রুদ্র মহম্মদ শহিদ্দুলা(Rudra Mohammad Shahidullah) একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী কবি, গীতিকার ও সুরকার যিনি প্রধানত রোমান্টিক ও প্রতিবাদী কবি হিসেবেই পরিচিত। স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ও তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ সোচ্চারিত হয়েছিল বারে বারে। “আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে” তাঁর লেখা অন্যতম জনপ্রিয় একটি কবিতা যেটি পরবর্তীকালে গান হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে।
১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশের বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জে রুদ্র মহম্মদ শহিদ্দুলা -র জন্ম হয়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায়। তাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ শহিদ্দুলা রাখা হয়। পরবর্তীকালে লেখালেখি শুরু করার পর তিনি নিজে তাঁর নামের আগে ‘রুদ্র’ নামটি ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর বাবার নাম ডাঃ শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। তাঁর বাবা ছিলেন ডাক্তার। মংলা ডক লেবার হাসপাতালে আজীবন তিনি ডাক্তারী করেছেন। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ঢাকা মেডিকাল কলেজের ছাত্রী তসলিমা নাসরিনের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। পরবর্তীকালে তাঁদের দাম্পত্য জীবনে মতবিরোধ তৈরি হওয়ায় ১৯৮৬ সালে তাঁদের উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
রুদ্রর পড়াশোনা শুরু হয় মিঠেখালিতে অবস্থিত তাঁর দাদুরবাড়ীতে। তাঁর দাদু মংলা এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন যিনি পরবর্তীকালে গর্ভনর হন। তাঁর বাড়ীতে নিয়ম করে সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্রিকা আসত যার মধ্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত পত্রিকা ‘বেগম’ ও কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা। এখান থেকেই রুদ্রর পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়। তৃতীয় শ্রেণী অবদি রুদ্র পাঠশালায় পড়েন। চতুর্থ শ্রেণীতে তিনি মংলা থানা সদরের সেন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলেই তিনি নবম শ্রেণী অবধি পড়েন। এরপর ১৯৭৩ সালে ঢাকার ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুল থেকেই চারটি লেটারসহ বিজ্ঞান শাখায় এস.এস.সি পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। রুদ্রর মা – বাবার ইচ্ছে ছিল তিনি ডাক্তার হন কিন্তু রুদ্রর সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহের কারণে তিনি কলা বিভাগে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলেও পরবর্তীতে রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে জড়িয়ে তাঁর কলেজে পড়াশোনা অনিয়মিত হয়ে পড়তে থাকে ক্রমশ। কলেজের ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় ১৯৭৯ সালের অর্নাস পরীক্ষায় তাঁকে বসতে দেওয়া হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮০ সালে তিনি অর্নাস পাস করেন এবং ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় রুদ্র প্রথম হতেন। রুদ্রর প্রথম কবিতা ‘আমি ঈশ্বর আমি শয়তান’ প্রকাশিত হয় হয় ‘আজাদ’ পত্রিকায়। অপরিণত তাঁর এই কবিতায় তাঁর জীবনদর্শনের প্রভাব পাওয়া যায়। এরপর ‘দুবিনীর্ত’ প্রকাশ হয়। ছাত্রজীবনেই রুদ্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ‘উপদ্রুত উপকূল’ এবং ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। ১৯৭৯ সালে বুক সোসাইটি থেকে ‘উপদ্রুত উপকূল’ প্রকাশিত হওয়ার পরে তা সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতাটি।১৯৮১ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ প্রকাশিত হয় যা প্রকাশের সাথে সাথে তিনি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘মানুষের মানচিত্র’, ১৯৮৬ সালে ‘ছোবল’, ১৯৮৭ সালে ‘গল্প’, ১৯৮৮ সালে ‘দিয়েছিল সকল আকাশ’, ১৯৯০ সালে ‘মৌলিক মুখোশ’ ইত্যাদি। তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবনে তিনি মোট সাতটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
তাঁর রচনাগুলিতে তাঁর প্রতিবাদী সত্তাটিই বার বার ব্যক্ত হয়েছে। তিনি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও কিছু ছোট গল্প এবং পঞ্চাশটির মত গান রচনা করেছেন ও সুর দিয়েছেন। তাঁর অন্যতম সৃষ্টি “ভালো আছি ভাল থেকো” দেশকাল সমাজের গন্ডী পেরিয়ে এপার বাংলা ওপার বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিপুলভাবে। বহু সিনেমা, থিয়েটার, সিরিয়ালে এই গানটি বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। রুদ্র চেয়েছিলেন জাতিভেদের উর্দ্ধে গিয়ে মানবতার ধর্মে নিজেকে পরিচিত করতে।
রুদ্র মহম্মদের জীবন মানেই কবিতা। কবিতা মানেই তাঁর জীবন। তাঁর সাহিত্যে তাঁর জীবনদর্শনই ফুটে উঠেছে বারংবার। নিত্যনতুন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য আন্দোলনে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদন করে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মতাদর্শ ছিল সাম্যবাদী। তিনি ছিলেন এক উদারমনা সংস্কারমুক্ত মানুষ। লেখালেখিই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। সেই কারণেই বহুবার তাঁর পেশা বদল হলেও সাহিত্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অটল। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন একবার তাঁর দিদিমার ট্রাংক থেকে টাকা চুরি করে তাঁর মামাতো ভাই বোনের সাথে মিলে ‘বনফুল লাইব্রেরী’ গড়ে তুলেছিলেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৭০ সালে বনফুল লাইব্রেরীর তরফ থেকে ‘কালো টাঁইয়ের ফাঁসে’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্হ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি যোগদান না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অগাধ যার প্রতিফলন ঘটেছে ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায়। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, কবিতাকে শ্রুতিমধুর করে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও তিনি তৎপর হয়েছিলেন। বিভিন্ন আবৃত্তি সভায় তাঁর ডাক পড়ত কবিতা পাঠের জন্য। তাঁর উদাত্ত কন্ঠ, আবৃত্তি পাঠের সাবলীলতা তাঁকে কবিসমাজে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ১৯৭৩ সালে ‘দুর্বিনীত’ ছাড়াও ‘অনামিকার অন্য চোখ’ ও ‘চুয়াত্তরের প্রসব যণ্ত্রণা’, ‘অশ্লীল জোৎস্নায়’, ‘স্বরূপ অণ্বেষণ’ প্রভৃতি সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা এবং ‘সাহস’ নামের একটি সাহিত্যপত্রের প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
অজস্র সংগঠনের তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠিতা ও যুগ্ম সচিব ছিলেন। এছাড়াও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠিতা সদস্যদের অন্যতম ছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে নিজগ্রাম মোংলায় ‘অন্তর বাজাও’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরী করেন তিনি। বর্তমানে ঐ প্রতিষ্ঠান বিশিষ্ট শিল্পী গোলাম মহম্মদের তত্ত্বাবধানে রুদ্রর গানগুলি পরিবেশিত করে থাকে। বাংলাদেশের আত্মাকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছিলেন যা তাঁর কবিতা ও গানের মধ্যে বার বার তা প্রকাশিত হয়েছে।
রুদ্র মহম্মদ শহিদ্দুলা ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ লাভ করেন তাঁর ‘উপদ্রুত উপকূল’ ও ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ এর জন্য।
রুদ্রর জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। শরীরের যত্নের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন পেপটিক আলসারে। ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র চৌঁত্রিশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৯৭ সালে তাঁকে ‘ভালো আছি, ভালো থেকো’ গানটির জন্য মরণোত্তর বাংলাদেশ চালচিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কারে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
তথ্যসূত্র
- https://zeenews.india.com/
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.thedailystar.net/
- https://roar.media/
