নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া

নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ।। নিউক্লিয়ার ফিউশন রিয়্যাকশন

পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ইত্যাদি তৈরির জন্য নিউক্লীয় বিক্রিয়া একান্ত প্রয়োজন। পরমাণু বোমা তৈরি করা যায় নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ার সাহায্যে আর হাইড্রোজেন বোমা তৈরি হয় নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার সাহায্যে। বলা হয় পরমাণু বোমার থেকেও কয়েক হাজার গুণ বিধ্বংসী এই হাইড্রোজেন বোমা। অন্যদিকে মহাবিশ্বে সূর্যের মত সব নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যে তাপ ও আলো সৃষ্টি হয়, তার কারণও কিন্তু এই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া (Nueclear Fusion Reaction)। সূর্যের মত হাজার হাজার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে শক্তির যোগান দেয় এই বিক্রিয়া। নাক্ষত্রিক নিউক্লীয় সংশ্লেষণ (Stellar Neucleo-Synthesis) নিরন্তর না ঘটলে একটা সময় পর নক্ষত্রের শক্তি শূন্য হয়ে যাবে এবং তখন সেই নক্ষত্রটি ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তার থেকে আলো নির্গত হবে না। নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়ার একেবারে বিপরীত প্রক্রিয়া এই নিউক্লীয় সংযোজন ঠিক কীভাবে সংঘটিত হয় চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।

এক কথায় বলতে গেলে, যে নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় একাধিক হালকা মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াস পরস্পর সংযোজিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস গঠিত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তাকেই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া বলা হয়। সাধারণত Fe56 এবং Ni62 এই দুই মৌলের থেকে কম ভরের মৌলের নিউক্লিয়াসই এই বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। সাধারণভাবে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মত হালকা নিউক্লিয়াস এই বিক্রিয়ায় সংযোজিত হয়। নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া হল নিউক্লীয় বিভাজনের একেবারে বিপরীত প্রক্রিয়া। নিউক্লীয় বিভাজনের থেকে এই বিক্রিয়ার ফলে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়।

১৯২০ সালে আর্থার এডিংটনই প্রথম অনুমান করেন যে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে এত বিপুল শক্তির উৎস আসলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া। ১৯২৯ সালে ফ্রেডরিক হান্ড আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম টানেলিং পদ্ধতিতে এই মতের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। পরে ১৯৩২ সালে গবেষণাগারে মার্ক অলিফ্যান্ট প্রথম হাইড্রোজেনের আইসোটোপগুলির মধ্যে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটান। ঐ দশকের পরবর্তী সময় ধরে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার সংঘটন নিয়ে বিজ্ঞানী হান্স বেথ অনেক গবেষণা করেছেন। ১৯৫২ সালে আইভি মাইক এই বিক্রিয়ার সহায়তায় প্রথম হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণ করে পরীক্ষা করেন। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ১৯৪০ সাল থেকেই বিশেষ বিক্রিয়ক যন্ত্রের মধ্যে এই নিউক্লীয় সংযোজন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে তাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চলে আসছে।  

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

 দুটি হালকা মৌলের নিউক্লিয়াস পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় কারণ এক্ষেত্রে আসলে দুটি বিপরীতমুখী বলের মধ্যে সংঘাত বাধে। প্রথম হল নিউক্লীয় বল যা প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে বেঁধে রাখে নিউক্লিয়াসের ভিতরে। দ্বিতীয় হল কুলম্ব বল যার কারণে প্রতিটি প্রোটন একে অপরের থেকে বিকর্ষিত হয়। কিন্তু এই বিকর্ষণ সত্ত্বেও স্বল্প পরিসরে প্রোটনগুলি পরস্পরের সঙ্গে এক পারমাণবিক আকর্ষণে আটকে থাকে। হালকা মৌলের নিউক্লিয়াসগুলির আকার অনেক ছোট হওয়ায় এতে প্রোটন সংখ্যাও কম থাকে এবং সেই কারণে বিকর্ষণকে সহজেই কাবু করে ফেলে নিউক্লীয় বল। কারণ নিউক্লীয় বল মূলত স্বল্প পরিসরেই কাজ করে। নক্ষত্রের অভ্যন্তরেও একইভাবে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার ফলে প্রভূত শক্তি উৎপন্ন হয় এবং তার ফলেই সমস্ত ধরনের মৌলের সৃষ্টি হয়। এই পদ্ধতির নাম নিউক্লীয়-সংশ্লেষণ (Neucleo-Synthesis)। সূর্য একটি প্রধান ক্রম নক্ষত্র এবং এর অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস হিলিয়ামে পরিণত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন সূর্যের অভ্যন্তরে প্রায় ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬১ কোটি মেট্রিক টন হিলিয়াম উৎপন্ন হয় এবং এই সময় প্রায় ০.৬৪৫ শতাংশ ভর আলফা কণা অথবা অন্য কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে নির্গত হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ৪টি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস নিউক্লীয় সংযোজনের ফলে সংযোজিত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং এই ঘটনাটি ঘটে নিম্নলিখিত সমীকরণ অনুযায়ী –

41H1      2He4 + 2+1e0 (পজিট্রন) + 25.69 MeV

এক্ষেত্রে বিক্রিয়ার ফলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস ও ২টি পজিট্রনের মোট ভর চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মোট ভর অপেক্ষা সামান্য কম হয়। এই হ্রাসপ্রাপ্ত ভর আইনস্টাইনের E = Mc2  সূত্রানুসারে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে মাত্র ১ গ্রাম হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সংযোজনে প্রায় ৬.৩ × ১০১১ জুল শক্তি নির্গত হয়। কিন্তু উল্লেখ্য বিষয় হল এই সংযোজন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য কমপক্ষে ১০ কিংবা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার প্রয়োজন। কৃত্রিমভাবে এই উষ্ণতা তৈরি করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রথমে নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়া ঘটিয়ে তাপমাত্রা তৈরি করা হয় এবং তারপরেই নিউক্লীয় সংযোজন ঘটে। নক্ষত্রের ক্ষেত্রে পূর্ব থেকেই প্রচণ্ড উষ্ণতা থাকার কারণে এই বিক্রিয়া শুরু হতে কোনও সমস্যা হয় না।

বর্তমানে কৃত্রিমভাবে এই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য আইটিইআর (ITER –  International Thermonuclear Experimental Reactor) প্রযুক্তি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে যেখানে টরয়ডাল চুল্লির (Toroidal Reactor) ভিতরে মৌলের প্লাজমাকে উত্তপ্ত করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় তাপের ১০ গুণ তাপ উৎপন্ন করা সম্ভব তাত্ত্বিকভাবে। মনে করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যেই এই প্রযুক্তি সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। এর ফলে প্লাজমা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিমভাবে ডয়টরিয়াম ও ট্রিটিয়াম আইসোটোপের সংযোজন ঘটানোও সম্ভব হবে এই প্রযুক্তিতে। তবে এই পদ্ধতি ছাড়াও আরও বেশ কিছু কৃত্রিম পদ্ধতিতে গবেষণাগারে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটানো হয়ে থাকে বর্তমানে।

১. তাপ-নিউক্লীয় সংযোজন (Thermo-neuclear Fusion) : কোনও পদার্থকে যথার্থভাবে উত্তপ্ত করে যদি বদ্ধ রাখা যায়, তবে পদার্থ-মধ্যস্থ কণাগুলির তাপীয় গতিশক্তির কারণে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে করতে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। তাপ-নিউক্লীয় অস্ত্রগুলিতে এভাবেই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত শক্তি উৎপাদন করা হয়। আবার অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত তাপ-নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের সহায়তা নিয়ে প্লাজমাকে বদ্ধ করা হয়।

২. জড়-বন্দি সংযোজন (Inertial Confinement Fusion) : এক্ষেত্রে ডয়টরিয়াম এবং ট্রিটিয়ামে পূর্ণ একটি পাত্রকে উত্তপ্ত করা হয় এবং একইসঙ্গে তার উপর চাপও বাড়ানো হয়। এর ফলেই নিউক্লীয় সংযোজনের ফলে প্রভূত শক্তি নির্গত হয়।

৩. জড়-বন্দি স্থিরতড়িৎ সংযোজন (Inertial Electrostatic Confinement) : এক্ষেত্রে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির দ্বারা কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে পদার্থের আয়নগুলিকে উত্তপ্ত করে সংযোজনের পরিবেশ তৈরি করা হয়। এর সবথেকে ভাল উদাহরণ হল ‘ফিউসার’ (Fusor) যা ১৯৯৯ সালে বাজারে আসে। এর সাহায্যে বাড়ির পরিবেশেই বহু অপেশাদার মানুষ নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই জানা যায়। এছাড়াও এই ধরনের অন্যান্য যন্ত্রপাতিগুলির মধ্যে রয়েছে পলিওয়েল (Polywell), এমআইএক্স পপস (MIX POPS) ইত্যাদি।

৪. বিম-বিম বা বিম-লক্ষ্য সংযোজন (Beam-Beam or Beam-Target Fusion) : এক্ষেত্রে কণার আয়নের গতিবৃদ্ধি করার জন্য হালকা-আয়নগুলিকে বিশেষ ত্বরিতকারী যন্ত্রের (accelerator) দ্বারা দ্রুতগামী করা হয়। হালকা আয়নগুলিকে দ্রুতগামী করা তুলনায় সহজ, এক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি শূন্য টিউব, এক জোড়া তড়িৎদ্বার এবং একটি উচ্চ-ভোল্টেজ সম্পন্ন ট্রান্সফর্মার প্রয়োজন পড়ে। ঐ দুই তড়িৎদ্বারে ১০ কিলোভোল্ট তড়িৎ প্রবাহিত করা হয়। এর ফলে হয় উচ্চ গতিসম্পন্ন আয়নকে কোনও লক্ষ্যের দিকে পাঠিয়ে সংযোজন ঘটানো হয়, অথবা দুটি পৃথক আয়নকে মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য ছাড়া হয়। এই ধরনের যন্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সিলড-টিউব নিউট্রন জেনারেটর (Sealed-tube Neutron Generator)। খনিজ তৈল শিল্পের ক্ষেত্রে এধরনের বহুবিধ নিউট্রন উৎপাদক যন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে তেলের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য। এখানে আবার যে সকল নিউট্রনগুলি সংঘর্ষ না করেই ফিরে আসে তাদের সংরক্ষণ করে আবার সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য ১৯৭০ সালে তৈরি করা হয় ‘মিগমা’ (Migma) নামের একটি যন্ত্র। পরে ১৯৯০-এর দশকে নর্ম্যান রোসটোকার ‘এফআরসি’ (FRC) নামে আরেকটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন যেখানে ফিরে আসা নিউট্রন বা আয়নগুলিকে পুনরায় একটি বৃত্তাকার পথে সংঘর্ষের জন্য পাঠানো সম্ভব।

৫. মিউয়ন অণুঘটকীয় সংযোজন (Muon-Catalyzed Fusion) : এই প্রক্রিয়াটি সাধারণ তাপমাত্রাতেই ঘটে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন স্টিভেন জোন্স। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সফলভাবে নিউক্লীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারেনি।

এমনই আরও বহুবিধ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিমভাবে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটিয়ে তা মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলে আসছে। পাইরো-ইলেকট্রিক সংযোজন, বুদ্‌বুদ সংযোজন কিংবা সংকর নিউক্লীয় সংযোজন-বিভাজন প্রক্রিয়া এমনই সব নিদর্শন।

আপনার মতামত জানান