীয় নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে কার্যকরী করতে সহায়তা করে। এই ৩১সি অনুযায়ী ৩৯ অনুচ্ছেদের ধারা (বি) এবং (সি)তে থাকা নির্দেশমূলক নীতিগুলি কার্যকর করার জন্য পাশ করা আইন যদি ১৪, ১৯ বা ৩১-এ বর্ণিত কোনো অধিকার খর্বও করে, তবুও সেই আইন বাতিল করা চলবে না। মৌলিক অধিকার বাতিলকে প্রশ্রয়দানের জন্য ৩১সি-কেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আবেদনকারীরা। তাছাড়া ৪২তম সংশোধনী আইনের ৫৫ ধারার দ্বারা ৩৬৮ অনুচ্ছেদের ধারা (৪) এবং (৫)কে সন্নিবেশিত করার কারণে, সংসদ সংবিধান সংশোধনের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা অর্জন করে এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে সীমিত করারও ক্ষমতা হাতে পায়। সেকারণেই এই ধারাগুলিকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁরা।

অপরদিকে বিবাদী পক্ষের তরফ থেকে এইসমস্ত যুক্তির উত্তরে কিছু জোরালো প্রতিযুক্তি সাজাতে দেখা যায়। তাঁরা বলেন, নির্দেশমূলক নীতিগুলির বাস্তবায়নকে সুরক্ষিত করা মানে  কখনই সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলিকে ধ্বংস করা বা ক্ষতি করা বোঝায় না। তাঁদের বক্তব্য যে, জনগণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে কিছু মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ এবং মৌলিক কাঠামো ধ্বংস, কখনই এক ব্যপার নয়। এই মর্মেই ৩১সি-কেও তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, ৩৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের ক্ষমতা সীমাহীন এবং ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে খুব বেশি পরিবর্তনও করা হয়নি।  তাঁরা মনে করেন যে, রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশিক নীতিতে বর্ণিত লক্ষ্যগুলি পূরণের জন্য সংসদের ক্ষমতা সর্বোচ্চ হওয়া উচিত এবং এর সংশোধন ক্ষমতার উপর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। বিবাদী পক্ষের মত, যে, যেহেতু এটি একটি একাডেমিক স্বার্থের সমস্যা, সেই কারণে এই বিষয়ের সিদ্ধান্ত দেওয়ার থেকে আদালতের নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাই কর্তব্য।

এমনই দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পর ১৯৮০ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট মিনার্ভা মিলস বনাম ভারত মামলার ঐতিহাসিক কিছু রায় প্রদান করেছিলেন। যেসমস্ত বিচারপতি এই মামলার বিচারের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা হলেন, ওয়াইভি চন্দ্রচূড় (প্রধান বিচারপতি), এনএল উন্টওয়ালিয়া, এসি গুপ্তা, পিএস কৈলাসাম এবংপিএন ভগবতী। প্রথম চারজনের সিদ্ধান্ত এক তরফে গেলেও বিচারপতি পিএন ভগবতী কিন্তু তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। যাইহোক, দীর্ঘ শুনানি ও সওয়াল-জবাবের পর আদালতের সংখ্যাগরিষ্ট বিচারপতির যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার সত্যিই ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

আদালত বলেছিল, সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা উচিত কারণ তারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো মতবাদের অংশ। ৩১সি দ্বারা রাষ্ট্রীয় নির্দেশমূলক নীতিগুলির জন্য প্রদত্ত আইনগুলির উচিত মৌলিক অধিকারগুলি খর্ব বা ধ্বংস না করে কাজ করা এবং লক্ষ্য অর্জন করা৷ কিন্তু ৩১সি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৯ লঙ্ঘন না করে কাজ করতে পারে না, অতএব ৩১সি ধারায় পরিবর্তন (ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকারগুলির উপর সংবিধানের চতুর্থ অংশে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতিগুলির অগ্রাধিকার দেওয়া) এনেছিল যে ৪২তম সংশোধনের ধারা ৪, সেটিকেই অসাংবিধানিক ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আদালত। আবার ধারা ৫৫ অনুযায়ী যেহেতু আদালতে কোনো চ্যালেঞ্জই সম্ভব নয়, সেই কারণে কোর্ট এই ধারাটিকেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, এই ধারাটি সংবিধানের প্রকৃতিকে গণতান্ত্রিক থেকে একনায়কত্বে পরিবর্তিত করার ক্ষমতা রাখে যা ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা ও অভিনবত্ব অনুযায়ী কাজ করে এবং কেউ তাদের আচরণকে আইনের আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। অতএব এই ধারাটিকেও আদালত অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছিল। দ্বিতীয়ত আদালত ৩৬৮ অনুচ্ছেদে নতুন প্রযুক্ত দুই ধারা (৪) এবং (৫)-এর কঠোর নিন্দা করেছিল। ৫ ধারাটিতে সংসদকে সংবিধান সংশোধনের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আদালত জানিয়ে দেয়, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো মতবাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার অবাধ ক্ষমতা সংসদের থাকতে পারে না। এগুলিকে সুরক্ষিত করা দরকার কারণ এটি সংবিধানের মূল ভিত্তি তৈরি করে এবং সংবিধানকে কাজ করার ক্ষমতা দেয়। আবার ৩৬৮-এর ধারা ৪-এ উল্লিখিত যে, সংশোধনী আইনের বৈধতাকে বিচারিক পর্যালোচনার আওতার বাইরে রাখা হবে৷ আদালত এই ধারাটিরও চূড়ান্ত বিরোধিতা ও নিন্দা করে জানিয়েছে, সংসদ যাতে অত্যাচারী উপায়ে আইন পাস না করে তা নিশ্চিত করার জন্য বিচারিক পর্যালোচনার এই ক্ষমতা প্রয়োজন। যদি বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা বন্ধ করা হয় বা দেওয়া না হয়, তাহলে সংবিধানের তৃতীয় অংশের অধীনে মৌলিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত বিধানগুলি অপ্রয়োগযোগ্য হয়ে পড়বে।

এই ঐতিহাসিক রায় সংবিধানের ভিত্তিভূমিকে আরও দৃঢ় করেছিল। রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতি সংবিধানের তৃতীয় অংশের অধীনে অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারগুলিকে বাতিল না করেও অনেক বড় কাজ করতে পারে, এই মামলাতে সেই দিকটি উঠে এসেছিল। সর্বোপরি সংসদের সংশোধনী ক্ষমতাকে সীমিত করে যেমন সংবিধান নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতায় লাগাম টেনেছিল আদালত, তেমনি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোটির সুরক্ষার্থেও এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আপনার মতামত জানান