পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হাওড়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ উদয়নারায়ণপুর (Udaynarayanpur)। এই জনপদ মূলত উলুবেড়িয়া সাবডিভিশনের অন্তর্গত একটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক।
ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে উদয়নারায়ণপুর ২২° ৪৩′ ০১″ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭° ৫৮′ ৩০″ পূ: দ্রাঘিমাংশ বরাবর অবস্থিত। এই জনপদ উত্তরে হুগলী জেলার পুরশুঁড়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, দক্ষিণে আমতা ১ ও আমতা ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক পূর্বদিকে হুগলীর জাঙ্গিপাড়া ব্লক এবং পশ্চিমে খানাকুল ১ ও খানাকুল ২ ব্লক দ্বারা বেষ্টিত। হাওড়া সদর শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৩ কিলোমিটার।
উদয়নারায়ণপুরের নামকরণের সঠিক ইতিহাস সেভাবে জানা যায় না। তবে এখানকার গড় ভবানীপুরের রায় রাজবংশের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং মনে করা যেতে পারে এই বংশের রাজা উদয়নারায়ণের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে যে ভুরশুট পরগণার উল্লেখ পাওয়া যায় তা এখনকার উদয়নারায়ণপুরের ডিহি ভুরশুট অঞ্চল।
উদয়নারায়ণপুর মোগল আমলে সরকার সুলেমানাবাদের অধীনে ছিল। ইতিহাসের নিরিখে হাওড়ার এই অঞ্চল ঐতিহ্য সমন্বিত। এই অঞ্চলের ইতিহাস বলতে প্রথমেই গড় ভবানীপুরের কথাই প্রথমে মনে পড়ে। গড় ভবানীপুরের রানী রায়বাঘিনী ভবশঙ্করীর কথা এখনো লোকমুখে ফেরে। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী গড় ভবানীপুর পাঠান আমলে ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য তথা ভুরশুট রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এই ভুরশুট ছিল স্বাধীন রাজ্য। এখানকার রাজা ছিলেন রুদ্রনারায়ণ। মোগল আমলে যদিও এই অঞ্চল সম্রাট আকবরের শাসনাধীন হয়, তবু এর স্বাধীনতা খর্ব হয়নি। ভুরিশ্রেষ্ঠের রাজা রুদ্রনারায়ণকে সেসময় একটি ছাগল, একটি স্বর্ণমুদ্রা এবং একটি কম্বল রাজকর হিসেবে দিতে হত। রুদ্রনারায়ণ রায় মারা গেলে তাঁর স্ত্রী রানী ভবশঙ্করীকে কলিঙ্গের পাঠান সর্দার কোতলু খাঁর সেনাপতি ওসমান সসৈন্যে পাঠান দলে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। তেজস্বিনী ভবশঙ্করী অনুরোধে অসম্মত হলে ওসমান বহু সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করেন বাসডিঙ্গা গড়ের দেবমন্দির। সেই সময় রানী ভবশঙ্করী সেখানে পূজা দিতে গিয়েছিলেন এবং অল্পসংখ্যক দেহরক্ষী নিয়েও বিপুল বিক্রমে সেই পাঠান সৈন্যদের পরাস্ত করেন। মোগল সম্রাট আকবর রানীর এই বীর্যবত্তার সংবাদে বিস্মিত হন এবং তাঁকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধি দেন। সেসময় এই গড় ভবানীপুর ছিল ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের রাজধানী। এখন যদিও কয়েকটা দিঘি, দু-একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখা যায় না। তবে একটা উঁচু ঢিবির উপর জঙ্গলাবৃত একটি মন্দিরের ভগ্নস্তূপ দেখা যায় যা আসলে ছিল গড় ভবানীপুরের গোপীনাথ জিউর মন্দির। এই গোপীনাথ জীউ ছিলেন এখানকার রাজবংশের গৃহদেবতা।
এছাড়া এখানকার ফাঁসিতলা এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীলবিদ্রোহের করুণ আখ্যান। উদয়নারায়ণপুরের পাঁচারুল গ্রামের নীলকুঠির সাহেব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করেন এবং নেতাদের ধরে ধরে সার বেঁধে ডোমপাড়ার পুকুরপাড়ে ফাঁসি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এই স্মৃতি বহন করছে উদয়নারায়ণপুরের ফাঁসিতলা এলাকা। এখানকার সোনাতলার কাছে দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত একটি মণিনাথ শিবের আটচালা মন্দির রয়েছে যা আনুমানি খৃস্টীয় সতেরো শতকের শেষদিকে নির্মিত। শোনা যায় যে এখানকার ঐতিহ্যবাহী পোনা হাটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল প্রাচীনকালের তাম্রলিপ্ত বন্দরের। এই পোনা হাট নাকি জাঙ্গিপাড়ার জঙ্গলহাটের থেকেও প্রাচীন। উদয়নারায়ণপুরের বসন্তপুর গ্রাম এবং রামপুর গ্রামের চারশো বছরের প্রাচীন দুটি চতুষ্পাঠী মোগল আমলে বিদ্যাচর্চার জন্য খুব বিখ্যাত ছিল। ডিহি ভুরশুট, গড় ভবানীপুর, দোগাছিয়ায় বিভিন্ন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বাড়িতে এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে তুলোট কাগজে ও তালপাতায় লেখা সংস্কৃত পুঁথি। জানা যায় আধুনিক কালের অখ্যাত গুণী কবি প্রয়াত গীতা চট্টোপাধ্যায়ের প্রপিতামহ ঈষাণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই উদয়নারায়ণপুরের জমিদারি লাভ করেন বিবাহের যৌতুক হিসেবে। উদয়নারায়ণপুর -এ তাঁরা বহু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। প্রায় ১৭৫ বছরের প্রাচীন জমিদারি তাঁদের। যদিও এখানকার জমিদারির পাশাপাশি তাঁদের বাড়ী ছিল কলকাতার শিয়ালদার কাছে বৈঠকখানা বাজারে।
কেবল শৌর্য বীর্যের সুপ্রাচীন ইতিহাসই নয় উদয়নারায়ণপুর শিক্ষাবিস্তারেও তার প্রাচীনত্বের ইতিহাস বহন করে চলেছে। উদয়নারায়ণপুরে সবথেকে খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল উদয়নারায়ণপুর মাধবীলতা মহাবিদ্যালয়। এছাড়াও এখানে বহু প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয় রয়েছে। এখানে প্রায় ১২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ৭টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। খিলা গোপীমোহন শিক্ষা সদন, উদয়নারায়ণপুর সতীশচন্দ্র প্রাইমারি স্কুল, গড়ভবানীপুর পুণ্ডরীকাক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় ইত্যাদি এখানকার বিখ্যাত প্রাথমিক বিদ্যালয়। মোটামুটিভাবে স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের জ্ঞান-পিপাসা মেটাতো একসময় যে দুটি পাঠাগার তা আজ শুধুমাত্র যোগ্য গ্রন্থাগারিকের অভাবে বহু দুর্লভ বইয়ের সম্ভার নিয়ে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ১৯৮২ সালে স্থাপিত খিলাগ্রাম পঞ্চায়েতের গৌরাঙ্গচক গ্রামের প্রগতি শিল্পী সংস্থা সাধারণ পাঠাগার এবং ১৯৮৬ সালে স্থাপিত শহীদ অম্বিকা গ্রামীণ পাঠাগার দুটিই নিষ্প্রদীপ ইতিহাসের সাক্ষী এখন।
হাওড়ার বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে শিবের গাজন, চড়কের মেলা, মনসা পূজা, চণ্ডী ব্রত ইত্যাদি উৎসবেরই প্রাধান্য বেশি। তবে বিশেষত উদয়নারায়ণপুরে কিছু অভিনব উৎসবের প্রচলন আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলুরদমের মেলা। বিস্ময়কর হলেও এটাই এ অঞ্চলের বহুদিনকার রীতি। নতুন ধানের উৎসব যেমন নবান্ন তেমনি নতুন আলু উঠলে উদয়নারায়ণপুরের সিংটি গ্রামে হরেক রকম আলুরদমের সম্ভার নিয়ে মেলা বসে যায়। সিংটি গ্রামের ভাই খাঁ পীর বাবার মাজারে প্রত্যেক মাঘ মাসের পয়লা তারিখে এই আলুরদমের মেলা বসে। জমি থেকে তোলা আলু দিয়ে নানারকমের আলুরদম এখানে কিলো দরে বিক্রি হয়। আবার এই মেলাতেই পাওয়া যায় কাঁকড়া, শুঁটকি মাছ, মাছের জাল, জিলিপি, পাঁপড় ইত্যাদি। শুনতে অবাক লাগবে ঠিকই আলুরদমের খ্যাতির পাশাপাশি এই মেলার কাঁকড়ার খ্যাতিও কিছু কম নয়। একদিকে আলুরদম মুড়ির লোভনীয় দৃশ্য আর অন্যদিকে ছোটো-বড়ো নানা আকারের কাঁকড়া নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষদের। ৫০০ বছরের পুরনো এই মেলা উদয়নারায়ণপুরের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
এখানকার প্রাচীন সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে যাত্রাপালা এবং লোকগান। হাওড়া জেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি লেটো ভাঁড় যাত্রা আজও উদয়নারায়ণপুরে চর্চিত হয়। উদয়নারায়ণপুর ব্লকের ইটারাই গ্রামে আজ সেই ভাঁড়যাত্রার গ্রামীণ শিল্পীরা এই লুপ্তপ্রায় শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছেন দারিদ্র্যের অন্ধকারে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লেটো, যাত্রা, বাউল, তরজার মতো এইসব প্রাচীন লোকসংস্কৃতির উপাদান বাহুল্য হয়ে পড়েছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে উদয়নারায়ণপুর থেকে প্রকাশিত সবথেকে পুরনো পত্রিকা ‘অঞ্জন’-এর নাম সর্বাগ্রগণ্য। এছাড়া ‘ষাড়ঙ্গ’ পত্রিকা, বিলুপ্ত সংবাদ সাপ্তাহিকী ‘দামোদরের চর’ ইত্যাদি এই জনপদের বৌদ্ধিক চর্চার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
সেভাবে কৃষিক্ষেত্রে এই জনপদের বিশেষত্ব কিছু নেই। হাওড়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও ধান উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। তবে এখানকার মাদুর শিল্পীদের কদর সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে, এমনকি ওপার বাংলাতেও উদয়নারায়ণপুরের মাদুরশিল্পীরা সমানভাবে জনপ্রিয়। উদয়নারায়ণপুর থানার অন্তর্গত ভবানীপুর, মনসুকা, কানুপাট প্রভৃতি এলাকা মাদুর কাঠি চাষের জন্য বিখ্যাত। সিংটি, সোনপাড়া, কুমারচক এলাকার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ এই মাদুর শিল্প। এছাড়া হাওড়ার বেশিরভাগ তাঁতঘর রয়েছে এই জনপদেই। শাড়ি, ধুতি তৈরিতে এখানকার তাঁতিদের জুড়ি মেলা ভার। বেশিরভাগ তাঁতই হস্তচালিত।
উদয়নারায়ণপুরে দর্শনীয় স্থান বলতে ইতিহাস বিজড়িত রানি ভবশঙ্করীর ভগ্নপ্রায় দূর্গ, গোপীনাথ জীউর মন্দির, মণিনাথ শিবের মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি গড়ে উঠেছে রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া উপভোগ করা যেতে পারে নবনির্মিত বকপোতা সেতুর সৌন্দর্য।
নগরসভ্যতার আঁচড় লেগেছে উদয়নারায়ণপুরের বুকে। ধীরে ধীরে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের গন্ধ মুছে যাচ্ছে। হেরিটেজ সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগই পারে হাওড়ার এই গুরুত্বপূর্ণ জনপদের অতীত-ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে। ভুরশুটের রাজা উদয়নারায়ণ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও তাঁর পদচিহ্ন বুকে নিয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর।
তথ্যসূত্র
- ‘হাওড়া’- তারাপদ সাঁতরা-সুবর্ণরেখা প্রকাশনী, ২০০০- পৃষ্ঠাঃ ৩৫, ৭৫, ৭৬
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.uluberiasambad.in/
- https://bartamanpatrika.com/
- https://en.wikipedia.org/
- https://eisamay.indiatimes.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://dailyhunt.in/
- https://www.kolkata24x7.com/
আপনার মতামত জানান