পিট সাম্প্রাস

পিট সাম্প্রাস

বিশ্বের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড় পিট সাম্প্রাস (Pete Sampras)। ১৯৮৮ সালে আমেরিকান এই টেনিস খেলোয়াড়ের ক্রীড়া জীবন শুরু হয় এবং সর্বশেষ ২০০২ সালে ইউএস ওপেনে আন্দ্রে আগাসিকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে তাঁর ক্রীড়া জীবন সমাপ্ত হয়। সমগ্র ক্রীড়া জীবনে মোট ১৪টি সিঙ্গলস জেতার শিরোপা পেয়েছেন পিট যার মধ্যে ৭ বার উইম্বলডন সিঙ্গেলস, ২ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং পাঁচটি ইউএস ওপেন জয়ের রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৯৩ সালে লন টেনিসে তিনি প্রথম বিশ্বে ১ নং স্থান অর্জন করেন এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই স্থান বজায় রেখেছিলেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত এবং শক্তিশালী সার্ভের জন্য ‘পিস্তল পিট’ নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। আরেক বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় আন্দ্রে আগাসি তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০০৭ সালে পিট সাম্প্রাস ‘আন্তর্জাতিক টেনিস হল অফ ফেম’ সম্মানে ভূষিত হন।

১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট ওয়াশিংটন ডি.সিতে পিট সাম্প্রাসের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল পেট্রোস সাম্প্রাস। তাঁর বাবার নাম সোটেরিয়াস সাম্প্রাস এবং মায়ের নাম জর্জিয়া সাম্প্রাস। তাঁদের তৃতীয় সন্তান ছিলেন পিট। পিটের বাবা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর মায়ের জন্ম হয় গ্রিসে। ছোটোবেলা থেকেই প্রতি রবিবারে গ্রিক ক্যাথলিক গির্জায় যেতেন পিট এবং ধর্মসাধনা করতেন। ৩ বছর বয়সে তাঁর বাড়ির গুদামঘরে একটি টেনিস র‍্যাকেট পেয়ে সেটা দিয়ে বারবার দেয়ালে বল ছুঁড়ে আঘাত করতে শুরু করেন পিট সাম্প্রাস। ১৯৭৮ সালে তাঁরা চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ার পালোস ভার্ডেসে এবং এই জায়গার তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ায় সারা বছর জুড়ে মনের আনন্দে টেনিস খেলতে থাকেন পিট। টেনিসের জগতে তাঁর আদর্শ ছিল রড ল্যাভার। ১১ বছর বয়সে রড ল্যাভারের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সঙ্গে টেনিস খেলেন তিনি। পরবর্তীকালে ২০০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আমেরিকান অভিনেত্রী ব্রিগেট উইলসনকে বিবাহ করেন পিট সাম্প্রাস। তাঁদের দুই পুত্র যথাক্রমে ক্রিস্টিয়ান চার্লস এবং র‍্যান নিকোলাস।

কিশোর বয়সেই প্রশিক্ষক রবার্ট ল্যান্সডর্ফের কাছে টেনিস শেখেন পিট সাম্প্রাস। যে হাতে তাঁর কাছে খেলতে শিখেছিলেন পিট, সেভাবেই আজীবন খেলে গিয়েছেন তিনি। খেলার রূপ ও রীতিতে পরিবর্তন করেননি তিনি। পরবর্তীকালে একজন শিশু-চিকিৎসক এবং টেনিস-উৎসাহী ড. পিটার ফিশার তাঁকে লক্ষ্য করেন এবং টেনিসে তাঁর দক্ষতা দেখে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তাঁকে প্রশিক্ষণ দেন। পিটার ফিশারই তাঁকে দুই হাতে ব্যাকহ্যাণ্ড খেলার রীতি পালটে এক হাতে খেলার রীতিতে অভ্যস্ত করে তোলেন আর এই নতুন রীতিই তাঁকে উইম্বলডনে ম্যাচ জিততে সহায়তা করে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৮৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সাম্প্রাস একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। বিশ্বের মধ্যে ৮৯৩ নং স্থানে খেলা শুরু করলেও ঐ বছরই ৯৭ নম্বর স্থানে উন্নীত হন পিট সাম্প্রাস। ফিলাডেলফিয়ায় এবেল. ইউএস ওপেনে তাঁর প্রথম ম্যাচে স্যামি জিয়ামালভার কাছে পরাজিত হন পিট সাম্প্রাস। এর ঠিক এক বছর পরেই মিয়ামিতে লিপটন আন্তর্জাতিক প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপে সাম্প্রাস দুজন খেলোয়াড়কে পরাজিত করেন কিন্তু অবশেষে এমিলিও স্যাঞ্জেসের কাছে পরাজিত হন । এরপর দীর্ঘ ছয় মাস তিনি কাউকে পরাজিত করতে না পারলেও তারপরে নিউ ইয়র্কের রি-ব্রুকের ইউএস ওপেন ওয়ার্ম আপ টুর্নামেন্টে মাইকেল স্ক্যাপারসকে পরাজিত করেন পিট। তাঁর প্রথম গ্র্যাণ্ড স্ল্যাম সিঙ্গেলস ম্যাচে সাম্প্রাস ইউএস ওপেনের প্রথম রাউণ্ডেই পেরুর জেইম ইয়াজগার কাছে পরাজিত হন। এর পরের তিনটি টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনালে এগিয়ে জিততে না পারলেও জিম ক্যুরিয়ার এবং টিম মেয়োটিকে পরাজিত করেন তিনি। এর পরের বছর বিশ্বের মধ্যে ৮১ নং স্থানে পৌঁছান তিনি। ১৯৮৯ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের প্রথম রাউণ্ডে ক্রিস্টিয়ান সিজেনুর কাছে পরাজিত হলেও ঐ বছরই ফ্রেঞ্চ ওপেনে প্রথমবারের জন্য গ্র্যাণ্ড স্ল্যাম জয় করেন পিট সাম্প্রাস। এর কয়েক সপ্তাহ পরে উইম্বলডনের ম্যাচে টড উডব্রিজের কাছে পরাজিত হন তিনি। ইউএস ওপেনে সাম্প্রাস দ্বিতীয় রাউণ্ডে ম্যাটস উইল্যাণ্ডারকে পরাজিত করলেও চতুর্থ রাউণ্ডে জে বার্জারের কাছে তিনি পরাজিত হন। এই বছর পরপর টুর্নামেন্টগুলির প্রথম রাউণ্ডেই পরাজিত হয়েছিলেন পিট সাম্প্রাস। ১৯৯০ সালে সিডনির টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনালে উইল্যাণ্ডারের কাছে পরাজিত হন পিট। ঐ বছরই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম রাউণ্ডে টিম মায়োটকে পরাজিত করেন তিনি এবং চতুর্থ রাউণ্ডে ইয়ানিক নোয়ার কাছে পুনরায় পর্যুদস্ত হন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফিলাডেলফিয়ার এবেল ইউএস ওপেনের ফাইনালে আন্দ্রে আগাসি, মায়োট এবং অ্যানড্রুজ গোমেজকে পরাজিত করে প্রথম পেশাদারি সিঙ্গেলস জয়ের শিরোপা পান পিট সাম্প্রাস। এর ফলেই বিশ্বে ২০ নং স্থানে উন্নীত হন তিনি। সেই বছর ফ্রেঞ্চ ওপেনে খেলেননি তিনি, কিন্তু উত্তর আমেরিকার গ্রীষ্মকালীন হার্ড-কোর্ট মরসুমে দীর্ঘ সাত সপ্তাহ জুড়ে খেলেছেন তিনি। লস অ্যাঞ্জেলস টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনালে স্টেফান এডবার্গ, চ্যাং, রিচি রেনবার্গ এবং গোরান ইভানিশেভিচের কাছে পরাজিত হয়েছেন পিট সাম্প্রাস। সেই বছরই পিট সাম্প্রাস আন্দ্রে আগাসিকে পরাজিত করেন এবং এর ফলে ইউএস ওপেনের সর্বকনিষ্ঠ পুরুষ সিঙ্গেলস-জয়ীর খেতাব অর্জন করেন সাম্প্রাস। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তিনি এই খেতাব জয় করেন। ১৯৯১ সালের টেনিস মাস্টার্স কাপে পাঁচটি খেতাব জেতেন তিনি। ১৯৯২ সালে সাম্প্রাস দীর্ঘ তিন বছরের মধ্যে ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছান, উইম্বলডনের সেমি-ফাইনালেও পৌঁছান তিনি। কিন্তু সেই বছরই ইউএস ওপেনে স্টেফান এডবার্গের কাছে পরাজিত হন সাম্প্রাস। ডেভিস-কাপজয়ী জন ম্যাকেনরোর সঙ্গে ডাবলসেও খেলেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালের অলিম্পিকে যোগদান করলেও অ্যান্দ্রেই চেরকাসভের কাছে তৃতীয় রাউণ্ডে হেরে যান তিনি। ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমি-ফাইনালে পৌঁছালেও স্টেফান এডবার্গের কাছে পরাজিত হন তিনি। ১৯৯৩ সালেই বিশ্বের মধ্যে ১ নং টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি পান পিট সাম্প্রাস। এর সাত মাস পরেই উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপে জিম কুরিয়ারকে পরাজিত করেন তিনি। এরপর ইউএস ওপেনে দ্বিতীয়বার জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন টাইটলসের প্রথম দুটি ম্যাচে জয়লাভ করেন সাম্প্রাস এবং সেই ম্যাচে মার্কিন খেলোয়াড় টড মার্টিনকে পরাজিত করেন তিনি। সেই বছর উইম্বলডন ম্যাচে ইভানিশেভিচকে পরাজিত করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বিশ্বের ১ নং স্থানে থাকার লড়াইয়ে আন্দ্রে আগাসির সঙ্গে দুটি ম্যাচে খেলেছিলেন সাম্প্রাস। সেই বছর গ্র্যাণ্ড স্ল্যাম জয়ের পাশাপাশি ডেভিস কাপও জয় করেছিলেন পিট। ইণ্ডিয়ান ওয়েলসে আগাসিকে পরাজিত করেন তিনি, এর ফলে বরিস বেকারের রেকর্ডও তিনি ভেঙে ফেলেন। কানাডিয়ান মাস্টার্সে আগাসির কাছে পরাজিত হন পিট সাম্প্রাস এবং ইউএস ওপেনের ফাইনালে তিনি আগাসিকে পুনরায় পরাজিত করেন। ১৯৯৬ সালের ইউএস ওপেনে মাইকেল চ্যাঙ্গকে পরাজিত করে তিনি চতুর্থবার ইউএস ওপেন জয়ের খেতাব অর্জন করেন। এর পরের বছর দ্বিতীয়বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং চতুর্থবার উইম্বলডন ওপেন জয় করেন সাম্প্রাস। ফিলাডেলফিয়া, সিন সিনাত্তি, মিউনিখ এবং প্যারিসের সিঙ্গেলসে জয়লাভ করেন পিট সাম্প্রাস। ১৯৯৭ সালে তিনিই ছিলেন একমাত্র গ্র্যাণ্ড স্ল্যাম পুরস্কারজয়ী টেনিস খেলোয়াড়। এর কয়েক বছর পরে ২০০২ সালে ইউএস ওপেনের ফাইনালে আন্দ্রে আগাসিকে পুনরায় পরাজিত করেন পিট সাম্প্রাস।

১৯৯৭ সালে তাঁকেই প্রথম ‘স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেন ইউএস অলিম্পিক কমিটি। ২০০০ সালে জিকিউ পত্রিকা একক অ্যাথলিট শ্রেণিতে তাঁকে ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ সম্মানে ভূষিত করে। পুরস্কারমূল্য হিসেবে তাঁর অর্জিত মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলার।

সবরকম কোর্টেই তিনি খেলতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন, সার্ভ আর ভলির জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বেসলাইন থেকে তাঁর আক্রমণাত্মক অবস্থানে খেলার রীতি বিশেষ প্রশংসিত হতো। পরের দিকের খেলায় মূলত ‘চিপ অ্যাণ্ড চার্জ’ পদ্ধতিতেই খেলতে পছন্দ করতেন তিনি। প্রত্যেক খেলাতেই তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় সার্ভ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করেন ক্রীড়াবিদ এবং ধারাভাষ্যকারেরা।

বর্তমানে খেলা থেকে অবসর নিলেও বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীমূলক ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন পিট সাম্প্রাস।                      

আপনার মতামত জানান