বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা পেশাদার পুরুষ টেনিস খেলোয়াড় নোভাক জকোভিচ (Novak Djokovic)। মোট ৩৫৯ সপ্তাহ ধরে বিশ্বের ১ নং টেনিস খেলোয়াড়ের শিরোপা ধরে রাখার রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। ৯টি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের শিরোপা সহ ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম পুরুষ একক প্রতিযোগিতা জয়ের শিরোপাও যুক্ত হয়েছিল তাঁর মুকুটে। সমগ্র ক্রীড়া জীবনে দুবার এটিপি ট্যুরে কেরিয়ার গোল্ডেন মাস্টার্স খেতাব অর্জন করেছেন নোভাক জকোভিচ। মাত্র ২০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে নোভাক রজার ফেডেরার এবং রাফায়েল নাদালের রেকর্ড ভঙ্গ করেন। পরবর্তীকালে নাদাল, ফেডেরার এবং জকোভিচ একত্রে টেনিসের জগতে আধিপত্য করেছেন দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। ২০১১ সালে তিনি প্রথমবার বিশ্বের ১ নং টেনিস খেলোয়াড়ের খেতাব পেয়েছিলেন। ২০১৬ সালে প্রথমবার নোভাক জকোভিচ ফ্রেঞ্চ ওপেনে কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন। ২০১১ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত টেনিসের দুনিয়ায় অন্যতম সেরা তারকা হয়ে উঠেছেন নোভাক জকোভিচ।
১৯৮৭ সালের ২২ মে যুগোশ্লোভিয়ার অন্তর্গত সার্বিয়ার বেলগ্রেড শহরে নোভাক জকোভিচের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম স্রাডান এবং মায়ের নাম ডিজানা জকোভিচ। তাঁর বাবা সার্বিয়ার বাসিন্দা হলেও তাঁর মা ছিলেন ক্রোয়েশীয় মহিলা। নোভাকের দুই ভাইয়ের নাম ছিল যথাক্রমে মার্কো এবং ডিজর্জে। পরবর্তীকালে তাঁরাও পেশাদারি টেনিস খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। কিশোর বয়সেই তাঁর বাবা-মা তাঁকে একটি ছোট র্যাকেট আর একটি ফোমের নরম বল দেন খেলার জন্য। এই জিনিসগুলিই তাঁর কাছে অত্যন্ত আদরণীয় উপহার ছিল। মাত্র চার বছর বয়স থেকে টেনিস খেলা শুরু করেন তিনি। নোভি স্যাড অঞ্চলে একটি টেনিস প্রশিক্ষণ শিবিরে তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। যেহেতু তাঁর বাবা কিংবা মা কারোরই টেনিস খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই নোভাকের প্রশিক্ষণের ভার নিজেরা নিতে পারেননি তাঁরা। ১৯৯৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই মাত্র ছয় বছর বয়সে টেনিসকি ক্লাব পার্টিজান আয়োজিত একটি টেনিস ক্যাম্পে নোভাককে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা স্রাডান। তাঁর বাবা-মা একটি ফাস্ট ফুডের দোকান চালিয়ে অন্নসংস্থান করতেন। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের ১০ জুলাই নোভাক জকোভিচ তাঁর উচ্চ বিদ্যালয়ের বন্ধু জেলেনা রিস্তিককে বিয়ে করেন।
এই প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশিক্ষক ক্তন স্লোভাকীয় টেনিস খেলোয়াড় জেলেনা জেনসিকের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১২ বছর বয়সে জার্মানির ওবারস্লেইভিমের পিলিক টেনিস অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন নোভাক। এই প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক পিলিকের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ চার বছর ধরে টেনিসের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ঠিক এর আগেই যুগোস্লোভিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, প্রাণরক্ষার তাগিদে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে। এই যুদ্ধ নোভাকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সিঙ্গেলস, ডাবলস এবং দলগত প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে আন্তর্জাতিক স্তরের খ্যাতি অর্জন করতে শুরু করেন। ২০০৬ সালের আগে প্রাক্তন স্লোভাকীয় টেনিস খেলোয়াড় মারিয়ান ভাজডা মন্টি কার্লোর বাসিন্দা নোভাককে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে বরিস বেকার তাঁর প্রধান প্রশিক্ষক হওয়ার আগে মারিয়ানই ছিলেন নোভাকের প্রশিক্ষক। এরপরে বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের একটি দলগত প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদকে ভূষিত হন নোভাক। ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন আয়োজিত পরপর পাঁচটি টুর্নামেন্টে জয়লাভ করে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই নোভাক জকোভিচ আন্তর্জাতিক মহলে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
২০০১ সালে যুগোস্লাভ জাতীয় দলের হয়ে জকোভিচ জুনিয়র ডেভিস কাপে অনুর্ধ্ব ১৪ স্তরে খেলার সুযোগ পান। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ইউরোপিয়ান ম্যাচগুলিতে সিঙ্গেলস, ডাবলস এবং দলগত প্রতিযোগিতায় সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে নোভাকের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। ২০০৩ সালে ফ্রেঞ্চ ও ইউএস ওপেনের জুনিয়র ম্যাচে অংশ নেন জকোভিচ। এরপর থেকেই তাঁর পেশাদারি টেনিস জীবন শুরু হয়। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ টেনিস প্রফেশনালস’ অর্থাৎ এটিপি (ATP) আয়োজিত বুদাপেস্টের একটি টুর্নামেন্টে নোভাক জকোভিচ জয়লাভ করেন। ঠিক এর পরের বছরই উইম্বলডন ওপেনে যোগ দিয়ে তিনি তৃতীয় রাউন্ডে পৌঁছান এবং বিশ্বের সেরা ১০০ জনের তালিকার মধ্যে তাঁর নাম উঠে আসে। ২০০৪ সালে বেজিং অলিম্পিকেও যোগ দেন তিনি এবং টেনিস সিঙ্গেলসে সার্বিয়ার হয়ে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টে অংশ নেন নোভাক, কিন্তু বিপক্ষীয় টেনিস খেলোয়াড় মারাত শাফিনের কাছে প্রথম রাউন্ডেই পরাজিত হন তিনি। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মত এটিপি-র সেরা ২০ খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্যতম হওয়ার শিরোপা জেতেন নোভাক জকোভিচ। ক্রমেই একের পর এক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে থাকেন নোভাক। ২০০৭ সালে প্রথম মাস্টার্স সিরিজ জিতে নেন নোভাক এবং তার ফলে বিশ্বের সেরা ১০ টেনিস খেলোয়াড়ের মধ্যে তাঁর নামা উঠে আসে। ঐ বছরই ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং উইম্বলডনের সেমিফাইনালে পৌঁছান নোভাক। সেই সময় টেনিসের জগতে তিন তারকা ছিলেন রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল এবং অ্যান্ডি রডিক। এই তিন খেলোয়াড়কেই পরাজিত করে মন্ট্রিয়লের দ্বিতীয় মাস্টার্স জেতেন নোভাক জকোভিচ। সেই বছর সার্বিয়ার অলিম্পিক কমিটি তাঁকে শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিটের মর্যাদা দেয় এবং ‘গোল্ডেন ব্যাজ’ প্রদান করে। ২০০৮ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে সিঙ্গেলসে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন নোভাক এবং সেই বছরই টেনিস মাস্টার্স কাপও জেতেন তিনি। ২০১০ সালে ডেভিস কাপজয়ী সার্বিয়ার টেনিস দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন নোভাক জকোভিচ। ২০১১ সালে চারটির মধ্যে তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে নজির গড়েন নোভাক। ঐ বছরই ৪ জুলাই টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বের ১ নং স্থানে উন্নীত হন তিনি।
২০১২ ও ২০১৩ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে রাফায়েল নাদাল এবং অ্যান্ডি মুরেকে পরাজিত করেন নোভাক। ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ এই চার বছর পরপর এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ফাইনাল জয়ের খেতাব পেয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে পুনরায় রজার ফেডেরারকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার উইম্বলডন সিঙ্গেলস জয় করেন নোভাক জকোভিচ। ঠিক তার পরের বছর ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বার ইউএস ওপেন জিতে ঐ বছরেই তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের শিরোপা লাভ করেন তিনি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কেয়ং ক্লাসিক প্রদর্শনীমূলক টুর্নামেন্টে ডোমিনিক থেইমের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করে তাকে পরাজিত করেন নোভাক। ২০১৯ সালে জাপান ওপেনে জন মিলম্যানকে এবং ঐ বছরই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে নাদালকে পরাজিত করেন তিনি। ঐ বছরই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে তিনি রাফায়েল নাদালকে স্ট্রেট সেটে পরাজিত করেন এবং উইম্বলডন ওপেনে রজার ফেডেরারের বিপক্ষে নিজের অবস্থানে অক্ষত থাকেন জকোভিচ। তারপর ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে আবার রজার ফেডেরারকে সেমি ফাইনালে স্ট্রেট সেটে পরাজিত করেন নোভাক জকোভিচ এবং ঐ বছরই ডোমিনিক থেইমকে ফাইনালে পাঁচটি সেটে পরাজিত করে অষ্টম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের শিরোপা অর্জন করেন তিনি। মূলত একজন আগ্রাসী বেসলাইন খেলোয়াড় হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। দুই ধারের উইং থেকেই তাঁর গ্রাউন্ডস্ট্রোক ছিল দর্শকদের কাছে সবথেকে আকর্ষণীয়। তাছাড়া সার্ভিং-এর ক্ষেত্রেও নোভাকের সমকক্ষ কেউ ছিলেন না।
ক্রীড়াজগতের পাশাপাশি টেলিকম সারবিজা (Telecom Srbija), ফিটলাইন (FitLine), মার্সিডিজ বেঞ্জ (Mercedes Benz), সেইকো (Seiko) ইত্যাদি বিভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছেন নোভাক জকোভিচ। এছাড়াও বহু টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন তিনি। দ্য টুনাইট শো উইথ জে লেনো, এল হর্মিংগুয়েরো, লাইভ উইথ রেজিস অ্যান্ড কেলি ইত্যাদি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নোভাক জকোভিচ অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে সার্বিয়ার বঞ্চিত ও অবহেলিত শিশুদের প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ এবং জীবনের মানোন্নয়নের জন্য নানা উপাদান সরবরাহ করতে নোভাক জকোভিচ গড়ে তোলেন ‘নোভাক জকোভিচ ফাউন্ডেশন’ এবং ২০১৬ সালে মেলবোর্ন সিটি মিশনের শিশু শিক্ষা প্রকল্পের জন্য ২০ হাজার ডলার দান করেছিলেন তিনি।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের শাখাগুলির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছিলেন নোভাক জকোভিচ।
One comment