আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস

১৮ জুলাই ।। আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলি মধ্যে একটি হল আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস (Nelson Mandela International Day) ।

সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ১৮ জুলাই এই দিনটি পালন করা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনের দিন আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস উদযাপিত হয়।

২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘ (United Nations) আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটির ঘোষণা করার পর ২০১০ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করতে শুরু করে। এটি আর পাঁচটি দিবসের মতো কোনো পালনীয় ছুটির দিন নয়। নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শকে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই দিনটি উদযাপিত হয়। প্রথম থেকেই এই দিনটি বিশেষ কিছু কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করা হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস পালিত হয় নেলসন ম্যান্ডেলার একানব্বইতম জন্মদিনে।

এই উদযাপনের পিছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে, তা জেনে নেওয়া যাক। ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল ৪৬৬৬৪ কনসার্ট এবং নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন গোটা বিশ্বের আম জনতার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যান্ডেলা দিবসের দাবির সমর্থনে সঙ্গে থাকার জন্য আহ্বান জানায়। গোটা বিশ্বের কাছে এই যে আহ্বান পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তার মূলে ছিল একটি সামগ্রিক চিন্তা। নেলসন ম্যান্ডেলা যেভাবে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে নিজের দেশবাসীর জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের পা বাড়িয়েছিলেন, জাতির উন্নতির জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তা সমস্ত বিশ্ববাসীর আদর্শ হওয়া উচিৎ। প্রতিটি মানুষের মধ্যে পৃথিবীকে বদলে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে, একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আনার যোগ্যতা রয়েছে। এই চিন্তা থেকে বিশ্ববাসীর কাছে ম্যান্ডেলা দিবসের আহ্বান জানানো হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ৪৬৬৬৪ কনসার্টের সঙ্গে সরাসরি নেলসন ম্যান্ডেলা জড়িত। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলা দ্বিতীয় বারের জন্য রবেন দ্বীপে (Robben Island) কারারুদ্ধ হন। সেই বছরে তিনি ছিলেন, চারশো ছেষট্টিতম বন্দী। ১৯৮২ সালে তাঁকে পোলস্মোর জেলে (Pollsmoor Prison) স্থানান্তরিত করার আগে অবধি জেলে তাঁর পরিচয় ছিল কয়েদি নম্বর ৪৬৬/৬৪। এই নম্বরটি তাঁর একটি বিশিষ্ট পরিচয় হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডসের পক্ষে সচেতনতা প্রচার চালাতে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় এই সংখ্যাটির সাথে জুড়ে। ম্যান্ডেলা দিবসের বিশ্বব্যাপী আহ্বানকে জনপ্রিয় করতে এই কনসার্টটির ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

নেলসন ম্যান্ডেলার মানবিক দিকের প্রতি সম্মান জানাতে চেয়েই ম্যান্ডেলা দিবসের জন্য প্রচার চালানো হয়। ম্যান্ডেলা দিবসের প্রচারের বার্তাই ছিল এইরকম, “নেলসন ম্যান্ডেলা সামাজিক ন্যায়ের জন্য ৬৭ বছর ধরে লড়াই করেছেন, আমরা আপনাদের ৬৭ মিনিট দিয়ে শুরু করতে বলছি।” নেলসন ম্যান্ডেলার তরফ থেকে একটি বিবৃতি মারফত জানানো হয়, “যদি এই ধরণের একটি দিন সারা দুনিয়ার দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়া; শান্তি, সমন্বয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষজনকে একসঙ্গে নিয়ে আসতে পারে তবে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করব।” স্বেচ্ছাশ্রম এবং পল্লিসেবার মাধ্যমে নেলসন ম্যান্ডেলার মূল্যবোধ এবং আদর্শকে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার লক্ষ্যে এই বিশ্বব্যাপী আহ্বান জানানো হয়, যাতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসাবেই শুধু নয়, একজন দায়িত্ববান এবং কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসাবে নেলসন ম্যান্ডেলার কীর্তি আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করতে পারে। মূলত নেলসন ম্যান্ডেলার কিছু দাতব্য সংস্থা যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন, নেলসন ম্যান্ডেলা চিলড্রেন্স ফান্ড ( Nelson Mandela Children’s Fund), ম্যান্ডেলা রোডস ফান্ডের (Mandela Rhodes Fund) কাজকে তুলে ধরার জন্য এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন কাজগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অর্থ সংগ্রহের জন্য এই প্রচারটি চালানো হয়।

আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসে বিশ্ব জুড়ে মানুষজন সাতষট্টি মিনিটের জন্য কিছু না কিছু ভাল কাজ করে থাকেন। এই সাতষট্টি মিনিটের সময়পর্বের একটি তাৎপর্য রয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা যে সাতষট্টি বছর ধরে দেশের জন্য কাজ করেছেন, এই সাতষট্টি মিনিট সেই প্রতিটি বছরের দ্যোতক। উত্তরাধিকার সূত্রে দায়িত্বের পালাবদলের বিষয়টি মাথায় রেখে এই অভিনব পরিকল্পনার অবতারণা করা হয়।

২০১৯ – ২০২০ অর্থবর্ষে আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসের লক্ষ্য সম্পর্কে একটি সুপরিকল্পিত রূপরেখা পাওয়া যায়, যার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থানের মতো প্রাথমিক চাহিদা পূরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

১) শিক্ষা এবং সাক্ষরতা প্রকল্পে প্রতিটি শিশুর সামগ্রিক উন্নতির জন্য গুণগত শিক্ষা এবং শৈশবকালীন বিকাশ (Early Childhood Development, ECD) সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।

২) খাদ্য এবং পুষ্টি প্রকল্পে পুষ্টিযুক্ত খাদ্যের যোগান দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে অপুষ্টি দূরীকরণেও এই প্রকল্প সমান প্রাসঙ্গিক ভূমিকা নিচ্ছে।

৩) বাসস্থান বা আশ্রয় প্রকল্পে গৃহহীন নাগরিকদের পাকাপাকি বাসস্থানের দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে, এবং গৃহহীনতা দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।

৪) স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রকল্পে প্রতিটি বিদ্যালয়সহ সর্বত্র নিরাপদ স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে।

৫) সক্রিয় নাগরিকত্ব প্রকল্পে দারিদ্র্য ও সামাজিক অসাম্য দূরীকরণে মানুষজনকে উৎসাহিত করা এবং সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার সামগ্রিক প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকার জননেতা হওয়ায় আফ্রিকায় এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় ঠিকই, কিন্তু বিশ্বের অন্যত্রও সাতষট্টি মিনিট ধরে নানা রকম সমাজ সচেতনতামূলক কাজ এই দিনে করা হয়ে থাকে। আফ্রিকার মানুষের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যাণ্ডেলা দিবসে কী ধরণের কাজ করা যেতে পারে সে সংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব পাওয়া যায়, যা যেকোনো দেশের যেকোনো মানুষ সহজেই অনুসরণ করতে পারবেন—

·         কম উপকরণ থাকা বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের জন্য কিছু শিক্ষাসহায়ক সামগ্রী যেমন বই, কম্প্যুউটার ইত্যাদি পৌঁছে দিয়ে আসা

·         নিজের এলাকায় নিরাপদভাবে সাফাই অভিযান করা

·         সরকারি হাসপাতালের রোগীদের জন্য কেয়ার কিট (Care Ki) সরবরাহ করা, যাতে চিরুনি, মাজন, সাবানের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকবে।

·         পশু আশ্রয় কেন্দ্র থেকে কোনো পশুকে দত্তক নেওয়া

·         স্থানীয় গ্রন্থাগারে বই, বৃদ্ধাশ্রমে পত্রিকা দান করা

·         বয়স্ক মানুষজনের জন্য ওষুধপত্র বা জিনিস এনে দেওয়া

·         এলাকার কোনো বয়স্ক মানুষের সাথে বিকেলে হাঁটতে বেরোনো

·         একজনকে কম্প্যুউটার এবং ইন্টারনেট (Internet) ব্যবহার করা শেখানো

·         বিশেষভাবে চিন্তা করার মতো কোনো বিষয় নিয়ে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদককে চিঠি লেখা

·         নিজে হাতে কাঁথা বানিয়ে এমন একজনকে দেওয়া যার সেটির সত্যি দরকার

·         প্রাথমিক চিকিৎসা করতে শেখা, অঙ্গদানের অঙ্গীকার করা এবং রক্তদান করা

·         কারোর বাড়ি তৈরি করতে সাহায্য করা

·         নিজের বাড়ির জন্য একটি পুনর্ব্যবহারমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা

·         এমন কোনো জায়গায় বৃক্ষ রোপণ করা যেখানে সবাই সেই গাছের থেকে লাভবান হবে

প্রত্যেক বছরই এই দিনটি বিশ্বজুড়ে একটি নির্দিষ্ট থিম বা প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। ২০১৯ ও ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – পদক্ষেপ নাও – পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করো – প্রতিটা দিনকে ম্যান্ডেলা দিবস বানিয়ে তোলো  (Take Action – Inspire Change – Make Every Day a Mandela Day)।  ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – একটি হাত আরেকটি হাতে খাদ্য তুলে দিতে পারে (One Hand Can Feed Another)।  ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – যে পরিস্থিতিতে আছো, যতটা তোমার সামর্থ্য তার মধ্য দিয়েই যতটা পারো কর (Do what you can, with what you have, where you are)। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য – জলবায়ু, খাদ্য, সংহতি  (Climate, Food & Solidarity)।  

নেলসন ম্যান্ডেলার অবিস্মরণীয় কীর্তি এবং আদর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিগত দশ বছর ধরে এরকম বেশ কিছু ইতিবাচক অংশগ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবসটি উদযাপন করে আসছেন, যা সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজ গঠনে এবং সহনাগরিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

One comment

আপনার মতামত জানান