মাঙ্কিপক্স (monkeypox ) হল এমন একটি মারণ ভাইরাস যা সাধারণত প্রাণীদের দেহ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়৷ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাস দেখা গিয়েছিল। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে মুখে কিমবা যৌনাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি হয়, গুটি বসন্তের মতো ফুসকুড়ির আবির্ভাব ঘটে, সঙ্গে জ্বর, মাথা ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয় শরীরে। খুব গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে মৃত্যুও হতে পারে এই ভাইরাসের ফলে। শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসের আক্রমণের পরিমাণ লক্ষ্যণীয়ভাবেই বেশি। সেই অর্থে মাঙ্কিপক্সের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঔষধের উদ্ভাবন হয়নি ঠিকই, কিন্তু গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টীকা মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে সন্তোষজনক ফল পেয়েছেন চিকিৎসকরা। কোভিড -১৯ এর পর বিশ্ব জুড়ে এই মাঙ্কিপক্স এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে ।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস মূলত পক্সভিরিডে (Poxviridae) পরিবারের অন্তর্গত অর্থোপক্সভাইরাস (Orthopoxvirus) গোত্রের একটি সংক্রামক ভাইরাস। এটি একটি এনভেলাপড ডবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস। একে জুনোটিক ভাইরাসও বলে যেহেতু প্রাণীদেহ থেকে এটি মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এটির নাম মাঙ্কিপক্স হওয়ার কারণ প্রথম বানরদের মধ্যে এই ভাইরাসের বীজ নিহিত থাকতে দেখা গিয়েছিল। যদিও বানর নয়, ইঁদুর এই ভাইরাসের একটি প্রধান বাহক। এছাড়াও আফ্রিকাতে গাছের কাঠবিড়ালি, ডর্মিস, বিভিন্ন প্রজাতির বানরের মধ্যে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। অতএব বাহক হিসেবে এইসব প্রাণীদের নামও করতে হয়।
১৯৫৮ সালে প্রথম মাঙ্কিপক্স আবিষ্কার হয়েছিল। যখন বানরদের মধ্যে পক্সের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল, তখন গবেষণা চালানো হয় তা নিয়ে। সেই রোগের সঠিক উৎস অজানা থাকলেও নামকরণ করা হয়েছিল মাঙ্কিপক্স। ১৯৬৮ সালে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে গুটিবসন্ত নির্মূল করা হয়েছিল৷ ১৯৭০ সালে সেখানে প্রথম একটি নয় বছরের বালকের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে রেইনফরেস্ট অঞ্চলগুলি থেকে একেরপর এক এই ভাইরাসে সংক্রমণের রিপোর্ট আসতে থাকে। ক্রমশ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে মাঙ্কিপক্সের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঘটে। মধ্য আফ্রিকান (কঙ্গো বেসিন) ক্লেড এবং পশ্চিম আফ্রিকান ক্লেড, সাধারণত এই দুটি স্ট্রেনই পাওয়া গিয়েছিল মাঙ্কিপক্সের। এরমধ্যে কঙ্গো বেসিন ক্লেড ছিল ভীষণই মারাত্মক এবং ভয়াবহ। ১৯৭০ সাল থেকে ১১টি আফ্রিকান দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণের রিপোর্ট পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে নাইজেরিয়ায় প্রায় ৫০০টি কেসে মাঙ্কিপক্স সন্দেহ করা হয়েছিল, তারমধ্যে ২০০টির ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের উপস্থিতি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল এবং মৃত্যুর অনুপাত ছিল ৩ শতাংশ। আফ্রিকার বাইরে ২০০৩ সালে প্রথম মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পোষা কুকুরদের থেকে এই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল মনে করা হয়। সেই কুকুরগুলি গাম্বিয়ান পাউচড ইঁদুর এবং ডর্মিসের সংস্পর্শে ছিল, যেগুলি কিনা ঘানা থেকে আমদানি করা হয়েছিল। এই প্রাদুর্ভাবের ফলে প্রায় ৭০টি কেস দেখা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২২ সালের ৬ মে তারিখে যুক্তরাজ্যে মাঙ্কিপক্সের হদিশ পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার সঙ্গে যাতায়াতসূত্রে জড়িত এক ব্যক্তির মধ্যে। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বাইরে এবারে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। ১৮ মে থেকে ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া প্রভৃতি মহাদেশে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ২রা আগস্ট পর্যন্ত ৮০টি দেশে মোট ২৫,৪৩৬টি কেস নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১লা আগস্টে ভারতে মাঙ্কিপক্সে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
মাঙ্কিপক্সের উন্মেষপর্ব অর্থাৎ সংক্রমণ থেকে উপসর্গের সূত্রপাত পর্যন্ত ব্যবধান সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিন হয়, তবে ৫ থেকে ২১ দিনও হতে পারে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রাথমিক যে লক্ষণ বা উপসর্গগুলি দেখা দেয় সেগুলি হল, জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া, পিঠে এবং পেশিতে ব্যথা, এবং তীব্র অ্যাথেনিয়া বা শক্তির অভাব বোধ করা। সাধারণত জ্বর হওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ত্বকের বিদারণ শুরু হয়। ফুসকুড়ি মুখ এবং হাতে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও হাতের তালু, পায়ের তলা, যৌনাঙ্গ, কর্নিয়া ইত্যাদিও আক্রান্ত হয়। কর্নিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে দৃষ্টশক্তি নষ্ট করে দিতেও পারে এই ভাইরাস। ক্ষতগুলি সামান্য থেকে ক্রমে হলদু তরলে ভরা ক্ষত বা পুস্টুলসে পরিণত হয় এবং অবশেষে শুকিয়ে পড়ে যায়। মূলত মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলি ২ থেকে ৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। শিশুদের মধ্যেই সাধারণত বেশি পরিমাণে এই ভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। দেহজ ইমিউনিটির ঘাটতির জন্যও এই ভাইরাস কখনও কখনও দায়ী।
সাধারণত প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সংক্রমিত হলেও এক মানুষ থেকে অন্য মানুষেও দ্রুত এটি সঞ্চারিত হয়ে যেতে পারে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষত বা মাংসের সংস্পর্শে এলে বা তাদের কামড় বা আঁচড় থেকেও মানুষের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠতা থেকেও মানবদেহে ভাইরাসটি অবাধে প্রবেশ করতে পারে। শ্বাসপ্রশ্বাসের নিঃসরণ, সংক্রামিত ব্যক্তির ত্বকের ক্ষত কিমবা দীর্ঘক্ষণ মুখোমুখি থাকা এমনকি সেই ব্যক্তির ব্যবহৃত জামাকাপড়ের সংস্পর্শে এলেও মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ২০২২ সালের এপ্রিলের শেষ থেকে জুনের শেষের মধ্যে সমকামী বা উভকামী পুরুষেরা প্রচুর পরিমাণে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। গবেষকরা তার ফলে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ৯৫ শতাংশ সংক্রমণ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলে হয়ে থাকে৷
এই মারণ ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন বা ঔষধের ব্যবস্থা না থাকলেও ইমভেনেক্স এবং এসিএএম২০০০ (ACAM2000)-এর মতো ভ্যাক্সিনিয়া ধারণকারী স্মলপক্সের ভ্যাকসিনগুলি যে এই মাঙ্কিপক্স নিরাময়ের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ কার্যকরী, তার প্রমাণ হাতেনাতেই পেয়েছেন চিকিৎসকেরা। এই যে পরিসংখ্যান তা পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮০ সালের শেষদিকে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন ব্যবহার করে গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু খুবই গুরুতর অবস্থার এবং ইমিউনোকম্প্রোমাইজড ব্যক্তির জন্য জিনিওস (JYNNEOS) ভ্যাকসিন সুপারিশ করা হয়। বাভারিয়ান নর্ডিক হল বিশ্বে জিনিওস-এর একমাত্র প্রস্তুতকারক। আবার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভ্যাকসিন হল জাপানের এলসি১৬ (LC16) ভ্যাকসিন।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে নানারকম সচেতনতার বার্তাও মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ওয়েন জোনস মতামত দিয়েছিলেন ভাইরাসটি শনাক্তকরণের জন্য অর্থাৎ চিকেনপক্স এবং হামের থেকে আলাদা করে এটিকে চেনার জন্য যথোপযুক্ত পরীক্ষা, সচেতনতা এবং টীকাকরণের উপর মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। এছাড়াও মাঙ্কিপক্সকে এড়ানোর জন্য যেমন প্রয়োজন নিরাপদ যৌনতা, তেমনি নিয়মিত বাড়ি জীবাণুমুক্তকরণ এবং সংক্রমিত ব্যক্তি এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা খুবই প্রয়োজন।