বিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার হলেন স্যামুয়েল বেকেট` (Samuel Beckett)। এছাড়াও তিনি নাট্যপরিচালক এবং অনুবাদকের কাজও করতেন। আয়ারল্যাণ্ডে জন্ম হলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি প্যারিসেই কাটিয়েছেন। অস্তিস্ত্ব এবং অভিজ্ঞতার উপর বহু ট্র্যাজি-কমিক লেখা লিখেছেন তিনি। ব্ল্যাক কমেডি এবং ননসেন্স জাতীয় লেখাই বেকেটের রচনার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। স্যামুয়েল বেকেটকেই ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার’-এর উদ্গাতা বলা হয়ে থাকে। তাঁর লেখা ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকটি এই অ্যাবসার্ড ধারার একটি অন্যতম রচনা যা আজও বিশ্বে সমানভাবে চর্চিত ও নন্দিত। ১৯৬৯ সালে স্যামুয়েল বেকেট নাটক ও উপন্যাসের ধারায় অভিনব কৃতিত্বের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল ডাবলিনের ফক্সরক শহরতলিতে স্যামুয়েল বেকেট এর জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম ফ্রাঙ্ক বেকেট এবং মায়ের নাম মারিয়া জোনস রো। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন জরিপকারী এবং তাঁর মা ছিলেন একজন সেবিকা। তাঁদের দুই সন্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র, বেকেটের ভাইয়ের নাম ছিল ফ্রাঙ্ক এডওয়ার্ড। পাঁচ বছর বয়সে ডাবলিনের একটি স্থানীয় প্লে-স্কুলে গান শিখতে শুরু করেন স্যামুয়েল বেকেট। এরপর ডাবলিনের হারকোর্ট স্ট্রিটে এলসফোর্ট হাউজ স্কুলে তিনি ভর্তি হন। আয়ারল্যাণ্ডের গির্জার সদস্য ছিলেন বেকেটের পরিবার। বেকেটের পৈতৃক বাড়ি ছিল কুলড্রিনাঘে এবং সেই বাড়ির সংলগ্ন একটি বিশাল টেনিস কোর্ট ছিল। বাড়ির আশেপাশের লেপার্ডটাউন রেসকোর্স, ফক্সরক রেলওয়ে স্টেশন, হারকোর্ট স্ট্রিট স্টেশন ইত্যাদি সব জায়গা তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে কোন না কোন সময়ে।
১৯১৯-২০ সাল নাগাদ এনিস্কিলেনে পোর্টোরা রয়্যাল স্কুলে ভর্তি হন স্যামুয়েল বেকেট । বিখ্যাত সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডও এই স্কুলে পড়েছিলেন। ১৯২৩ সালে এই স্কুল ছেড়ে দিয়ে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। এই কলেজে আধুনিক সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন বেকেট। স্বভাবতই তিনি একজন দক্ষ অ্যাথলিট ছিলেন বেকেট এবং বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে কলেজে পড়াকালীন খেলতেন তিনি। এছাড়াও বাঁ-হাতি বোলারের ভূমিকাতেও তিনি ছিলেন সেরা। পরবর্তীকালে ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে দুটি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন বেকেট। ফলে তিনিই ছিলেন একমাত্র ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী নোবেল প্রাপক। ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বেকেট ট্রিনিটি কলেজে ফরাসি, ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষা অধ্যয়ন করেন। ১৯২৬ সালে আধুনিক ভাষাসমূহ বিষয়ে একজন গবেষক হিসেবে নির্বাচিত হন স্যামুয়েল বেকেট। বার্কলের আরেক গবেষক এ.এ.লুস তাঁকে হেনরি বার্গসোঁর কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বেলফাস্টের ক্যাম্পবেল কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন এবং তারপরে ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্যারিসের ইকোলে নর্মাল সুপিরিয়র প্রতিষ্ঠানে লেকচারার পদে যোগ দেন স্যামুয়েল বেকেট। প্যারিসে থাকাকালীনই থমাস ম্যাকগ্রেভির মাধ্যমে বেকেটের পরিচয় ঘটে বিখ্যাত আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের। এরপরে জেমস জয়েসকে নানা কাজে সহায়তা করতে শুরু করেন বেকেট। ১৯২৯ সালে স্যামুয়েল বেকেটের প্রথম গবেষণামূলক কাজ ‘দান্তে, ব্রুনো, ভিকো, জয়েস’ বই আকারে প্রকাশ পায়। এই বইতে জয়েসের কাজকে প্রশংসা করে সমস্ত অপবাদ থেকে দূরে রাখেন তাঁকে। তবে জয়েসের কন্যা লুসিয়ার ক্রমবর্ধমান স্কিৎজোফ্রেনিয়ার কারণে বেকেটের সঙ্গে জয়েসের সম্পর্ক বেশিদূর এগোয়নি। পারিবারিক এই সমস্যায় জয়েস প্রচণ্ড জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। স্যামুয়েল বেকেটের প্রথম ছোটগল্প ‘অ্যাসাম্পশান’ প্রকাশিত হয় এমিল জোলার সাময়িক পত্রে। ঠিক এর পরের বছর ‘হরোস্কোপ’ নামে একটি কবিতা লেখার জন্য একটি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এই কবিতাটি আসলে রেনে দেকার্তের জীবনী অবলম্বনে লেখা। ১৯৩০ সালে ট্রিনিটি কলেজে আবার তিনি লেকচারার হিসেবে ফিরে আসেন। ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ সোসাইটিতে ফরাসি ভাষায় একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন তিনি। ১৯৩৪ সালে ডাবলিন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় বেকেটের লেখা ‘গ্নোম’ নামে একটি কবিতা। ১৯৩১ সালে বিখ্যাত লেখক মার্সেল প্রাউস্টের লেখার উপর একটি গবেষণামূলক বই লেখেন বেকেট ‘প্রাউস্ট’ নামে। ঠিক এর পরের বছর ১৯৩২ সালে তিনি প্রথম একটি উপন্যাস লেখেন ‘ড্রিম অফ ফেয়ার টু মিডলিং ওমেন’ নামে। কিন্তু কোন প্রকাশকই এটি প্রকাশ করতে না চাওয়ায় এটিকে বাতিল বলে গণ্য করেন বেকেট। ১৯৩৩ সালে তাঁর একটি ছোটোগল্পের সংকলন প্রকাশ পায় ‘মোর প্রিকস দ্যান ক্রিকস’ নামে।
১৯৩৫ সালে ‘ইকোস বোনস অ্যাণ্ড আদার প্রেসিপিটেটস’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় বেকেটের। এই সময় মস্কোতে আইজেনস্টাইনের সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি চিঠি লিখেছিলেন ম্যাকগ্রেভিকে, কিন্তু সে চিঠি হারিয়ে যায় কোনভাবে পরবর্তীকালে। ১৯৩৬ সালে ‘মার্ফি’ নামে একটি উপন্যাস লেখা শেষ করেন তিনি। ১৯৩৮ সালে এই উপন্যাসটিই ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন বেকেট। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকাপাকিভাবে প্যারিসেই থাকতে শুরু করেন বেকেট। ১৯৪০ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে বেকেট একজন পত্রবাহক হিসেবে যোগ দেন ফ্রেঞ্চ রেসিস্টেন্সে। ১৯৪২ সাল নাগাদ জার্মান গেস্টাপোর কাছে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন বেকেট, ফলে পায়ে হেঁটেই বেকেট এবং তাঁর এক বন্ধু সুজান রওনা দেন দক্ষিণ প্যারিসের রোসালিন গ্রামের উদ্দেশ্যে। আর এই গ্রামে লুকিয়ে থাকার সময়েই বেকেট তাঁর নতুন উপন্যাস শুরু করেন ‘ওয়াট’ নামে যা ১৯৪৫ সালে লেখা শেষ হয়।
১৯৪৫ সাল নাগাদ তাঁর মনে হয় তিনি যাই লিখুন না কেন কিছুতেই জেমস জয়েসকে অতিক্রম করতে পারবেন না বরং তাঁর ছায়াতেই থেকে যাবেন। ফলে ধীরে ধীরে জয়েসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করলেন স্যামুয়েল বেকেট । ঠিক এর পরের বছর জাঁ পল সাঁর্ত্রের সম্পাদিত পত্রিকা ‘লেস টেম্পস মডার্ন্স’-এ বেকেটের একটি ছোটোগল্পের প্রথমাংশ প্রকাশিত হয়। আসলে বেকেট সেই পত্রিকায় প্রথমার্ধটিই শুধু পাঠিয়েছিলেন। এই সময়েই একটি নাটক লেখেন তিনি ‘ক্র্যাপ্স লাস্ট টেপ’ নামে যা অনেক পরে ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। আর এর পাশাপাশি সম্পূর্ণ ফরাসি ভাষায় তিনি তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘মার্সিয়ের অ্যাট কেমিয়ের’ লেখা শেষ করেন এবং এই উপন্যাসটিকেই তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র পূর্বসুরি বলা হয়। ফরাসি ভাষায় তাঁর লেখা একটি ট্রিলজি উপন্যাস সেই সময় খুবই বিখ্যাত হয়েছিল – ‘মল্লয়’ (১৯৫১), ‘ম্যালোন ডায়েস’ (১৯৫১) এবং ‘দ্য আননেমেব্ল’ (১৯৬০)। ১৯৫২ সালেই স্যামুয়েল বেকেটের বিখ্যাত নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ প্রকাশ পায়। অদ্ভুতভাবে এই নাটকটিও প্রথমে ফরাসি ভাষায় লিখেছিলেন বেকেট। ১৯৫৩ সালে প্যারিসেই এটি প্রথম মঞ্চায়িত হয় এবং এর দুই বছর পরে এই নাটকের একটি ইংরেজি অনুবাদ মঞ্চায়িত হয়। প্রথমদিকে নাটকটি সম্পর্কে দর্শকেরা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও, ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকায় সমালোচক হ্যারল্ড হবসন এর প্রভূত প্রশংসা করেন। ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ ছাড়াও তাঁর লেখা আরো কিছু নাটক হল – ‘হ্যাপি ডেজ’ (১৯৬১), ‘ফিন ডে পার্টি’ (১৯৫৫) ইত্যাদি। বেকেটের যে নাট্যদর্শন তাকে ‘থিয়েটার অফ দ্য অ্যাবসার্ড’ বলে প্রথম চিহ্নিত করেন মার্টিন এসলিন। অ্যালবার্ট কাম্যু যে অ্যাবসার্ড তত্ত্বের কথা আগে বলেছিলেন, বেকেটের নাটকগুলি যেন তারই পরিণত প্রয়োগ। বেকেটের প্রতিটি নাটকেই কেবল হতাশার মধ্যে বেঁচে থাকার কথা রয়েছে। কখনও কখনও কাম্যুর মত তাঁকেও অস্তিত্ববাদী হিসেবে বিবেচনা করা হলেও তা সর্বাংশে সত্য নয়।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে তাঁর কাজের ধারায় কিছু পরিবর্তন আসে এবং এই সময়ের রচনাগুলিকে বেকেটের ‘মিনিমালিস্ট’ রচনা বলে দাবি করেন সমালোচকেরা। ১৯৬৯ সালে ‘ব্রেথ’ নামে মাত্র ৩৫ সেকেণ্ডের একটি নাট্য প্রযোজনা করেছিলেন স্যামুয়েল বেকেট। অবিশ্বাস্যভাবে সেই নাটকে স্পষ্টত কোনো চরিত্র ছিল না। একেই পৃথিবীর সবথেকে কম সময়ের নাটক বলে দাবি করা হয়। এই সময়ে খুব কম সংখ্যক চরিত্র এবং খুব কম সময়ের পরিসরে তিনি বেশ কিছু নাটক লেখেন যার মধ্যে ‘প্লে’ (১৯৬২), ‘নট আই’ (১৯৭২), ‘এহ জো’ (১৯৬৩), ‘ক্যাটাস্ট্রফি’ (১৯৮২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন স্যামুয়েল বেকেট। তার পাশাপাশি ট্রিনিটি কলেজের সম্মানীয় ডক্টরেট উপাধি, ফ্রান্সের ‘ক্রক্স ডে গুয়ের’ সম্মানও অর্জন করেছেন তিনি।
১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর স্যামুয়েল বেকেটের মৃত্যু হয়।