ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের এক প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এক বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত মতিলাল নেহেরু (Motilal Neheru)। ১৯১৯ থেকে ১৯২০ সাল এবং ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত মোট দু বার তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন তাঁরই পুত্র এবং ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন তাঁর নাতনি। ভারতের গণপরিষদ গঠনের অনেক আগেই মতিলাল নেহেরু বিখ্যাত নেহেরু রিপোর্টের খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়। গান্ধীজি পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মতিলাল নেহেরু।
১৮৬১ সালের ৬ মে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের আগ্রায় মতিলাল নেহেরুর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম গঙ্গাধর নেহেরু এবং তাঁর মায়ের নাম শ্রীমতি জেওরাণী। বলা হয়, মতিলালের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীর নিবাসী কৌল ব্রাহ্মণ। ১৭১৬ সাল নাগাদ তাঁর পূর্বপুরুষ পণ্ডিত রাজ কৌলকে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়রকে দিল্লিতে নিয়ে এসে চাঁদনি চকের কাছে একটি বাসস্থান গড়ে দেন। তাঁদের বাসস্থানের পাশ দিয়ে নাহার বা খাল বয়ে যাওয়ার কারণেই তাঁদের বংশের উত্তরসূরিরা পরিচিত হন নেহেরু নামে। পণ্ডিত রাজ কৌলের প্রপৌত্র পণ্ডিত মৌসা কৌল এবং তাঁর পুত্র পণ্ডিত লক্ষ্মীনারায়ণ কৌল। লক্ষ্মীনারায়ণের পুত্র পণ্ডিত গঙ্গাধর দিল্লিতে একজন পুলিশ অধিকর্তা ছিলেন, কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় তাঁর চাকরি চলে যায়। সেই সময় তিনি পরিবার সহ আগ্রায় চলে আসতে বাধ্য হন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে গঙ্গাধরের মৃত্যু হওয়ার তিন মাস পরে শ্রীমতি জেওরাণী মতিলালের জন্ম দেন। বাবার মৃত্যুর কারণে শৈশবে অনেক দারিদ্র্য-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে। তাঁর মা জেওরাণীও অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। মতিলাল নেহেরুর দুই বড় দিদি পাটরাণী এবং মহারাণীর বিবাহ হয়ে গিয়েছিল বাবার বেঁচে থাকার সময়েই। তাঁর দুই দাদার নাম যথাক্রমে বংশীলাল এবং নন্দলাল। পরিবারে আর্থিক অনটন হওয়ার কারণে জেওরাণী তাঁর ভাই অমরনাথ জুৎসির কাছে এসে থাকতে শুরু করেন। সিপাহি বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে কয়েক বছরের মধ্যেই নন্দলাল ক্ষেত্রীর রাজার সভায় একজন কেরানির কাজ পান, এতে পরিবারে আর্থিক দিক থেকে কিছুটা সুরাহা হয়। এর ফলেই মতিলালের শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে ক্ষেত্রীতে। বলা ভালো বড় দাদা নন্দলালের কাছেই বড়ো হয়েছেন মতিলাল নেহেরু। প্রথম বিবাহিত স্ত্রী এবং প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয়বার মতিলাল নেহেরু বিবাহ করেন শ্রীমতি স্বরূপ রাণীকে। তাঁর এবং মতিলালের একমাত্র পুত্রসন্তান জওহরলাল নেহেরু পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
নন্দলালের কাছেই শৈশবে আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। ওকালতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৮৩ সালে কানপুরে আইন অভ্যাস করা শুরু করেন তিনি। এই সময় পণ্ডিত পৃথ্বী নাথের অধীনে শিক্ষানবিশি করেন তিনি। তিন বছর পরে ১৮৮৬ সালে এলাহাবাদে গিয়ে মতিলাল তাঁর দাদার সঙ্গে একত্রে ওকালতি করা শুরু করেন। তাঁর দাদা নন্দলাল মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা গেলে তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান সহ এক বিরাট পরিবারের দায়িত্বভার নিতে হয় মতিলালকে। তাঁর যখন তিরিশ বছর বয়স, সেই সময় ওকালতিতে প্রভূত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন তিনি। সেই সময় তাঁর আয় বেড়ে হয় মাসিক দুই হাজার টাকা। ক্রমে চল্লিশ বছর বয়সে এসে তাঁর আয় আরো বেড়ে যায়। তাঁর দক্ষতায় ও খ্যাতির জন্য মুখ্য বিচারপতি স্যার জন এজ ১৮৯৬ সালে তাঁকে এলাহাবাদের উচ্চ আদালতের উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯০৯ সালে প্রিভি কাউন্সিলের জুডিসিয়াল কমিটিতে ওকালতি করার সুযোগ পান মতিলাল নেহেরু। তাঁর বেশিরভাগ মামলাই ছিল জমিজমা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা। বড়ো বড়ো জমিদার পরিবারের সঙ্গে এই মামলার সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর। ইতিমধ্যে ১৯০০ সালে শহরের অভিজাত মহল্লায় একটি বিরাট বাড়ি কেনেন মতিলাল এবং তার নাম দেন আনন্দ ভবন। এদিকে প্রায়ই তাঁর ইউরোপ যাত্রাকে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণেরা খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। কালাপানি পার করার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতেও চাননি তিনি। ১৯০৭ সালে এলাহাবাদে কংগ্রেসের সম্মেলনে নরমপন্থী নেতা হিসেবে সভাপতিত্ব করেন তিনি। ১৯১৬ সালে অ্যানি বেসান্তের হোম রুল লিগ আন্দোলনে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেন তিনি। সেই কারণে তাঁকে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অফ দ্য হোম রুল লিগ’ উপাধিতে ভূষিত করে। এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য লিডারস’-এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মতিলাল নেহেরু। ১৯১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি নিজের উদ্যোগে ‘দ্য ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট’ নামে আরেকটি দৈনিক পত্রিকা চালু করেন। নিজের মানসিকতার অনুরূপ উদার চিন্তাভাবনার প্রকাশ করতে পেরেছিলেন তিনি এই পত্রিকায়। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবে প্রথম মতিলাল নেহেরুই নিজের পাশ্চাত্য পোশাক পড়ার রীতি এবং বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করেন। একেবারে ভারতীয় সনাতন আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন মতিলাল। তাঁর বিরাট পরিবারের দায়ভার নেওয়া এবং বাড়ি-ঘর নির্মাণের খরচের জন্য তিনি আবার ওকালতি করা শুরু করেন। পরে ‘স্বরাজ ভবন’ নামে আরেকটি বাড়িও তিনি কিনেছিলেন এলাহাবাদে। এই বাড়িটি আগে ছিল স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের ।
১৯১৯ সালের অমৃতসর প্রাদেশিক সভায় প্রথমবার ভারতের জাতীয় কংগ্রসের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি এবং পরে ১৯২৮ সালে কলকাতার প্রাদেশিক সভায় দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হন মতিলাল। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ঐ বছরই ডিসেম্বর মাসে অমৃতসর কংগ্রসের সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। ১৯২০ সালে কলকাতায় অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মতিলাল। এই অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই মতিলাল নেহেরু গ্রেপ্তার হন। ১৯২২ সালে চৌরিচৌরার ঘটনায় অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে গান্ধীজির কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি স্বরাজ দলে যোগ দেন। ইউনাইটেড প্রভিন্স লেজিসলেটিভ কাউন্সিলেও নির্বাচিত হন তিনি। ১৯২৩ সালে নয়া দিল্লিতে ব্রিটিশ ভারতের নতুন কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত হন মতিলাল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ভারতীয় অফিসারদের নিয়োগের ব্যাপারে একটি কমিটিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন মতিলাল। ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে ভারতের পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে একটি সংবিধানের খসড়া নির্মাণের জন্য মতিলাল নেহেরু একটি প্রতিনিধিস্থানীয় সম্মেলন আয়োজন করেন। কিন্তু বিধানসভা তাঁর এই প্রস্তাবকে অস্বীকার করে আর সেই জন্য নেহেরু ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী বিধানসভা ত্যাগ করেন। ১৯১৬ সালে মতিলাল নেহেরুর সঙ্গে রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেন তাঁর পুত্র জওহরলাল নেহেরু। ১৯২৮ সালে বিখ্যাত নেহেরু কমিশনের সভাপতিত্ব করেন মতিলাল নেহেরু। সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করেছিল এই ভারতীয় কমিশন। ভারতীয়দের দ্বারা লিখিত প্রথম সংবিধানের খসড়া প্রকাশ করে এই কমিশন যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও আইনি অধিকারের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই কমিশনকে সমর্থন করলেও, মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এর বিরোধিতা করে। নেহেরু রিপোর্ট স্বীকৃতি না পেলে ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মতিলাল নেহেরু এবং তাঁকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস কারাবরণও করেছিলেন তিনি। গান্ধীজির লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেওয়ার জন্য নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া সত্ত্বেও গুজরাটে পাড়ি দিয়েছিলেন মতিলাল।
তাঁর বক্তৃতাগুলির সংকলন করে পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালে একটি বই প্রকাশ পায় ‘দ্য ভয়েস অফ ফ্রিডম : সিলেক্টেড স্পিচেস অফ পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু’ নামে। তাঁর সব রচনা ও বক্তৃতার একত্রিত সংকলন ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অফ মতিলাল নেহেরু’ নামে। এমনকি বহু লেখক তাঁর জীবনীও লিখেছেন যা থেকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৩১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মতিলাল নেহেরুর মৃত্যু হয়।
2 comments