‘বাবু’ রামদুলাল সরকার (Ramdulal Sarkar) একজন বাঙালি কোটিপতি ব্যবসায়ী যিনি অষ্টাদশ থেকে উনবিংশ শতকের মধ্যে জলপথে ইন্দো আমেরিকান বাণিজ্য থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের বাংলায় তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম কোটিপতি। কলকাতার বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো হিসেবে বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটুবাবুর দুর্গাপুজোর সূত্রপাত তাঁর হাত ধরেই হয়। কমলা ও বিমলা নামে তাঁর দুটি জাহাজ চলতো ভারত থেকে সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত। আজও বিডন স্ট্রিটের কাছে তাঁর বাড়ি রামদুলাল নিবাসে কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত সাবেকি বনেদি পুজো চলে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর পুজো নামে যে পুজোয় প্রথম পশুবলি বন্ধ করেছিলেন স্বয়ং রামদুলাল দে সরকার। শুধু তাই নয়, পঁচিশ বিঘা জমির উপর নির্মিত তাঁর বাড়ির অতিথিশালায় প্রায়দিনই দরিদ্রদের চাল, ডাল, কাঠ, মাটির হাঁড়ি বিতরণ করা হতো। ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে গোপনে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন রামদুলাল সরকার। বাণিজ্য-বিমুখ বাঙালির ইতিহাসে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আজও তিনি অনন্য স্মরণীয়।
১৭৫২ সালে দমদমের কাছে রেক্জানি গ্রামে রামদুলাল সরকার এর জন্ম হয়। পারিবারিকভাবে রামদুলালের আসল পদবি ছিল ‘দে’, সরকার ছিল তাঁদের উপাধি। ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে পরিবারের লোকেরা ‘দুলাল’ নামে ডাকতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’য় জানা যায় পরবর্তীকালে পুত্রের বিবাহ দেওয়ার সময় নিছক উচ্চবংশীয় হওয়ার লিপ্সায় তিনি নিজের পদবি ‘দে’ থেকে বদলে ‘দেব’-এ রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম বলরাম সরকার যিনি সুন্দর হস্তাক্ষরে গরীব দুঃস্থদের বাংলা লেখা শেখাতেন, তাঁদের জন্য হাতে লেখা বই বিতরণ করতেন। ক্যালিগ্রাফিতে বলরাম অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন কিন্তু তা দিয়ে বিশেষ কিছু উপার্জন হতো না তাঁর। সেই জন্য অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় কলকাতায় বলদের পিঠে খড়ের বোঝা চাপিয়ে তা বিক্রি করতে আসতেন তিনি। ১৭৫১-৫২ সাল নাগাদ বাংলায় বর্গি আক্রমণের সময় বলরাম ও তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। রাস্তার মধ্যেই রামদুলালের জন্ম হয়। হতভাগ্য বলরাম তাঁর প্রথম পুত্রসন্তানকে কোনো স্বাচ্ছন্দ্যই দিতে পারেননি। বাংলা বলা বা লেখা কোনোটাই শেখাতে পারেননি বলরাম, কারণ রামদুলালের জন্মের কয়েক বছর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মা’ও মারা যান। তখন মামাতো দাদু রামসুন্দর বিশ্বাস রামদুলালকে নিয়ে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় শুধু ফল ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতেন রামসুন্দর আর তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ রামদুলালের দিদা বাজারে খড় বিক্রি করতেন, ধান ভানার কাজও করতেন। পরে তিনি হাটখোলার দত্তবাড়িতে রাঁধুনির কাজ নেন। প্রবল দারিদ্র্য সত্ত্বেও প্রায়ই তিনি অন্যান্য দরিদ্র-দুর্গতদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। গঙ্গাস্নান থেকে ফেরার পরে প্রায়দিনই ধানের তুষ, চালগুঁড়ো ইত্যাদি বিতরণ করতেন। হাটখোলার দত্তবাড়িতেই মদনমোহন দত্তের কাছেই অন্যান্য পুত্রদের সঙ্গে প্রতিপালিত হন রামদুলাল।
মদনমোহন দত্তের পুত্রদের পড়ানোর সময় পণ্ডিতের কাছ থেকেই রামদুলাল প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ অর্জন করেছিলেন। কেবলমাত্র নিজের খরচে শুধু তালপাতা কিনে এনে তিনি লেখা অভ্যাস করতেন। নিরন্তর অভ্যাসে আর দীর্ঘ অধ্যবসায়ে ক্রমেই রামদুলাল একজন দক্ষ লিপিকর হয়ে ওঠেন। পরেরদিকে কলাপাতা কিনে লেখা অভ্যাস করতেন তিনি। এমনকি তপ্ত রোদে গঙ্গায় খোলা মাথায় গিয়ে কলাপাতা ধুয়ে তাতে আবার লেখার প্রয়াস করতেন রামদুলাল। মাতামহীর মতো পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। সে সময় ভাঙা ভাঙা ইংরেজিও রপ্ত করেছিলেন তিনি।
মদনমোহন দত্তের কাছারিতেই মাত্র পাঁচ টাকা বেতনে ‘বিল সরকার’ পদে তথা হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন রামদুলাল সরকার। এই সামান্য বেতনের মধ্য থেকেও ক্রমে ক্রমে একশো টাকা সঞ্চয় করে রামদুলাল তাঁর মাতামহকে সাহায্য করার জন্য বাগবাজারে একটি কাঠগোলায় সেই টাকা বিনিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে মদনমোহন দত্তের অনুমোদনে তিনি দশ টাকা বেতনে ‘শিপ সরকার’ তথা মুহুরীর পদে কাজ পান। তাঁর সঙ্গে জাহাজের নাবিক, অন্যান্য সহকারীদের কাছ থেকে বকশিশও পেতে শুরু করেন রামদুলাল। প্রতিদিনই ডায়মণ্ড হারবারে জাহাজের মাল ওঠা-নামা তদারক করতে তাঁকে যেতে হতো মোহনায়। খেজুরির পরে এই ডায়মণ্ড হারবারেই বিদেশি জাহাজগুলি নোঙর করতো। কিছুদিনের মধ্যেই মদনমোহন দত্ত তাঁকে চোদ্দো হাজার টাকা দিয়ে ‘তুলোহ্ অ্যাণ্ড কোং’ কোম্পানিতে একটি নিলামে পাঠান কিছু কিনে আনার জন্য। কিন্তু পথমধ্যে দেরি হয়ে যাওয়ায় সঠিক সময়ে নিলামে উপস্থিত হতে পারেননি তিনি। ফলে কিছুই কেনা হয়নি তাঁর। ইতিমধ্যে মনমরা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গার মোহনায় তিনি লক্ষ করেন একটি পণ্যবাহী জাহাজ ঘাটের কাছেই নিলাম হচ্ছে। সেই নিলামে যোগ দিয়ে সবথেকে বেশি চোদ্দো হাজার টাকা দর হেঁকে পণ্যসহ জাহাজ কিনে নেন রামদুলাল। কিন্তু তখনই আরেক ইংরেজ সাহেব তাঁর থেকে সেই জাহাজ কিনে নিতে চাইলে নারাজ রামদুলাল দর কষাকষি শুরু করেন। অবশেষে একলক্ষ চোদ্দো হাজার টাকায় সেই জাহাজ তিনি বিক্রি করে দেন ইংরেজ সাহেবকে। অতিরিক্ত এক লক্ষ টাকা এভাবে পেয়ে যাবেন তিনি ভাবতেও পারেননি। মদনমোহন দত্তের কাছে ফিরে গিয়ে সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলেন তিনি এবং সম্পূর্ণ টাকাটাই ফেরৎ দিয়ে দেন রামদুলাল। তাঁর কাছে সুযোগ ছিল ঐ বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করার, এমনকি তাতে ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না মদনমোহন। কিন্তু সেই বিপথে হাঁটতে চাননি রামদুলাল আর তাঁর এই সততা দেখেই মদনমোহন জাহাজ নিলামের লভ্যাংশের পুরো এক লক্ষ টাকাটাই রামদুলালের হাতে দিয়ে নিজস্ব ব্যবসা চালু করার পরামর্শ দেন মদনমোহন দত্ত।
স্বাধীন ব্যবসার দুনিয়ায় পদার্পণ করে রামদুলাল প্রথম ক্যাপ্টেন হ্যানা নামের এক পর্তুগিজ সাহেবের সঙ্গে বাণিজ্য করে লাভবান হন। শোনা যায়, ক্যাপ্টেন হ্যানার মৃত্যুর পরে পরোপকারী রামদুলাল আজীবন তাঁর বিধবা স্ত্রী ও পুত্রদের ভাতা দিয়ে গিয়েছেন। উপকারীর দান তিনি কখনও ভুলতেন না। আমেরিকানদের সঙ্গে বাণিজ্যের শুরুর দিকে প্রথমে ফেয়ারলি ফার্গুসন কোম্পানির ‘বানিয়া এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। তবে নিজস্ব উদ্যোগে অন্যান্য বণিকদের সঙ্গেও তিনি কাজ করতেন। তীক্ষ্ণ ব্যবসায়ী বুদ্ধি, মেধা আর দর কষার দক্ষতার কারণে ক্রমেই ব্যবসার বাজারে তাঁর প্রভাব বাড়ছিল। ইউরোপীয়ান কোম্পানি কিংবা ইংরেজ বণিকদের বদলে আমেরিকান বণিকদের সঙ্গেই তিনি ব্যবসার গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। রিয়েল এস্টেট, শেয়ার ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতেন রামদুলাল এবং আমেরিকার ব্যবসাতেও বিনিয়োগ ছিল তাঁর। সেহেতু বঙ্গোপসাগরের বুকে চলা প্রতিটি আমেরিকান জাহাজের তরফ থেকে ব্যবসার লভ্যাংশ অর্জন করতেন রামদুলাল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৭৯০ সাল থেকে আমেরিকানদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর আগে ১৭৭৬ সালে আমেরিকানরা স্বাধীনতালাভ করেছে আর সেই থেকেই বাণিজ্যক্ষেত্রে সর্বতোভাবে ব্রিটিশরা তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ১৭৮৭ সালে আমেরিকা থেকে প্রথম পণ্যবাহী জাহাজ কলকাতার বন্দরে আসে। তারপর থেকে বস্টন, সালেম, বেভারলি, ফিলাডেলফিয়া, প্রভিডেন্স, ইয়াঙ্কি, মার্ব্লহেড, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি বাণিজ্য-শহর থেকে নিয়মিত জাহাজ আসতে শুরু করে বাংলায়, বাংলার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী কেনার জন্য। প্রতিটি বাণিজ্য সংস্থার নিজস্ব বানিয়া এজেন্ট ছিল কলকাতায়। বছরে তিরিশ থেকে পঞ্চাশটা জাহাজ তো আসতোই কলকাতার বন্দরে। লোহা, সীসা, ব্র্যাণ্ডি ও অন্যান্য প্রকারের মদ্য পানীয়, মাছ, মোমবাতি, বরফ, গোমাংস, বিয়ার ইত্যাদি আমেরিকা থেকে আমদানি হতো কলকাতায় আর এখান থেকে চা, চিনি, নীল, সোরা, লিনসিড তৈলবীজ, কাপড়, ব্যাগ ইত্যাদি রপ্তানি হতো আমেরিকায়। আলিয়াবাদ, ঢাকা কিংবা গৌরীপুরের নামে বহু উন্নতমানের সুতিবস্ত্র সে সময় বিদেশের বাজারে রপ্তানি করা হতো। বাফ্তা, গারা, মামোড়ি, বন্দনা ইত্যাদি প্রকারের কাপড় সে সময় খুবই বিখ্যাত ছিল আমেরিকার বাজারে। সালেম শহরের প্রত্যেক মহিলাই গারা এবং মামোড়ি কাপড়ের তফাতটা বুঝতেন, এতটাই জনপ্রিয় ছিল সেই কাপড়। এসবের মধ্যে সাদা সুতি-বস্ত্রের রপ্তানি হতো প্রচুর। ছাপা ও ডাই করা সুতির কাপড়, রেশমের কাপড়, রুমাল, পশমের শাল ইত্যাদিও আমেরিকান বণিকরা এখান থেকে নিয়ে যেতো। ১৭৯৫-৯৬ সাল থেকে শুরু করে টানা দশ বছরে আমেরিকানরা যে পরিমাণ বাণিজ্য করেছে বাংলায় তা ইউরোপীয় বণিকদের প্রায় এক চতুর্থাংশ। প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের কূলে আসা আমেরিকান বাণিজ্যতরীর ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিলেন রামদুলাল দে সরকার। আমেরিকানদের মধ্যে তিনি ক্রমেই ‘অথরিটি’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। কলকাতার বন্দর থেকে মার্কিন মুলুকে রামদুলালের চারটি জাহাজ চলাচল করতো। সেই জাহাজগুলির মধ্যে দুটির নাম ছিল কমলা ও বিমলা, আর অন্য দুটির নাম ছিল যথাক্রমে ডেভিড ক্লার্ক আর রামদুলাল। প্রথম জাহাজের নাম তিনি রেখেছিলেন নিজের জন্মান্ধ কন্যার নামের প্রতিরূপে আর তৃতীয় জাহাজের নামের ডেভিড ক্লার্ক ছিলেন আসলে রামদুলালের ব্যবসায়িক অংশীদার ও বন্ধু। মার্কিন বাণিজ্য সম্প্রসারণে রামদুলালের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ২১ জন মার্কিন বণিক শিল্পী স্টুয়ার্ট গিলবার্টকে দিয়ে জর্জ ওয়াশিংটনের প্রথম একটি তৈলচিত্র আঁকিয়ে উপহারস্বরূপ রামদুলালকে পাঠান যা ১৮০১ সালে তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পরে সেই ছবি হাত বদল হতে হতে বর্তমানে আমেরিকান স্মিথসোনিয়ান সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। বস্টন, নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, নিউবেরি, সালেম ও মার্ব্লহেডে যথাক্রমে ১৬, ১৫, ১, ২, ২ ও ১ জন সোল এজেন্ট ছিল রামদুলাল দে সরকারের।
হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠায়, দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায়, বিভিন্ন প্রার্থনালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অর্থসাহায্যের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের বাখরগঞ্জে, কখনো বা সুদূর আয়ারল্যাণ্ডেও বন্যার্তদের সেবাকর্মে প্রভূত অর্থসাহায্য করেছিলেন তিনি। মাদ্রাজে দূর্ভিক্ষের সময়েও তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেলগাছিয়ায় দুঃস্থদের জন্য একটি অতিথিশালা নির্মাণ করিয়েছিলেন রামদুলাল এবং বারাণসীতে তাঁর উদ্যোগেই তেরোটি শিব মন্দির স্থাপন করা হয় যার জন্য তাঁর খরচ হয়েছিল প্রায় দু লক্ষ বাইশ হাজার টাকা। প্রত্যহ সত্তর টাকা খরচ করতেন তিনি গরীব-দুঃখীর সেবার জন্য। জানা যায়, কলকাতায় আর্ত-পীড়িতের চিকিৎসার জন্য তিন জন ডাক্তারের বন্দোবস্ত করেছিলেন রামদুলাল। শোনা যায়, বিডন স্ট্রিটের কাছে তাঁর নিজের বাড়ি রামদুলাল নিবাসে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন তিনিই প্রথম। আর সেই দুর্গাপুজোয় একবার পশুবলির সময় বলিপ্রদত্ত ছাগ-শিশু ভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় তাঁরই পায়ের কাছে। সেই থেকে দরদী রামদুলাল বলিপ্রথা বন্ধ করে দেন। এত বহুল ব্যাপ্ত ব্যবসা ছিল তাঁর যে শোনা যায় দিনে তিন লক্ষ টাকার চেক কাটতেন রামদুলাল স্থানীয় ব্যাঙ্কের উপরে। আবার একবার নাকি স্থানীয় ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে গোপনে পঁচিশ লক্ষ টাকা সাহায্য করেছিলেন তিনি। পঁচাশি বিঘা জমির উপর নির্মিত তাঁর বসতবাড়ির অতিথিশালায় প্রত্যহ দুঃস্থদের চাল, ডাল, আলু, ঘি, কাঠ ও মাটির হাঁড়ি বিতরণ করা হতো। এও শোনা যায় তাঁর স্ত্রী দুর্গামণির মান ভাঙানোর জন্য একবার নাকি রামদুলাল এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। এমনই দরাজ দিল মানুষ ছিলেন রামদুলাল। অষ্টাদশ শতকের বাংলার প্রথম কোটিপতি ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় তেত্রিশ লক্ষ টাকা। আর সব মিলিয়ে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদের পরিমাণ ছিল এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকা। আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে এত পরিমাণ টাকার মালিকানা লাভ আর কেউ বিশেষত আর কোনো বাঙালির সাধ্যে কুলায়নি। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও তাঁর জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। বাবু জমিদারদের মতো বিলাস-ব্যসনে মত্ত ছিলেন না তিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে দুই পুত্র যারা ছাতুবাবু ও লাটুবাবু নামেই পরিচিত, তাঁরা বাবুয়ানি আর বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েন। সেজন্য রামদুলালের তৈরি করে দেওয়া ব্যবসাও একসময় নষ্ট হয়ে যায়। সারাজীবনে খেদ বলতে ছিল তাঁর একটাই, কায়স্থ থাকা, উচ্চবংশের সম্মান না পাওয়া। যে কারণে পুত্রের বিবাহের সময় তিনি তাঁর পদবি পরিবর্তন করে ‘দেব’-এ রূপান্তরিত করেন।
১৮২৫ সালে তিয়াত্তর বছর বয়সে রামদুলাল সরকার এর মৃত্যু হয়।
বর্তমানে তাঁর সম্মানার্থে উত্তর কলকাতায় বেথুন কলেজ সংলগ্ন একটি রাস্তার নামকরণ তাঁর নামে রামদুলাল সরকার স্ট্রিট নামে নামকরণ করেছে কলকাতা পুরসভা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই রাস্তাতেই কলকাতার বিখ্যাত প্রাচীন মিষ্টির দোকান গিরিশ চন্দ্র দে ও নকুড় চন্দ্র নন্দীর দোকান অবস্থিত। এই রাস্তা সংলগ্ন বাড়িতেই মান্না দে একসময় বসবাস করতেন।
তথ্যসূত্র
- ‘সাধুতার পুরস্কার’, শিবনাথ শাস্ত্রী, সখা, ১ম ২য় ৩য় বর্ষ, পৃষ্ঠা ৭২-৭৩
- https://bn.wikisource.org/
- https://puronokolkata.com/
- https://anandautsav.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.bongodorshon.com/
One comment