বাস্কেটবল খেলা

বাস্কেটবল

ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মত সমগ্র বিশ্বে অন্যতম একটি জনপ্রিয় খেলা বাস্কেটবল (Basketball)। পাঁচজন করে খেলোয়াড়ের দুটি দলের মধ্যে এই ইনডোর গেম খেলা হয়। তবে আউটডোর গেম হিসেবেও বাস্কেটবল খেলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই খেলাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাশাপাশি কানাডা, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, চিন, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশগুলিতেও বাস্কেটবল একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হিসেবেই স্বীকৃত।

বাস্কেটবল খেলার সূত্রপাত বা উৎপত্তি মনে করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৯১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে ম্যাসাচুসেটসের ‘ইয়ং মেন্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ট্রেনিং স্কুল’-এর শারীরশিক্ষার প্রশিক্ষক এবং অধ্যাপক কানাডীয়-আমেরিকান ড. জেমস নারিস্মিথ এক বৃষ্টির দিনে তাঁর জিম-ক্লাসটি চালু রাখার কথা ভাবছিলেন। সেই কারণেই তিনি একটি অভিনব ইনডোর গেমস প্রণয়ন করেন যা তাঁর শিক্ষার্থীদের সুস্থ-সবল রাখবে। সেই জিমন্যাসিয়ামের চারদিকে উঁচু পাঁচিল ছিল, ফলে অন্য কোনও খেলাই সেই পরিসরে ভেবে উঠতে পারছিলেন না জেমস যা সুস্থভাবে খেলা যেতে পারে। ঐ জিমন্যাসিয়ামে বসেই সেই খেলার সাধারণ নিয়মকানুনগুলি লিখে ফেলেন তিনি এবং একটি দশ ফুট উঁচু বারের উপরে একটি পিচের ঝুড়ি পেরেক দিয়ে গেঁথে দেন। এখন যেরকম বাস্কেটবলের জালের দু পাশটাই খোলা থাকে, তখন সেই ঝুড়িতে তা ছিল না। ফলে প্রতিবার বল ঐ ঝুড়িতে পড়ার পর ঝুড়ি খুলে বল বের করে পুনরায় খেলা চালু করতে অনেক সময় নষ্ট হত। তাই কিছুদিন পর থেকেই খেলার মধ্যে ঐ ঝুড়ির নিচের দিকটা কেটে ফেলা হয় যাতে বল ওর মধ্যে গেলে সোজা তা নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। প্রথমে ফুটবল দিয়েই বাস্কেটবল খেলা হত। কিন্তু অনেক পরে শুধুমাত্র বাস্কেটবল খেলার জন্য বিশেষভাবে একটি বল তৈরি হয় যার রঙ ছিল বাদামি। ১৯৫০-এর দশকে প্রথম টনি হিঙ্কল আজকের দিনের মত চকমকে উজ্জ্বল বল তৈরি করেন খেলার জন্য যাতে তা একইসঙ্গে দর্শক এবং খেলোয়াড় উভয়ের কাছেই সহজে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু প্রথম দিকে বলের আকার সুষম ছিল না, তাই ড্রিবলিং-এর (Dribling) রীতিটিও খেলায় আসেনি। ১৯৫০-এর দশকেই ধীরে ধীরে বলের আকারও সুষম হতে থাকে আর সেই সঙ্গে ড্রিবলিং-ও বাস্কেটবল খেলার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯০৬ সাল পর্যন্ত খেলাতে সেই পুরনো পিচফলের ঝুড়িই ব্যবহৃত হত। পরে ব্যাকবোর্ড এবং মেটাল হুপ (Metal Hoop) ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথমে মেটাল হুপ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু ব্যাকবোর্ড ছিল না। ফলে খেলোয়াড়দের হাত থেকে বল অনেকসময়ই দর্শকাসনে চলে যেত আর তখন দর্শকরাও এই খেলার মধ্যে ঢুকে পড়ত যা খেলায় যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটাত। ফলে তারপর থেকেই এই ব্যাকবোর্ড লাগানো হয় এবং সেই সময় থেকেই ব্যাকবোর্ডে বল ধাক্কা লেগে ফিরত যেতে পারে এমন বাধাও খেলার মধ্যে একটা অভিনব চ্যালেঞ্জ এনে দেয়। ২০০৬ সালে জেমস নারিস্মিথের নাতনি তাঁর একটি ডায়েরি উদ্ধার করেন এবং সেই ডায়েরির লেখা থেকে তিনি জানান যে সেই সময় জেমস শিশুদের উপযোগী একটি খেলা ‘ডাক অন এ রক’ থেকেই এই বাস্কেটবল খেলার নিয়মকানুন সব তৈরি করেছিলেন। ১৮৯২ সালের ২০ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কের আলবানির একটি ওয়াইএমসিএ (YMCA) জিমন্যাসিয়ামে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্কেটবল খেলা হয়। সেই খেলায় প্রতি দলে নয়জন করে খেলোয়াড় উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানকালে ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত খেলার কোর্টের যে মাপ হয়, তার অর্ধেক মাপের কোর্টে সেই খেলাটি হয়েছিল। ১৮৯৭-’৯৮ সাল থেকেই প্রতি দলে ৫ জন করে খেলোয়াড় নেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। সেই সময় সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে YMCA-র সৌজন্যেই বাস্কেটবল খেলা আয়োজিত হতে থাকে, কিন্তু ক্রমেই খেলার মধ্যে অধিক উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়ে যাওয়ায় ১৮৯৮ সালে গঠিত হয় ন্যাশনাল বাস্কেটবল লিগ যা খেলোয়াড়দের উপর বিশেষ কিছু বিধিবদ্ধ নিয়ম চাপায় এবং খেলার উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সচেষ্ট হয়। জেমস নারিস্মিথ নিজে কলেজ স্তরে বাস্কেটবল খেলার প্রচলন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি নিজে বহু কলেজের বাস্কেটবল দলকে প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম হ্যামিলটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃকলেজীয় বাস্কেটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে উচ্চ বিদ্যালয় স্তরেও এই খেলা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ১৯৪৬ সালে ‘বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা’ সংস্থাটি তৈরি হওয়ার মাধ্যমে পেশাদারি বাস্কেটবলের সূচনা ঘটে। ১৯৪৯ সালে এই সংস্থাটি ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যায়। ১৯৩২ সালে আর্জেন্টিনা, চেকোশ্লোভাকিয়া, গ্রিস, ইতালি, লাটভিয়া, পর্তুগাল, রোমানিয়া এবং সুইজারল্যান্ড এই আটটি দেশ একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেটবল ফেডারেশন’। এই সংস্থার উদ্যোগেই প্রথম ১৯৩৬ সালের বার্লিন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে সূচিত হয় বাস্কেটবল খেলাটি। প্রথম প্রতিযোগিতায় কানাডাকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে পুরুষদের বাস্কেটবল খেলাই স্বীকৃত ছিল অলিম্পিকে, কিন্তু ১৯৭৬ সাল থেকে অলিম্পিকে মহিলা বাস্কেটবল খেলাও অনুষ্ঠিত হতে থাকে।

এই খেলার প্রধান উদ্দেশ্য হল বাস্কেট বা হুপের মধ্যে বলকে প্রবেশ করানো। একটি আয়তাকার কোর্টে বাস্কেটবল খেলা হয় আর এই কোর্টের ঠিক কোন অংশ থেকে বলটি খেলোয়াড় হুপে ফেলছেন তার উপর নির্ভর করে তিনি কত পয়েন্ট পাবেন। সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট স্কোর করতে পারবে যে দল, সেই বিজয়ী ঘোষিত হবে। ড্রিবলিং করে বা পাস (Pass) করেও বলটি সরানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে দুটি দলের প্রত্যেকটিতে মোট ১২ জন খেলোয়াড় থাকেন যার মধ্যে মাত্র ৫ জনই কোর্টে খেলতে পারেন। বিভিন্ন অবস্থানে দুই দলের খেলোয়াড়রা দাঁড়াতে পারেন, যেমন – পয়েন্ট গার্ড, ডিফেন্সিভ গার্ড, সেন্টার, অফেন্সিভ ফরোয়ার্ড, ডিফেন্সিভ ফরোয়ার্ড ইত্যাদি। প্রথমে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে তাঁদের নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকতে হয়, তবে খেলা চলাকালীন সে কোর্টের সর্বত্র চলাচল করতে পারে। বাস্কেটবল কোর্টটি দৈর্ঘ্যে ৯১ ফুট এবং প্রস্থে ৫০ ফুট হয়ে থাকে। কোর্টের মাঝ বরাবর একটি ‘হাফ-লাইন’ থাকে যার মাঝখানে একটি বৃত্ত আঁকা থাকে। এই অংশ থেকেই একটি ‘টিপ-অফ’-এর (Tipp Off) মাধ্যমে খেলাটি শুরু হয়। ‘টিপ অফ’ বলতে বোঝায় খেলার শুরুতে বলটিকে রেফারি শূন্যে ছুঁড়ে দেন এবং দুই দলের যে কোনও একজন খেলোয়াড় সেটি নিজের অধিকারে আনার চেষ্টায় শূন্যে লাফ দেন। কোর্টের দুই প্রান্তের ১০ ফুট লম্বা বাস্কেট থাকে। এই বাস্কেটের চারপাশে একটি ত্রি-স্তরীয় বৃত্তচাপ (Three Point Arc) অঙ্কিত থাকে। সুরক্ষার জন্য খেলোয়াড়েরা গামশিল্ড এবং মুখোশ পরে থাকেন। সমগ্র খেলাটি চারটি ১২ মিনিটের পর্বে বিভক্ত থাকে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ পর্বের মাঝে একটি ১৫ মিনিটের বিরতি থাকে। বাস্কেটবল খেলাটির ক্ষেত্রে তিনভাবে স্কোর করতে পারে কোনও দল। প্রথমত থ্রি পয়েন্ট আর্কের বাইরে থেকে বাস্কেটে বল ফেললে সেক্ষেত্রে তিন পয়েন্ট পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত ঐ আর্কের মধ্যে থেকে বাস্কেটে বল ফেললে তখন পাওয়া যায় দুই পয়েন্ট এবং সবশেষে সফল ফ্রি থ্রো-র (Free Throw) ফলে প্রতিটি থ্রো-র জন্য এক পয়েন্ট পাওয়া যায়। খেলার সময় কোর্টের ঠিক কোথায় বিপক্ষীয় দল ফাউল করেছিল, তার উপর নির্ভর করে কয়টি ফ্রি থ্রো পাবে একটি দল। বাস্কেটবল খেলার একেবারে আবশ্যিক ও অপরিহার্য নিয়মগুলির মধ্যে রয়েছে –

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

  • খেলা চলাকালীন যতবার খুশি খেলোয়াড় বদল করতে পারে কোনও দল।
  • বলটি কেবলমাত্র ড্রিবলিং বা পাসের মাধ্যমে অন্যত্র পাঠানো যায়। তবে একবার বলে দুই হাত রাখলে তখন আর সেই বল দিয়ে ড্রিবল করা যায় না।
  • বাস্কেটের আর্কের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাস্কেটে বল ফেলার জন্য প্রত্যেক বারে ২৪ সেকেন্ড সময় বরাদ্দ করা হয়।
  • যে দল বল নিয়ে বাস্কেটের দিকে এগোতে চায় স্কোর করা জন্য, তাদেরকে ‘অফেন্স’ এবং অন্য দলকে ‘ডিফেন্স’ বলা হয়।
  • সমগ্র খেলায় কোনও দলের করা ফাউল জমতে জমতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছালে, তার বিনিময়ে বিপক্ষীয় দল একটি ফ্রি থ্রো পায়। এটা অনেকটা ফুটবলের ফ্রি-কিকের মত।

বাস্কেটবল খেলার জগতে আন্তর্জাতিক স্তরে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বাস্কেটবল প্রতিযোগিতাগুলি হল ফিবা বাস্কেটবল বিশ্বকাপ (FIBA International World Cup), ফিবা ওমেন্স বাস্কেটবল বিশ্বকাপ (FIBA Womens Basketball World Cup), অলিম্পিক গেমস এবং ইউরো বাস্কেট (Euro Basket)। চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, গ্রিস, লাটভিয়া, পর্তুগাল, রোমানিয়া এবং সুইজারল্যান্ড এই দেশগুলিই মূলত আন্তর্জাতিক বাস্কেটবল দুনিয়ার একেবারে পরিচিত নাম। ১৯৫০ সালেই প্রথম ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের মত বাস্কেটবলের ক্ষেত্রেও চালু হয় ফিবা বাস্কেটবল বিশ্বকাপ আর তার তিন বছর পরে মহিলাদের বাস্কেটবল বিশ্বকাপও শুরু হয়ে যায়। অলিম্পিকের ক্ষেত্রে ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটলেও ২০১২ সালের পর থেকে অলিম্পিক বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় ক্রমান্বয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে ফিলিপাইনে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৃথকভাবে আয়োজিত বাস্কেটবল প্রতিযোগিতাগুলির কথাও উল্লেখ্য। ফিলিপাইনের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার নাম ‘ফিলিপাইন বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা ‘ন্যাশনাল বাস্কেটবল লিগ’ নামেই অনুষ্ঠিত হয়। ভারতও পিছিয়ে নেই। ১৯৩৬ সাল থেকেই ‘ফিবা এশিয়া’র (FIBA Asia) সদস্য হিসেবে ভারতের নিজস্ব বাস্কেটবল দলটি বেড়ে উঠেছে। ফিবা এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপে এখনও পর্যন্ত মোট ২৫ বার অংশ নিয়েছে ভারতীয় বাস্কেটবল দল। ভারতের বাস্কেটবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া অর্থাৎ বিএফআই (BFI) এই প্রতিযোগিতাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৪ সালে ফিবা এশিয়া কাপে চিনের বাস্কেটবল দলকে ৭ পয়েন্টের ব্যবধানে পরাজিত করে নজির গড়েছিল ভারতীয় বাস্কেটবল দল। এই জয়কেই বাস্কেটবল খেলার দুনিয়ায় দেশের সবথেকে বড় জয় বলে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস কিংবা সাউথ এশিয়ান গেমসের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেয় ভারত। ১৯৫১ সালের এশিয়ান গেমসে ভারত ৪র্থ স্থান এবং  ১৯৮২ সালে ৮ম স্থান অধিকার করে ভারত। শাহাজি শেখন, যোগিন্দর সিং, বিশেষ ভৃগুবংশী, রাজীব কুমার, মনোজ মঞ্জুনাথা, জগদীপ সিং, অরবিন্দ আনন্দুরাই, আমন সন্ধু প্রমুখ ভারতীয় বাস্কেটবল দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত।  

One comment

আপনার মতামত জানান