বিশিষ্ট ভারতীয় সাহিত্যিক ও সমালোচক নীরদচন্দ্র চৌধুরী (Nirad Chandra Chaudhuri) মূলত তাঁর দ্বান্দ্বিক ও স্ববিরোধী বক্তব্য তথা আচরণের জন্য পরিচিত। আজীবন তাঁর মনের মধ্যে একইসঙ্গে ইংরেজ-প্রেম এবং ভারতীয়ত্বের অহংকার প্রকাশিত ছিল সমানভাবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাঁর অমোঘ প্রীতি তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রে ফেলেছিল বারবার। এমনকি কোন কোন লেখায় তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী বলেও উল্লেখ করেছেন। শতাধিক বছরের দীর্ঘ জীবনে দুটি আত্মজৈবনিক গদ্য লিখেছেন নীরদ চন্দ্র চৌধুরী যার মধ্যে ৫৩ বছর বয়সে লেখা তাঁর প্রথম আত্মজীবনী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইণ্ডিয়ান’-এর উৎসর্গপত্রকে ঘিরে ভারতের প্রশাসক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। বিখ্যাত পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার এবং ব্রিটিশ শাসক লর্ড ক্লাইভের জীবনীও লিখেছিলেন তিনি। এছাড়া হিন্দু ধর্ম বিষয়ে ইংরেজিতে তিনি লিখেছিলেন ‘হিন্দুইজম’ নামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর প্রথমবার বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘প্যাসেজ টু ইংল্যাণ্ড’ বইতে। ১৯৯০ সালে অক্সফোর্ড থেকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন নীরদ চন্দ্র চৌধুরী এবং ১৯৯২ সালে ইংল্যাণ্ডের রানি তাঁকে ‘সিবিই’ উপাধি দেন। ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠি’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন নীরদ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর অন্যতম আলোচিত বই ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ রবীন্দ্রনাথের জীবনের স্ববিরোধকে তুলে ধরে।
১৮৯৭ সালের ২৩ নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী পেশায় ছিলেন একজন উকিল এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সুশীলা সুন্দরী চৌধুরানি। তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন নীরদ। ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত এক উদারমনা হিন্দু পরিবারে জন্ম হয়েছিল নীরদচন্দ্র চৌধুরীর। কৈশোরে কিশোরগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরিতেই তিনি নেপোলিয়নের খানসামার লেখা একটি বই খুঁজে পান, তার সঙ্গে বাড়ির আলমারি থেকে খুঁজে পান স্যার নীল ক্যাম্পবেলের নেপোলিয়নকে লেখা একটি বই। এই বই পাঠ করে ক্রমে ক্রমে তাঁর মধ্যে বিদেশপ্রীতি জন্মায়। পরবর্তীকালে অমিয়া চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর আত্মজীবনীতে নীরদচন্দ্র চৌধুরী এই বিবাহের প্রাক-পর্বের এক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন যে, তাঁর এক পারিবারিক আত্মীয় শ্যামবর্ণ অমিয়া দেবীকে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নীরদকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে এতে তাঁদের কন্যারাও শ্যামবর্ণ হবে। অমিয়া দেবীকে বিয়ে না করে নীরদের উচিৎ ছিল কোনো ফর্সা রমণীকে বিবাহ করা। এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নীরদ বাবাকে জানিয়ে দেন যে এই ভদ্রলোককে যেন কোনোভাবেই বিবাহে নিমন্ত্রণ না করা হয়। কিন্তু এককালে সেই লোকটি পরিবারের বিপদে-আপদে সাহায্য করেছিলেন সে কথা বাবার কাছ থেকে শুনে রাগ সংবরণ করেন নীরদ।
কিশোরগঞ্জ স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে নীরদচন্দ্র চৌধুরী কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। এরপরে তিনি ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে ইতিহাস পড়ার জন্য। মেধাবী নীরদচন্দ্র সেই কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। কিন্তু স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি। তাছাড়া একবার অনুত্তীর্ণ হয়ে দ্বিতীয়বার আর পরীক্ষায় বসতে চাননি তিনি। কলেজে পড়াকালীনই ১৯১৭ সালে ‘অবজেক্টিভ মেথডস ইন হিস্ট্রি’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন তিনি।
ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে একজন হিসাবরক্ষক কেরানি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। এই সময় নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে থাকেন তিনি। এই সময় ভারতচন্দ্রের উপর তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। কিছুদিনের মধ্যেই কেরানির কাজ ছেড়ে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে থাকেন তিনি। ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠি’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন নীরদ চৌধুরী। তাছাড়া এই পত্রিকাগুলির সম্পাদকীয় বিভাগও সামলেছেন তিনি দক্ষ হাতে। ১৯৩৮ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্র বসুর, নীরদ তাঁর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। এর ফলে সেকালের ভারতে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় বেতার বিভাগে নিযুক্ত হন নীরদ চন্দ্র চৌধুরী।
তাঁর পরিচিতি মূলত গড়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যকর্ম ও প্রবন্ধ-গ্রন্থকে কেন্দ্র করে। তাঁর প্রথম বইটিই ছিল ৫৩ বছর বয়সে লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইণ্ডিয়ান’ যা ১৯৫১ সালে প্রকাশ পায়। এই বই থেকেই তাঁর জীবনের অধিকাংশ তথ্য জানা যায়। দেশ ও বিদেশ উভয় ক্ষেত্রেই এই বইটি লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, একইসঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত হন নীরদচন্দ্র। এই বইতেই তিনি লিখেছেন কিশোরগঞ্জ থেকে কলকাতায় এসে ‘বাঙাল’ বিদ্রুপ শোনার কষ্টের কথা। তাছাড়া সেই সময়ের কলকাতায় অনেকেই তাঁকে দেখে তাঁর সামনে বা আড়ালে ‘বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু’ ইত্যাদি বিদ্রুপাত্মক ছড়া কাটতো। তাতে যে তিনি গভীরভাবে ব্যথিত হতেন, সেই হতাশার সুর ফুটে উঠেছে তাঁর আত্মজীবনীতে। কলকাতায় থাকার সময়েই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। তাঁরা সকলে একই মেসে থাকতেন। নিজের উদ্যোগে ‘সমসাময়িক’ ও ‘নতুন পত্রিকা’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন নীরদচন্দ্র। তাঁর প্রথম আত্মজীবনীর ভূমিকায় নীরদচন্দ্র লেখেন যে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম পঞ্চাশ বছর ভুলে যেতে চান কারণ তা ছিল ব্যর্থতার সময়কাল। তাছাড়া এই বইতে নিজেকে এক ব্যর্থ মানুষ বলেই পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সবথেকে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল এই বইয়ের উৎসর্গপত্রকে ঘিরে যেখানে নীরদ চন্দ্র লিখেছিলেন – ‘ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মৃতিতে’। সেই সময়কার রাজনৈতিক মহল এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী এই লেখার জন্য নীরদওচন্দ্রকে সাম্রাজ্যবাদী লেখক বলে দাগিয়ে দেন। আধুনিক ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডেভিড লেলিভেল্ডের মতে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন একজন উদ্ধত, দ্বান্দ্বিক এবং সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যের অংশীদার যিনি আসলে ইংরেজদের নিজস্ব খেলায় তাঁদেরকেই হারিয়েছেন। তাত্ত্বিক ভি. এস. নাইপল তাঁর এই আত্মজীবনী প্রসঙ্গে বলেন যে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্যের প্রতি এমন কটাক্ষ ভারতীয় উপমহাদেশে আর কেউ করেননি। এই আত্মজীবনীর প্রথম তিনটি অধ্যায়ে নিজের জন্মস্থান, পুরনো গ্রাম আর তাঁর মামার বাড়িকে নিয়ে লিখেছেন নীরদচন্দ্র আর তারপরে এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ইংল্যাণ্ড’ শিরোনামের ভিতরে তাঁর জীবনে ইংল্যাণ্ড ও ইংরেজদের গভীর প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। তাছাড়া এই বইয়ের প্রচ্ছদে লা রোশফুকোর লেখা ‘ম্যাক্সিম’ কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতি মূল ফরাসি ভাষাতেই লিখেছিলেন নীরদ যার অর্থ ছিল মানুষের বয়স বাড়লে জ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর পাগলামিও বাড়ে। ১৯৫৫ সালে প্রথমবার ইংল্যাণ্ড ভ্রমণ করেন তিনি। এই বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘এ প্যাসেজ টু ইংল্যাণ্ড’ বইতে। ১৯৬৬ সালে তিনি লেখেন ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ সার্স : অ্যান এসে অন দ্য পিপলস অফ ইণ্ডিয়া’ বইটি। ১৯৮৭ সালে তিনি লেখেন তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনীটি যার নাম ‘দাই হ্যাণ্ড, গ্রেট অ্যানার্ক’। এছাড়া বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ ম্যাক্সমুলার এবং ব্রিটিশ শাসক লর্ড ক্লাইভের জীবনীও লিখেছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। হিন্দু ধর্মের উপর ‘হিন্দুইজম’ নামে ইংরেজিতে একটি বই লেখেন তিনি। বাংলায় লেখা তাঁর সবথেকে বিতর্কিত ও আলোচিত বই দুটি হল ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ ও ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’। মোট ১৬টি বইয়ের মধ্যে ১১টি বই-ই তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ডে কাটান নীরদচন্দ্র চৌধুরী। ২০ নং ল্যাডবেরি রোডের একটি তিনতলা বাড়িতে থাকতেন তিনি যেখানে বর্তমানে তাঁর স্মৃতিতে নেমপ্লেটে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর নাম আর বসবাসের সময়কাল হিসেবে ১৯৮২-১৯৯৯ সালের উল্লেখ রয়েছে।
১৯৯০ সালে অক্সফোর্ড থেকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত হন নীরদচন্দ্র চৌধুরী এবং ১৯৯২ সালে ইংল্যাণ্ডের রানি তাঁকে ‘সিবিই’ উপাধি দেন। এছাড়া ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিও পেয়েছেন তিনি। এছাড়া অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ডাফ কুপার মেমোরিয়াল পুরস্কার এবং সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।
১৯৯৯ সালের ১ আগস্ট ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড শহরে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যু হয়।
One comment