ভারতের বুকে নানা সময় গোপন সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা করেছে বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠন, সরকারকে উৎখাত করতে নানাবিধ জঙ্গি কার্যকলাপ দেখা গেছে। কোথাও অস্ত্র পাচার, কোথাও বোমার কারখানা আবিষ্কার, কোথাও আবার আস্ত জঙ্গি ঘাঁটি উদ্ধার করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। বিশের দশকের আগে আগেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে এমনই এক অত্যাশ্চর্য এবং রহস্যময় অস্ত্র বর্ষণের ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতাসীন এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে চলছে বাম শাসন। সত্তর দশকে অতি বাম-মনোভাবাপন্ন সক্রিয় নকশাল আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে পশ্চিমবঙ্গ তথা আপামর ভারতের মানুষ। তারপরে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হতেই নব্বইয়ের দশকের শেষে পুরুলিয়ার মাটিতে বিমান থেকে অস্ত্রবর্ষণের ঘটনায় বিস্মিত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গবাসী। সেই সঙ্গেই শুরু হয়েছিল তদন্ত। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত নাকি অন্য কোন গুপ্ত পরিকল্পনা জড়িত আছে এই ঘটনায় তার কিনারা করতে আদালতে দায়ের হয় পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা (Purulia arms drop case)।
১৯৯৫ সালে কলকাতা উচ্চ আদালতে শুরু হয় পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা । মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কিম ডেভি যার আসল নাম নিলস হক ওরফে নিলস ক্রিস্টিয়ান নিলসেন। এছাড়াও তাঁর সঙ্গে বন্দি বিমান-আরোহী ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ এবং লাটাভিয়ার সাত জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক পদার্থ আইন এবং বিমান আইনের ধারা রুজু করা হয়।
১৯৯৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে পুরুলিয়ার ঝালদা, খাটাঙ্গা, বেলামু, মারামু ইত্যাদি সাতটি গ্রামে এক বিশাল এলাকা জুড়ে ‘আন্টোনভ এ এন ২৬’ নামে একটি লাটাভীয় বিমান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বর্ষিত হয়। এই অস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে ছিল ১০টি আরপিজি-৭ রকেট লঞ্চার, ৩০০টি এ কে ৪৭ রাইফেল, ২৫টা ৯ এম এম পিস্তল, দুটি ৭.৬২ স্নাইপার রাইফেল, দুটি নাইট ভিশন বাইনোকুলার, ১০০টি গ্রেনেড এবং প্রায় ৩৪ হাজার রাউণ্ড গুলি। এছাড়াও সেই অস্ত্র-শস্ত্রের সঙ্গে ছিল অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গ্রেনেড এবং রকেট লঞ্চারের জন্য টেলিস্কোপিক সাইট। প্রায় ৪৩৭৫ কেজি ওজনের এই অস্ত্র সম্ভারই সাড়া ফেলে দেয় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত জুড়ে। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে ভারতের আকাশে পুনরায় ঐ লাটাভীয় বিমানটিকে দেখা গেলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ-২১ যুদ্ধবিমান সেটিকে আটক করে এবং বম্বেতে নেমে আসতে বাধ্য করে। পরে জানা যায় এই লাটাভীয় বিমান করাচি থেকে অস্ত্রসম্ভার নিয়ে উড়ে আসে এবং বেনারসে জ্বালানি ভরে পুনরায় গয়ার উদ্দেশ্যে দিক পরিবর্তন করে। আবার পুরুলিয়ায় অস্ত্র ফেলে দেওয়ার পরে দমদমে এসে জ্বালানি ভরে পুনরায় সেটি থাইল্যাণ্ডের ফুকেতের দিকে চলে যায়, কিন্তু এত বড় কর্মপরিকল্পনার মাঝে কোন ভারতীয় বিমানবাহিনীর চোখে সেই বিমান ধরা পড়েনি। বম্বেতে সেই বিমানকে নামতে বাধ্য করা হলে ব্রিটিশ বিমান-আরোহী পিটার ব্লিচ এবং সাত জন লাটাভীয় বিমানকর্মী ধরা পড়েন। বিমানে সেই সময় কিম ডেভি ছিলেন, কিন্তু কোনক্রমে তিনি পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।
২২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বম্বের সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে একটি রাশিয়ান বিমান থেকে নেমে এসে কিম ডেভি ফোন বুথ থেকে দুটো ফোন করেন এবং খুব দ্রুত একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে পুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তারপর দীর্ঘ ১০ বছর কিম ডেভির আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। দশ বছর বাদে তাঁর নিজের দেশ ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে তাঁর দেখা মেলে এবং তখনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অস্ত্রবর্ষণের ঘটনার আসল উদ্দেশ্যটি ঠিক কী ছিল, তা আজও রহস্যাবৃত এবং সেই তিমিরেই থেকে গেছে। বহু তদন্তের পরে বিবিসি (BBC) ধারণা করেছে যে হয়তো সেকালের পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাত্ম-সামাজিক সংগঠন আনন্দমার্গীদের উদ্দেশ্যেই এই অস্ত্রগুলি ফেলা হয়েছিল। যদিও এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত কিম ডেভি এই ধারণাকে নস্যাৎ করে জানান যে বাম শাসন তথা সিপিআইএম-এর সমর্থকদের উৎখাত করতে ভারতের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারই এই অস্ত্রবর্ষণের পরিকল্পনা করেছিল। ১৯৯৭ সালে ভারতীয় আদালত ঘোষণা দেয় যে আনন্দমার্গীদের উদ্দেশ্যেই এই অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। এর পিছনে প্রমাণ হিসেবে উঠে আসে বিমান থেকে পাওয়া আনন্দমার্গীদের সদর দপ্তরের ছবি। বিচারপতি জানান যে, ঐ এলাকায় আনন্দমার্গীদের একটি তিনতলা সাদা বাড়িই ছিল বিমানচালকের মূল লক্ষ্য। সেখানেই নাকি অস্ত্র ফেলার কথা ছিল। কিন্তু এই ঘটনার আজও সঠিক কিনারা হয়নি। আরো বহু ঘটনার ভারে চাপা পড়ে গেছে পুরুলিয়ার অস্ত্রবর্ষণের এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা। আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র সরঞ্জাম সংগ্রহের অভিযোগ উঠলেও তাঁরা সকলেই এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন এবং জানিয়েছেন যে এই অস্ত্রবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগ নেই।
পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা র অন্যতম অভিযুক্ত ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ ছিলেন প্রাক্তন বিমান পরিষেবা পরিদর্শক। তাঁর বাড়ি ছিল ইয়র্কশায়ারে এবং ব্রিটিশ সেনাতে যোগ দেওয়ার পর তিনি অস্ত্র আমদানি-রপ্তানিও করতে শুরু করেছিলেন। যদিও ‘এম আই ৫’ বিমানের প্রাক্তন চালক অ্যানি ম্যাকন তাঁর লেখা ‘স্পাইস, লাইস অ্যাণ্ড হুইসল-ব্লোয়ারস’ বইতে জানিয়েছেন যে পিটার ব্লিচ আসলে ‘এম আই ৬’ বিমানের এজেন্ট ছিলেন। বহু সাক্ষাৎকারে ব্লিচকে এই ঘটনার ব্যাপারে নানাবিধ প্রশ্ন করা হয় এবং প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই ব্লিচ তাঁর সেনাবাহিনীর পটভূমির কথা অস্বীকার করেন। ব্লিচের মতে, ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে ভারতে এইরকম বেআইনি অস্ত্র পাচারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি প্রথমে ডিফেন্স এক্সপোর্ট সার্ভিসেস অর্গানাইজেশনকে জানিয়েছিলেন এবং তারপরেই ইয়র্কশায়ার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানান। এমনকি পুলিশের অনুমোদনে তিনি লাটভিয়ান প্রাদেশিক বিমান পরিষেবার কাছ থেকে একটি বিমান কিনতেও সমর্থ হন। কিন্তু এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে উত্তর ইয়র্কশায়ারের স্পেশাল পুলিশ ব্রাঞ্চ। পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলার প্রথম ধাপের বিচারে পাঁচ জন লাটভীয় সহ পিটার ব্লিচের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ড্যানিশ নাগরিক এবং আনন্দমার্গীদের অন্যতম সদস্য কিম ডেভি পালিয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়। এই কিম ডেভির সম্পর্কে জানা যায় যে আনন্দমার্গীদের একটি গ্রামোন্নয়নের কাজে পুরুলিয়ায় এসেছিলেন কিম ডেভি এবং তাঁর বিরুদ্ধে ডেনমার্কে বহু ব্যাঙ্ক ডাকাতির অভিযোগ ছিল। তাঁকে সেখানে ‘বেয়ারফুট রবার’ বলে ডাকা হত।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নগর দায়রা আদালতের যাবজ্জীবন কারাবাসের রায়কে প্রতি প্রশ্ন করা হয় কলকাতা উচ্চ আদালতে। ইতিমধ্যে ভারতের কারাগারে বন্দি পাঁচ জন লাটভীয়কে রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়া হলে ঐ বছরই ১৪ এপ্রিল রুশ রাষ্ট্রদূত দিল্লি থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে এসে তাঁদের মুক্তির দাবি তোলেন। ভারত সরকার নৈতিক সমস্ত দিক বিচার করে তাঁদের মুক্তি দেয়। ২০০২ সালের ২৫ আগস্ট প্রেসিডেন্সি জেলে মুক্তির দাবিতে পিটার ব্লিচ আমরণ অনশন শুরু করেন। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার বব ইয়ং তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করেন। ব্লিচের বক্তব্য ছিল অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে তাঁকে ছাড়া অন্য সকলকে ছেড়ে দেওয়া যুক্তিহীন এবং পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু কলকাতা উচ্চ আদালতের বিচারপতি ব্লিচের এই মুক্তির আবেদন খারিজ করে ঘোষণা করেন যে কেবলমাত্র ভারত ও রাশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের কথা ভেবেই বন্দি পাঁচ লাটাভীয়কে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অবশেষে ২০০৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে পিটার ব্লিচ মুক্তি পান এবং দেশে ফিরে যান। ২০০৭ সালে ডেনমার্কে কিম ডেভির খোঁজ পাওয়া যায় এবং ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিশ জারি করা হয়। ডেনমার্ক মূলত দুটি শর্তে কিম ডেভিকে ভারতের হাতে তুলে দিতে রাজি হয়। এর মধ্যে প্রথম শর্তটি ছিল যে ডেভিকে কোনভাবেই যাতে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয়টি হল বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিন সপ্তাহের মধ্যেই কিম ডেভিকে পুনরায় ডেনমার্কে পাঠিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ২০১০ সালের ১ নভেম্বর ডেনমার্কের নিম্ন আদালতে ডেভিকে ভারতের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে আর তাই নিয়ে আবার ভারতের সিবিআইয়ের অনুরোধ রক্ষায় ডেনমার্ক সরকার কোপেনহেগেনের এজলাসে আবেদন করতে বাধ্য হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন ডেনমার্কের শীর্ষ আদালত সিদ্ধান্ত জানায় যে ডেভিকে ভারতে পাঠানো হবে না। এই সময়েই পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছিল বিধানসভা ভোটের আবহ। তার মধ্যে এই মামলা আর ব্লিচের সাক্ষাৎকারে কেন্দ্র-রাজ্য গোপন চক্রান্তের জাল ফাঁস হওয়ায় এই উত্তেজক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।
পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলা কে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সাংবাদিক তথা প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ চন্দন নন্দীর লেখা ‘দি নাইট ইট রেইড গানস : আনর্যাভলিং দ্য পুরুলিয়া আর্মস ড্রপ কনস্পিরেসি’ বইটি প্রকাশ পায়। তাছাড়া ঐ বছরই ডেনমার্কের চিত্র পরিচালক আন্দ্রেয়াস কোয়েফোয়েদ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ৯৪ মিনিটের তথ্যচিত্র তৈরি করেন।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.thequint.com/
- https://economictimes.indiatimes.com/
- https://eisamay.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
